২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নোবেল বিজয়ী লুইস গ্লুক

-

নোবেল পুরস্কার নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলে কিন্তু কোনো ভবিষ্যদ্বাণী চলে না। এ বছর প্রথা ভেঙে ইংল্যান্ডের দি গার্ডিয়ান অনলাইন ৫ অক্টোবর জল্পনা কল্পনাভিত্তিক একটি লেখা লিখেছিলেন এলিসন ফ্লাড। তিনি লিখেছিলেন, মার্কিন লেখিকা জ্যামাইকা কিনকেইড ও কানাডার কবি অ্যানি কারসনের নোবেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা এবার উজ্জ্বল।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা কাজে আসেনি, যে দু’জনের সম্ভাবনার কথা লেখা হয়েছিল তারা কেউ পাননি। এ বছর কবিতার জন্য নোবেল জিতে নিয়েছেন আমেরিকান কবি লুইস গ্লুক। তিনি সে দেশের একজন নামকরা কবি। কয়েক বছর আগেও তাকে দেখা গেছে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হাত থেকে পুরস্কার নিতে। সাইটেশনে নোবেল কমিটি বলেছেÑ “সরল, সৌন্দর্যময় ও সুস্পষ্ট ‘কবিকণ্ঠের’ জন্য” তাকে এ পুরস্কার দেয়া হয়েছে। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেখাশোনা করে সুইডিশ একাডেমি। সেই একাডেমি বলছে, গ্লুকের ‘নিরাভরণ সৌন্দর্যের ভ্রান্তিহীন কাব্যিক কণ্ঠ ব্যক্তির অস্তিত্বকে সার্বজনীন’ করে তোলে। (এষহৃপশ ধিং ৎবপড়মহরংবফ ভড়ৎ "যবৎ ঁহসরংঃধশধনষব ঢ়ড়বঃরপ াড়রপব, ঃযধঃ রিঃয ধঁংঃবৎব নবধঁঃু সধশবং রহফরারফঁধষ বীরংঃবহপব ঁহরাবৎংধষ").
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই বিতর্ক চলছিল। এলিসনের লেখায় যেটা এসেছে। এসব মাথায় রেখেই এবার বেছে নেয়া হয়েছে মার্কিন এই কবিকে। একাডেমির পারমানেন্ট সেক্রেটারি ম্যাটম মাল্ম বলেন, তিনি পুরস্কার ঘোষণার আগ মুহূর্তে তার সাথে কথা বলেন। শুনে তিনি অবাক হন এবং আমাকে স্বাগত জানান।

২.
লুইসের পুরো নাম লুইস এলিজাবেথ গ্লুক। তার এর জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ এপ্রিল নিউ ইয়র্কে। বেড়ে উঠেছেন লং আইল্যান্ডে। তার বাবা ড্যানিয়েল গ্লুক একজন ব্যবসায়ী ও মা বিয়েত্রিচ গ্লুক রুশ বংশোদ্ভূত ইহুদি পরিবারের অধস্তন বংশধর। গ্লুক নামের ইংরেজি বানানের প্যাটার্ন দেখে বোঝা যায় এতে একটু ভিন্নতা আছে। এটি হাঙ্গেরিয়ান ভাষার একটি বর্ণ। এটা এই কারণেই হয়েছে যে তার পিতামহ ছিলেন হাঙ্গেরিয়ান ইহুদি, যিনি লুইসের বাবার জন্মের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাদের নিউ ইয়র্কে ছিল গ্রোসারি ব্যবসায়। লুইসের বাবারও লেখক হওয়ার বাসনা ছিল কিন্তু তা আর হয়নি। লুইসের মা ওয়েলেসলি কলেজের একজন গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। ছোটবেলায় মা-বাবা লুইসকে গ্রিক মিথলজি ও জোয়ান অব আর্কের জীবনীসহ ক্ল্যাসিক কাহিনীগুলো শিখিয়েছেন। আর ছোটবেলুুা থেকেই লুইস কবিতা লিখতে শুরু করেন। কিশোরী বয়সে কঠিন অসুখের কারণে তার পড়ালেখা ব্যাহত হয়। এর পর তিনি সারাহ লরেন্স কলেজে কবিতার ক্লাসের সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব জেনারেল স্টাডিজে নাম লেখান, যেখানে ননট্রাডিশনাল ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটি ডিগ্রি গ্রোগ্রাম চালু ছিল। তিনি ম্যাসাচুসেটসে বসবাস করছেন এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির ইংরেজির প্রফেসর। এই হলো তার পারিবারিক ও কবি হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট।

