২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোলাম মোস্তফা তার সাহিত্য সাধনা

-

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গোলাম মোস্তফা এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আধুনিক বাংলাসাহিত্যে ইসলামী ভাবধারার সাহিত্য রচনায় রয়েছে তার বিশেষ কৃতিত্ব। বাঙালি মুসলমানের জাতীয় জাগরণ তার সাহিত্যেকর্মের মূল উদ্দেশ্য। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক বাংলা ১৩০২ সনের ৭ পৌষ, ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে কবি গোলাম মোস্তফা জন্মলাভ করেন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক, ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে আইএ, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন এবং ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ডেভিড হেয়ার টেনিং কলেজ থেকে বি.টি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ব্যারাকপুর সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু হয়। পরে কলকাতার হেয়ার স্কুলে, কলকাতা মাদরাসায়, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট ডিমনেস্ট্রেশন হাইস্কুলে সাধারণ শিক্ষক এবং বাকুরা ও ফরিদপুর জেলা স্কুলে হেডমাস্টার পদে চাকরি করে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।
অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’তে ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। পরে দীর্ঘ ৫০ বছর সাহিত্যকর্ম অব্যাহত রেখে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার লিখিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রক্তরাগ, হা¯œাহেনা, খোশরোজ, সাহারা, বুলবুলিস্তান, কাব্যকাহিনী ও বনি আদম নামের সাতটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, মুসাদ্দাস-ই-হালী, শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া, ইখওয়ানুস সাফাসহ চারটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ, রূপের নেশা ও ভাঙ্গা বুক নামের দু’টি উপন্যাস গ্রন্থ; তারানা-ই-পাকিস্তান ও গীতি সঞ্চায়ন নামের দু’টি গানের সংকলন; ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলাম ও জেহাদসহ চারটি রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ; বিশ্বনবী, মরুদুলাল ও হজরত আবুবকর নামের তিনটি জীবনী গ্রন্থ, আল-কুরআন নামে কুরআনের একটি অনুবাদ গ্রন্থ; আমার চিন্তাধারা ও গোলাম মোস্তফা : প্রবন্ধ সংকলন নামের দু’টি প্রবন্ধ সঙ্কলন পাওয়া গেছে। আলোকমালা (সিরিজ), আলোকমঞ্জুরী (সিরিজ), মঞ্জুলেখা, মণিমুকুর, খোকা-খুকীর বই, বাংলা ব্যাকরণ নামে তার বেশ কয়েকটি শিশু পাঠ্যপুস্তকও আছে।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের বেশির ভাগের মূল বিষয় ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি লিখেননি; বরং ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ রূপায়নের জন্যই লিখেছেন তিনি। তিনি রসাত্মক কবিতা রচনা করলেও কুরআন-হাদিস তথা ইসলামী আদর্শ ঐতিহ্যের প্রতি ছিলেন তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন। কোনো রচনাই যেন ইসলাম পরিপন্থী কিংবা ইসলামের বিকৃত উপস্থাপন না হয় সে দিকে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। ইসলামী চেতনার রূপায়ণই তার সাহিত্য-সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য এবং মুসলিম সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতির জাগরণ তার লক্ষ্য। তিনি মুসলিম জাতির জাগরণমূলক ইসলামী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিষয়াবলিকেই গীতি কবিতার আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন। তার জীবন সাধনায় মুসলিম বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বিষয়াবলীকেই সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনিআমার লক্ষ্য আদর্শ প্রবন্ধে লিখেন,
‘যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসাদের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিল কোনো স্বাতন্ত্র্য, না ছিল কোনো স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মনন শক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাক্সক্ষা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। জাতির অন্তরমূর্তি ছায়া ফেলে তার সাহিত্যের মনো-মুকুরে। সাহিত্য তাই জাতির মনের প্রতিধ্বনী। সাহিত্যের ভেতর দিয়েই গোটা জাতির সাচ্চা চেহারা দেখা যায়। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানের কোনো সাহিত্যই তখন রচনা হয়নি। আমি তাই ছোট বেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে।’
গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা ও খ্যাতনামা কবি। কবি হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, জীবনী লেখক, অনুবাদক, গীতিকার, সুরকারসহ বহু প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার সাহিত্য রচনায় গোলাম মোস্তফার স্বতন্ত্র¿ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আদর্শের ক্ষেত্রে অনমনীয়তা ও দৃৃৃৃৃঢ়তা। তার সাহিত্য সাধনা মুসলিম সাহিত্যধারাকে করেছে প্রত্যয়নিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়বোধের মধ্যে সংস্থিত এবং বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য-সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী হলেও তার সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্য। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাক্সক্ষা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাকিদে নয়, সহজভাবে আমি বাংলার সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ।
গোলাম মোস্তফার অনন্য কীর্তি বিশ্বনবী। বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গ্রন্থগুলোর অন্যতম এ গ্রন্থখানি। বাংলা ভাষায় রচিত হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনী গ্রন্থগুলোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ বিশ্বনবী। গোলাম মোস্তফা রাসূল প্রেমিক সাহিত্যিক। তাই রাসূল সা:-এর প্রতি অগাধ প্রেম-ভালোবাসা থেকেই তিনি বিশ্বনবী রচনা করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বনবী গোলাম মোস্তফার ‘ইশক-ই-রাসূল’ (রাসূল প্রেম)-এর ফসল। বইটির পরতে পরতে তিনি নিজেকে ‘আশেকে রাসূল’ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাসের তথ্য, তত্ত্ব ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, দার্শনিক যুক্তি ইত্যাদি উপস্থাপনের মাধ্যমে হজরতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তার প্রয়াস এ গ্রন্থে সর্বত্র। হজরতের জীবন ঘটনার কল্পচিত্র, সাবলীল বর্ণনা, আকর্ষণীয় উপস্থাপনা বিশ্বনবীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
সাহিত্যকর্মে অনন্য অবদানের জন্য গোলাম মোস্তফা ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ‘প্রেসিডেন্ট পদক’ এবং ‘সেতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধী লাভ করেন। তিনি করাচির ইকবাল একাডেমি এবং ঢাকার বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। তা ছাড়া কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী সদস্য, ন্যাশনাল বুক সেন্টার অব পাকিস্তানের (ঢাকা) সদস্য, ইসলামিক একাডেমি, ঢাকা-এর সদস্য, উর্দু-বাংলা উন্নয়ন বোর্ড, লাহোর-এর সদস্য, জাতীয় উন্নয়ন ব্যুরো, পূর্ব পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড, পাকিস্তান মজলিস, রওনক, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের তিনি সদস্য ও কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক লেখক সংস্থা পি-ই-এনের কেন্দ্রীয় পাকিস্তান শাখা এবং পূর্ব পাকিস্তান শাখার অন্যতম কর্মকর্তা ছিলেন। এ মহান কীর্তিমান সাহিত্য সাধক ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement
ঝালকাঠিতে গ্রাম আদালত কার্যক্রম পরিদর্শনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল চুয়াডাঙ্গায় বাতাসে আগুনের হল্কা : গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি সাজেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ শ্রমিক নিহতের খবরে ঈশ্বরগঞ্জে শোক দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কেন বাংলাদেশে? জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি

সকল