১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একজন সব্যসাচী লেখক

-

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?
Ñ সৈয়দ শামসুল হক

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে একজন শক্তিমান লেখক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। বিজ্ঞানের যেমন অনেকগুলো ক্ষেত্র রয়েছে। তেমনিভাবে সাহিত্যেরও অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন : কবিতা, গল্প, নাটক, সিনেমা, গান, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছড়া ইত্যাদি। প্রত্যেক সাহিত্যিকই একাধিক ক্ষেত্রে কাজ করলেও একটি নির্দিষ্ট জায়গায় দক্ষ ও পারদর্শিতা দেখাতে পারেন। তবে ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই থাকে। কিছু কিছু লেখক সাহিত্যের সব জায়গাতেই বেশ দাপটের সাথে পদচারণা করে থাকেন। আর তাদের বলা হয়ে থাকে সব্যসাচী লেখক। সৈয়দ শামসুল হকের বাংলা সাহিত্যের প্রায় সবগুলো শাখায় ছিল সাবলীল বিচরণ। তিনি প্রায় সব শাখায় নিজের দক্ষতা ও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। তাই উনাকে অভিহিত করা হয় বাংলা সাহিত্যের একজন ‘সব্যসাচী লেখক’। তিনি যুগের চেয়েও আধুনিক, গতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তার সাহিত্যকর্মে এর সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান। তিনি ১১ বছর বয়সে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলেন। তখন দেখছিলেন রান্নাঘরের পাশে সজনে গাছের ডালে লাল টুকটুকে একটা পাখি। এই দৃশ্য দেখে তার মাথায় দুই লাইনের একটা কবিতা বের হয়ে আসে। কবিতাটা হচ্ছে, ‘আমার ঘরে জানালার পাশে গাছ রহিয়াছে/ তাহার উপর দু’টি লাল পাখি বসিয়া আছে।’ এই কবিতা লিখেই সৈয়দ শামসুল হক সাহিত্যকর্মে হাতেখড়ি নেন। সেই যে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, বলতে গেলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার কলম থেমে থাকেনি। ১৯৬৬ সালে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। এ যাবতকালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সব সাহিত্যিকের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে এই পুরস্কারটি পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে যা একটি বিরল অর্জন। পঞ্চাশের দশক থেকে সৈয়দ শামসুল হক বিচিত্র রচনায় সমৃদ্ধ করে গেছেন বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন ও মা হালিমা খাতুন। বাবা সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন পেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। সৈয়দ হক তার বাবা-মায়ের আট সন্তানের জ্যেষ্ঠতম। সৈয়দ হকের শিক্ষাজীবন শুরু হয় কুড়িগ্রাম মাইনর স্কুলে। সেখানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন কুড়িগ্রাম হাই ইংলিশ স্কুলে। এরপর ১৯৫০ সালে গণিতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে উনার অন্য বন্ধুরা যখন ঘোরাঘুরি, খেলাধুলা ও পরবর্তী লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তখন তিনি ছিলেন কবিতা লেখা নিয়ে ব্যস্ত। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তিনি ঘরে বসে নিজের খাতায় টানা ২০০টা কবিতা রচনা করেছিলেন। সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিল তাকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। কিন্তু যার মাথার ভেতরে বাংলা সাহিত্যের ভূত চেপে আছে, তার পক্ষে ডাক্তারি পড়াশোনা করা ছিল অসম্ভব। তাই পিতার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ১৯৫১ সালে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছরখানেকের বেশি সময় এক সিনেমা প্রডাকশন হাউজে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। তিনি খুব মেধাবী ছাত্র হয়েও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার প্রতি উদাসীন ছিলেন। এর মূল কারণ ছিল সাহিত্যকর্ম। তিনি অল্প বয়স থেকেই সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের বই পড়তেন। কলেজ জীবনে পদার্পণের পর সাহিত্য বিষয়ক বই পড়া ও লেখালেখির কারণে নিজের পাঠ্যপুস্তকের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন তিনি মোটামুটিভাবে একজন সুপরিচিত লেখক। তাই ১৯৫৬ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাদ দিয়ে তিনি পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে গেলেন।