২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল নিচ্ছেন লুইস

৩.
লুইস গ্লিক একজন কবি ও প্রাবন্ধিক। তিনি অধ্যাপনার সাথে যুক্ত। সে কারণে সাহিত্য নিয়ে তার ব্যাপক কাজ রয়েছে। তার পুরস্কার প্রাপ্তির তালিকা থেকেই সেটা মিলবে। নোবেল পাওয়ার আগে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার, ন্যাশনাল হিউম্যানিটিজ মেডেল, ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল এরয়ার্ড ও বলিনজেন প্রাইজ পেয়েছেন। তিনি ২০০৩ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ‘পোয়েট লরেট অব ইউনাইটেড স্টেটস’ ছিলেন। দেখা যাচ্ছে তিনি ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন নোবেলের জন্য এবং শেষ পর্যন্ত তা পেলেন। তার আগে ২০১৬ সালে কবিতার জন্য বব ডিলান, যিনি মূলত সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে খ্যাত, নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
লুুইস গ্লুকের প্রথম কাব্য সঙ্কলন ‘ফার্স্টবর্ন’ প্রকাশিত হলে তিনি পাঠকের ও সুধীমহলের নজরে আসেন। তার কবিতায় সেই শক্তিমত্তা ছিল বোঝাই যাচ্ছে। ১৯৭১ এরপর তিনি ভারমন্টে গডার্ড কলেজে কবিতা পড়াতে শুরু করেন। তার এই সময়ের লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় বই ‘দি হাউজ অন মার্শল্যান্ড’ (১৯৭৫)। এটাকে অনেকে তার ব্রেকথ্রু ওয়ার্ক বা মোড় ঘুরিয়ে দেয়া গ্রন্থ বলে মনে করেন। এখানে তার আলাদা কণ্ঠস্বর যে আছে তার ইঙ্গিত মেলে। তার কবিতাকে বোঝার জন্য কিছু ব্যক্তিগত বিষয়ও তুলে ধরা প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালে তিনি যখন গডার্ড কলেজে সামার রাইটিং প্রোগ্রাম শুরু করেন তখন নোয়াহ নামে তার একটি ছেলে হয়। এর বাবা ছিলেন লুইসের ‘পার্টনার’ জন ড্রানো। ১৯৭৭ এ তাদের বিয়ে হয়। দেখা যাচ্ছে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি যেমন নতুন কণ্ঠস্বর নিয়ে এসেছেন তেমনি ব্যক্তিজীবনেও প্রথা ভেঙেছেন। ১৯৮০ সালে ড্রানো ও কবি এলিন ব্রায়ান্ট ভয়েটের স্বামী ফ্রান্সিস ভয়েট দু’জনে মিলে প্রাইভেট কলেজ নিউ ইংল্যান্ড কুলিনারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। লুইস এবং এলিন সেখানে বোর্ড অব ডিরেক্টরের সদস্য ছিলেন। দেখা যাছে কবিতা শেখাবার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। ১৯৮০ সালেই প্রকাশিত হয় লুইসের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ ডিসেন্ডিং ফিগার’ প্রকাশিত হলে বেশ এর কাব্যবাণী বা সুর ও বিষয়বস্তু নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। এর পরও বইটি সমাদৃত হয়। একই বছর ভারমন্টে তার বাড়িতে আগুন লেগে তার সব জিনিসপত্র পুড়ে যায়। এই দুঃখজনক ঘটনার পর তিনি যে সব কবিতা লেখেন তা তার পুরস্কার জয়ী বই ‘দি ট্রায়াম্ফ এচিলেস’ (১৯৮৫) এ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের প্রশংসা করে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন লেখক সমালোচক লিজ রোজেনবার্গ। তিনি এগুলোকে আগের কাজের চেয়ে সেরা বলে মত দেন। সমালোচক পিটার স্টিট ‘দি জর্জিয়া রিভিউ’-তে লুইসের এই বইটির প্রশংসা করে লেখেন, গ্লুক আমাদের সময়ের সেরা কবি হতে চলেছেন’। এই বইয়ের ‘মক অরেঞ্জ’ কবিতাটি নারীবাদী অভিধা পেয়েছে ও সেরা কবিতা হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। তিনি ১৯৮৪ সালে ম্যাসাচুসেটসের উইলিয়াম কলেজের ইংরেজি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার পদে যোগ দেন। পরের বছর তার বাবার মৃত্যু হয়। তিনি এর পর লেখেন ‘আরারাত’ (১৯৯০) নামে কাব্যগ্রন্থ। এতে দুঃখবোধ প্রধান হয়ে উঠেছে বলে সমালোচকরা মত দেন। সমালোচক ডুইট গার্নার নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রবন্ধ লিখে এটিকে আমেরিকায় ২৫ বছরের মধ্যে সেরা দুঃখের কবিতার সঙ্কলন বলে অভিমত দেন। