২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাঠাগার : অগ্রগতির বিজ্ঞান

-

আমার মনে হয় ‘পাঠ’ শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ। এই শ্রেষ্ঠত্ব কেন? এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ মানুষের আছে বুদ্ধিবৃত্তি যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। এটাই মানুষকে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা করেছে। কিন্তু এই বুদ্ধিবৃত্তি একটি বীজের মতো, সঠিক পরিচর্চা না করলে, আলো পানি বায়ু না পেলে গাছের চারা যেমন এক দিনের ব্যবধানে মারা যায়, ঠিক তেমনিই সঠিক পরিচর্চা না করলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি কোনোভাবেই বিকশিত হয় না। আর মানুষের এই বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষা। আর এই শিক্ষা অর্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে পড়াশোনা। পড়া ছাড়া সব শিক্ষাই অসম্পূর্ণ। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত সভ্যতা এসেছে তার মধ্যে যে সভ্যতায় শিক্ষার গুরুত্ব যত বেশি ছিল সে সভ্যতা তত বেশি ছিল উন্নত। যুগের পর যুগ পেরিয়ে মানুষ এগিয়ে চলেছে আরো এক আলোকিত সভ্যতার দিকে। সভ্যতার অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা, শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজন পড়াশোনা, পড়ার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ, মানে লাইব্রেরি। স্কুল কলেজ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই সুশিক্ষা অর্জনের জন্য যে পড়াশোনা প্রয়োজন তার জন্য যথেষ্ট নয়। মানুষ ও মানুষের জীবন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও নৈতিকতা, অর্থনীতি ও রাজনীতি সব কিছুর সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্ক যুক্ত লাইব্রেরি। মানুষ চির আলোর সন্ধানী, আলোর দিকে, সত্যের দিকে, উন্নতি ও সফলতার দিকে মানুষ সদা ধাবমান। আলোর পথে এগিয়ে মানুষ হতে চায় আলোকিত মানুষ। সত্য সুন্দর ও সমৃদ্ধির তৃষ্ণা তার বুকে চিরদিন প্রজ্বলিত থাকে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, অহিংসা, সাম্য এবং ভালোবাসার পৃথিবী গড়তে প্রয়োজন মানুষের মনুষ্যত্বের সঠিক বিকাশ, আর তার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন সুশিক্ষার। আর সুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ পড়ার পরিবেশ অর্থাৎ লাইব্রেরি। লাইব্রেরি মানুষের আলোকিত জীবন-সংস্কৃতির প্রথম ও প্রধান আলোকরশ্মি। মানুষ যে পথের যাত্রী সে পথের নির্দেশক হলো সঠিক শিক্ষা। আর সুশিক্ষা কখনোই পূর্ণরূপে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব নয়, তার জন্য প্রয়োজন পাঠ্যবই বহির্ভূত (এক্সট্রা) পড়াশোনা। আর মানুষকে পাঠ্যবই বহির্ভূত এক্সট্রা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ মানে পাঠাগার। প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে, বাজারে, মহল্লার অলিতে-গলিতে যেমন ধর্মীয় উপাসনালয় রয়েছে ঠিক তেমনেই দেশের মানুষকে সুশিক্ষিত ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি গ্রামগঞ্জে, শহরের অলিতে গলিতে উন্মুক্ত পাঠাগার সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রয়োজন। পাঠাগার হচ্ছে সত্য ও জ্ঞান সন্ধানের তীর্থস্থান, গবেষণাগার, সমাজের প্রজ্বলিত প্রদীপ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা, অন্ধজনের চোখের আলো এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে সেতুবন্ধন। শিক্ষা মানুষকে পূর্ণতা দেয়। আর একজন শিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলেন আদর্শ সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা। পাঠাগার বিপুল বই সমৃদ্ধ নিতান্তই একটি কক্ষবিশেষ হলেও প্রকৃতপক্ষে পাঠাগারের আছে একটি সজীব প্রাণবন্ত গতিময় সত্তা, বই মানুষের উপলব্ধির ধারক ও বাহক। এক যুগ থেকে অন্য যুগের, এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের মধ্যে যোগ সংযোগ হচ্ছে বই। ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা, রীতিনীতি, আদর্শ সব কিছুরই সবচেয়ে আদর্শ বাহন হচ্ছে বই, আর সেই বাহনের সংরক্ষণাগার হচ্ছে পাঠাগার। অসচেতন মানুষকে সচেতন, অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষার আলো দেখাতে প্রয়োজন পাঠাগার। পাঠাগার সংস্কৃতি, সভ্যতা ও মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের পথকে সুগম করে। পাঠাগার মানুষকে সঠিকভাবে ভাবতে শেখায়, চিন্তা করতে শেখায়। মূলত পাঠাগার মানুষের সহজাত বিচারবুদ্ধিকে সঠিকভাবে ও উত্তম রূপে প্রয়োগ করতে শেখায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানুষকে শিক্ষা অর্জনের পথ দেখিয়ে দেয়, পদ্ধতি শেখিয়ে দেয় মাত্র। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে নিজ চেষ্টায় অর্জন করতে হয়। শিক্ষিত হওয়ার জন্য কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যথেষ্ট হতে পারে না। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্যও এটা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের পথকে সুগম করা অর্থাৎ পথ দেখিয়ে দেয়া। শ্রদ্ধেয় লেখক প্রমথ চৌধুরীর উক্তি স্মরণ করা যায়, “সাহিত্যে চর্চার জন্য চাই লাইব্রেরি, এদেশের লাইব্রেরির সার্থকতা হাসপাতালের চাইতে কিছু কম নয় এবং স্কুল-কলেজের চাইতে কিছু বেশি, আমার বিশ্বাস শিক্ষা কেউ কাউকে দিতে পারে না। আমি লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের উপর স্থান দেই এই কারণে যে, এ স্থলে লোকে স্বেচ্ছায় স্বাচ্ছন্দ্যচিত্তে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়; প্রতি লোক তার স্বীয় শক্তি রুচি অনুসারে নিজের মনকে, নিজের চেষ্টায় আত্মার রাজ্যে জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।” আসলেই এটা চরম সত্যি যে হাসপাতালের চেয়েও পাঠাগারের গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ হাসপাতাল বিশেষ মানুষের শারীরিক রোগ সারিয়ে তুলে, অন্য দিকে পাঠাগার পুরো সমাজের, পুরো জাতির আত্মিক রোগ সারিয়ে তুলতে সক্ষম। সমাজের যত অন্যায় অবিচার, দুঃশাসন নির্মূলে পাঠাগার সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। জাতীর আত্মিক যত ক্ষত, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অনাচার, দুর্নীতি ও পাপাচার দূর হতে পারে প্রতিটি মহল্লায় উন্মুক্ত পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সুশিক্ষা ও নৈতিকশিক্ষায় মানুষকে শাণিত করতে মানুষকে বই মুখী করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মানুষকে কুসংস্কার ও অনাচার থেকে, অসচেতনতা ও নির্বুদ্ধিতা থেকে, সামাজিক অপরাধ ও মাদকাসক্তি থেকে উত্তরণের অন্যতম কার্যকরী উপায় হতে পারে পাঠাগার। আদর্শ জাতি বিনির্মাণে, ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বিকশিত করতে, নতুন প্রজন্মকে নৈতিক অধঃপতন থেকে বাঁচাতে প্রয়োজন গণহারে উন্মুক্ত ও সমৃদ্ধ পাঠাগার গড়ে তোলা। আমাদের উচিত গ্রামে গঞ্জে যতগুলো স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপাসনালয় রয়েছে, তারচেয়ে বেশিসংখ্যক উন্মুক্ত পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা। সুশিক্ষা প্রদানে ও সুনাগরিক গড়তে এটা হতে পারে সরকারের যুগান্তকারী ও কার্যকরী পদক্ষেপ। পাঠাগারের মাধ্যমে জাতীগত উন্নত বিকাশায়ন সম্ভব। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য, সুশিক্ষা ও সুনাগরিক গঠনের জন্য, সামাজিক অপরাধ ও মাদকাসক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য, ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য, সুগঠিত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য ঘরে ঘরে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।


আরো সংবাদ



premium cement
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১ দাগনভুঞায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির ঘটনায় আ’লীগ নেতাকে শোকজ দখলে থাকা ৪ গ্রাম আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর আত্মহত্যা! কুলাউড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু যেসব এলাকায় রোববার ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে

সকল