সৈয়দ শামসুল হকের বাবা মারা যাওয়ার পর তার পরিবার অর্থকষ্টে পড়লে চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি ‘মাটির পাহাড়’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেন। পরে ‘তোমার আমার’, ‘শীত বিকেল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘পুরস্কার’সহ আরো বেশ কিছু চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেন। ‘বড় ভাল লোক ছিল’ ও ‘পুরস্কার’ এই দু’টি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান এবং সেখানে বিবিসি বাংলার সংবাদ পাঠক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি পাঠ করেছিলেন, যা তার কাছে অনেক বেশি গৌরবের ও সম্মানের ছিল। পরে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার দৃঢ়কণ্ঠ ও সাবলীল উচ্চারণের জন্য তিনি জনসাধারণের কাছে খুব দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। বিবিসি বাংলায় কাজ করার সময় সৈয়দ শামসুল হক নাট্যকার হিসেবে সফলতা পান ও পরিচিতি লাভ করেন। বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠানে সম্প্রচারিত ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত একটি কাব্য নাটক। তার পরের নাটক ‘নুরুলদীনের সারাজীবন’ ফকির বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত। সেই সময়ে এই দু’টি নাটক সর্বাধিক আলোচিত ও জনপ্রিয় ছিল। এই নাটক দু’টি নাটকীয় মোড় এনে দেয় সৈয়দ শামসুল হকের জীবনে। তার অন্যান্য নাটক ‘নারীগণ’, ‘যুদ্ধ এবং যোদ্ধা’, ‘ঈর্ষা’, ‘এখানে এখন’-এ সমকালীন বাস্তবতা ফুটে উঠেছে এবং তিনি নাটকগুলোর জন্য বেশ প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি যে দিকে হাত দিচ্ছেন, সে দিকেই সফলতা পাচ্ছেন, যা তার কাছে একটা নেশা হয়ে যায়। সেই নেশার টানেই সাহিত্যের সব বিষয়ে সফলতার সাথে হাত বুলিয়ে যান।
সৈয়দ শামসুল হকের কবিতায় রয়েছে গভীর অনুপ্রেরণা। তিনি খুব আশাবাদী ব্যক্তি ছিলেন। যে যুগে মানুষ লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করার চিন্তাভাবনা করে, সেই যুগে তিনি লেখাপড়া পাঠ না চুকিয়ে লেখক হওয়ার মানসিকতা রেখেছিলেন। সেখানেই সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, তিনি কতটা আশাবাদী ব্যক্তি ছিলেন। সেটাই পাওয়া যায় তার কবিতার মধ্যে।
কলাম লেখক হিসেবেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘মার্জিনে মন্তব্য’ নামে একটা কলাম লিখতেন। সেখানে তিনি লেখালেখির কৌশল সম্পর্কে লিখেছিলেন। বিদেশে এ সম্পর্কিত প্রচুর লেখা পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে সেটাই ছিল প্রথম। পরবর্তীতে অনেক লেখক এ থেকে উপকৃত হয়েছিলেন। এ ছাড়া বিচিত্রায় লিখতেন ‘গল্পের কলকব্জা’ শিরোনামে কলাম। পরবর্তীতে নান্দনিক প্রকাশনী থেকে ২০১৪ সালে তার কলাম নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘হৃৎকলমের টানে’। এ ছাড়া তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প লিখেছিলেন, ‘সীমান্তের সিংহাসন’, ‘আনু বড় হয়’, ‘হড়সনের বন্দুক’ প্রভৃতি। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য বেশ কিছু গান লিখেছিলেন। যদিও উনার লেখা গানের সংখ্যা অতি নগণ্য কিন্তু যে ক’টি লিখেছেন, প্রায়গুলো জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমায় অ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটা এতটাই জনপ্রিয় যে বাংলাদেশের কোনো যুগের কোনো মানুষেরই এই গানটি না শোনার কথা নয়। এ ছাড়া ‘আশীর্বাদ’ সিনেমার ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’ গানটিকে ভাবা হয় দেশীয় চলচ্চিত্রের সেরা ১০ রোমান্টিক গানের মাঝে একটি। এগুলো ছাড়াও ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ সিনেমার ‘যার ছায়া পড়েছে’ কিংবা ‘এমন মজা হয় না, গায়ে শোনার গয়না’ শীর্ষক কালজয়ী গানের রচয়িতা সৈয়দ শামসুল হক। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement
‘শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করলে বিজয় অনিবার্য’ কারাগারে নারী হাজতিকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন, প্রধান কারারক্ষীসহ ৩ জনের বদলি প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার হুমকিদাতা গ্রেফতার প্রেম যমুনার ঘাটে বেড়াতে যেয়ে গণধর্ষণের শিকার, গ্রেফতার ৫ ‘ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের সাথে সরকারের এমপি-মন্ত্রী-সুবিধাবাদী আমলারা জড়িত’ ইরানের সাথে ‘উঁচু দরের জুয়া খেলছে’ ইসরাইল! অসুস্থ নেতাকর্মীদের পাশে সালাম-মজনু গলাচিপায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে শিশুর মৃত্যু মসজিদের ভেতর থেকে খাদেমের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার মোরেলগঞ্জে সৎভাইকে কুপিয়ে হত্যা দুবাই পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণ কি কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো?

সকল