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় লুইসের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘দি ওয়াইল্ড আইরিস’। যেখানে একটি কবিতায় বাগানের একটি ফুলকে বাগানের মালীর সঙ্গে প্রকৃতির বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। পাবলিশার্স উইকলি পত্রিকা বইটিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ বই’ উল্লেখ করে জানায়, এতে ‘পোয়েট্রি অব গ্রেট বিউটি’ তুলে ধরা হয়েছে। সমালোচক এলিজাবেথ লান্ড ‘ ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর ’ পত্রিকায় এটিকে ‘একটি মাইলস্টোন ওয়ার্ক ’ বলে বর্ণনা করেন। ১৯৯৩ সালে বইটি পুলিৎজার পুরস্কারে ভূষিত হয়। ১৯৯০ এর দশক লুইসের জন্য লেখার ক্ষেতে আরো সাফল্য বয়ে আনে। তবে ড্রানোর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে। ফলে নিউ ইংল্যান্ড কুলিনারি ইনস্টিউিটের কাজ হারান। পরে কবিতার জগৎ ছেড়ে প্রবন্ধ লেখায় মন দেন লুইস। ১৯৯৪ এ প্রকাশিত হয় তার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘প্রুফস অ্যান্ড থিয়োরিজ : এসেইজ অন পোয়েট্রি’। পরে আবার কবিতায় ফেরেন তিনি। প্রকাশিত হয় তার ‘মিডোল্যান্ডস’ (১৯৯৬), ‘ভিটা নোভা’ (১৯৯৯) ও ‘দি সেভেন এজেস’ (২০০১), ২০০৪ সালে তিনি ২০০১ এর ১১ সেপ্টেম্বর হামলার জবাবে দেন ‘অক্টোবর’ নামে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ কবিতায়। এতে দুঃখবোধ, মানসিক আঘাত, ট্রমা উঠে আসে। এতে ব্যবহৃত হয় গ্রিক মিথ। একই বছর তিনি ইয়েল বিশ^বিদ্যালয়ের ‘রোজেনক্রাংজ রাইটার ইন রেসিডেন্স’ সম্মানে ভূষিত হন। ইয়লে বিশ^বিদ্যালয়ে অবস্থানকালে তার আরো কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এগুলো হলো ‘এভার্নো’ (২০০৬), ‘ এভিলেজ লাইফ’ ( ২০০৯), এবং ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভার্চুয়াস নাইট; ( ২০১৪)। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ পোয়েমস : ১৯৬২-২০১২’। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তার আরেকটি প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘ আমেরিকান অরিজিনালিটি’।
৪. কঠিন অসুখের কারণে প্রথাগত শিক্ষা লুইস অর্জন করতে পারেননি। তার অসুখের নাম ধহড়ৎবীরধ হবৎাড়ংধ, তার এটা একটা জটিল রোগ, যার কারণে তার স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হয়েছে। এরই ছোঁয়া পাওয়া যায় তার কবিতায়। সেখানে মেলে দুঃখবোধ, ট্রমা ও এক ধরনের হতাশা। তাকে বলা হয়ে থাকে কনফেশনাল পোয়েট। বোঝা যায় কবিতায় তার ফর্ম ছিল আলাদা, সুইডিশ একাডেমিকে হয়তো সেটাই আকর্ষণ করেছে। তাই তাকে বেছে নেয়া হয়েছে পুরস্কারের জন্য। তাদের সাইটেশনেও সে কথাটি আছে। ১০ ডিসেম্বর সুইডেনের স্টকহোমে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের মাধ্যমে বিজয়ীদের হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। তবে করোনার কারণে এ বছর ওই অনুষ্ঠান বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। তিনি পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার পাবেন, কেননা এ বছর পুরস্কারের অর্থমূল্য বেড়েছে। তার পুরস্কার জয়ের মধ্য দিয়ে কবিতার জয়জয়কার হলো আবার। বিশ^ কবিতার অঙ্গনকে তা নাড়া দেবে নিশ্চয়ই।

 


আরো সংবাদ



premium cement
গ্যাটকো মামলা : খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে শুনানি ২৫ জুন বুড়িচংয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ গলাচিপায় স্ত্রীর স্বীকৃতির দাবিতে ৩টি সংগঠনের নেতৃত্বে মানববন্ধন থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা ছেলে হারা মা সাথিয়ার কান্না যেন থামছেই না বৃষ্টির জন্য নারায়ণগঞ্জে ইস্তিস্কার নামাজ আদায় প্রবাসী স্ত্রী থেকে প্রতারণার মাধ্যেমে দেড় লাখ টাকা চাঁদা আদায়, ছাত্রলীগ নেতাকে শোকজ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ভোটারের তালিকা চান হাইকোর্ট আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরো ৪৬ বিজিপি সদস্য উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যুবককে কুপিয়ে হত্যা কক্সবাজারে ট্রেন লাইনচ্যুত, যোগাযোগ বন্ধ

সকল