২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুকুর

-

করোনা জাপটে ধরেছে দেশের মানুষকে। বর্ষাকাল। আছে বন্যা-জোয়ারের ¯্রােত, নদীভাঙন, মানুষের ঘরবাড়ি বসতভিটা ভেসে যাওয়ার কাল। বর্ষাকাল। যখন তখন নোটিশবিহীন বৃষ্টির পানি পান করে পুকুর ডোবা পথঘাট পোয়াতি নারীর মতো। নদী পাহাড় সবুজ জমি সবকিছুর ওপর প্রকৃতিক নির্যাতনের খড়গ। জীবন থেমে গেছে আরো ছয় মাস আগে থেকেই, থেমে গেছে শিল্প-কলকারখানার চাকা, বিদ্যালয়ের গেট বন্ধ, দোকানের শাটার লাগানো, বাড়ির ফটকে চলছে বাড়ি ভাড়ার নোটিশ লাগানোর হিড়িক তখন এই পথের মোড়ে শুরু হলো নতুন এক বিরক্তিকর উৎপাত।
কোথা থেকে এলো এই কুকুর ? এত বছর হলো এখানে বসবাস, কই আসেনি তো কুকুরের ডাক চিৎকার ঘেউ ঘেউ অবিরাম বিলাপ! রাতের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে ফেলে মধ্য রাতে একনাগাড়ে কুকুরটি ডেকে যায়, কাকে, কেনই বা সে এখান থেকে অন্য কোনো ঠিকানার তালাশ করে না। কেন সে এই স্থানটিকেই বেছে নিলো?
হামিদুল কবির সকাল সকাল বের হয় অফিসের উদ্দেশে। বেশ ক’বছরের সংসারে তার এই নিয়ম ভাঙার কোনো স্মৃতি নেই। টাইমলি অফিস করা এবং টাইমলি ঘরে ফেরাÑ এটাই তার জীবনের প্রধান নিয়ম মনে করে আসছে। সংসারের একমাত্র মেয়ের টেনশনে সে অস্থির থাকে সারাদিন। মেয়েটি বড় হচ্ছে তাকে নিয়ে তার ভাবনার অন্ত নেই। কিন্তু সব নিয়মে বাগড়া বসায় ওই কুকুরটি। কুকুরটি প্রতি রাতে, প্রতি মধ্যরাতেই ওমন একটানা ঘেউ ঘেউ করতে থাকে যে সবারই ঘুম কেটে যায়। ঘেউ ঘেউ শব্দটির মধ্যে কখনো কর্কশ কখনো মোলায়েম কখনো বিরহের সুর টের পাওয়া যায়। হামিদুল কবিরের ঘুম কেটে গেলে আর সারারাত ঘুম আসে না। সে তাই এই মাস তিনেকের জীবনে সঠিক টাইমে অফিসে যাওয়ার অহঙ্কার থেকে সরে আসে। অফিসে দেরি হয়। অফিসের চেয়ারে বসে দুপুরে লাঞ্চের পর এক দম ঘুমিয়ে নেয় অলস শরীরে।
মাঝে মধ্যে হামিদুল কবির উঠে বারান্দায় গিয়ে খেয়াল করে। সে কুকুরটির চিৎকারের ভাষা আবিষ্কারের চেষ্টা করে। আর অনুভব করে কুকুরটি তার কোনো সঙ্গী-সাথীর জন্য বিরহে কাতর। তার কী সংসার ছিল সন্তান ছিল সমাজ ছিল যা থেকে কোনোভাবে বিতাড়িত। কুকুরটি পুরুষ বা নারী জাতীয় কি না এখান থেকে টের পাওয়া যায় না। অনেক অনুরোধ রিপোর্টের পর সিটি করপোরেশনের লোকেরা এসে স্ট্র্রিট লাইট ঠিক করে দিয়ে গেছে। সেই আলোতেও হামিদুল কবির কুকুরটির জেনেটিক পরিচয় বের করতে পারছেন না।
হামিদুল কবিরের স্ত্রী মেজাজ খারাপ করে খিটমিট করতে থাকে। কুকুরটিকে সেও মাঝে মধ্যে অশ্রাব্য শব্দে গালি দেয়। অস্বস্তি প্রকাশ করে। খুব বিরক্তিতে ওয়াশরুমে ঢুকে মাঝে মধ্যে। কিন্তু সে আরো বিরক্ত হয় যখন একদিন হামিদুল কবির স্ত্রীকে বলেনÑ অপেক্ষা করো আর তিনদিন, জাস্ট তিনদিন। কুকুরটি আর ডাকবে না।
Ñকেন, তুমি কী এই মাঝরাতে এটাকে তাড়াতে বের হবে?
Ñনা না। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি প্রবল। তাড়ালেও আবার ঠিকই এসে পড়বে।
Ñতবে কি লাঠিপেটা করবে?
Ñনা তাও করব না।
Ñতাহলে, তাহলে আর কী?
Ñওটাকে বিষ খাইয়ে মারব। জীবনের হিসাব শেষ করব ওর।
Ñএটা করা কী ঠিক হবে। তুুমি না মাঝে মধ্যে বলো ওটার বউ জামাই সন্তান নেই, তাও ওমন বিরহে কাঁদে মধ্যরাতে।
Ñবলি কিন্তু ওর অত্যাচারের মাত্রা অত বেশি যে সবার ঘুম হারাম করেছে। আর কেউ না কেউ এই অত্যাচার থেকে বাঁচার পথ তো বের করবেই। তাই আমিই শুরু করি।
Ñতাহলে তুমি আর কুকুরের পার্থক্য কী। মানুষ আর কুকুরের সংজ্ঞা কী।
Ñএত কথা শোনাচ্ছ কেন। তুমিও তো ঘুমাতে পারো না।
Ñহ্যাঁ পারি না, অনেকেই পারে না। তাই বলে বিষ খাইয়ে একটা অবুঝ প্রাণী মেরে ফেলবে?
Ñআচ্ছা আচ্ছা চুপ করো।
হামিদুলের স্ত্রী তিন দিন শব্দটি নিয়ে মাথা ঘামালেও আসলে কিছুই হয় না। তবে পঞ্চম দিনের রাতে খেয়াল করে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতাকে সত্যি কেউ ভাঙে না। কোনো প্রতিবাদ বিরহ মায়ার কণ্ঠে কুকুর আর ঘেউ ঘেউ করে না। বিষয়টি টের পেয়েই হামিদুল কবিরের স্ত্রী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কুকুরটি ঘুমিয়ে আছে নিথর দেহ নিয়ে। ওটা কী ঘুম না মৃত্যু তা সে ঠাহর করতে পারে না।
সে নিজ কক্ষে ফিরে আসে। ওয়াশরুমের হালকা আলো এসে পড়েছে এই কক্ষে। স্বামীর চেহারা দিকে লক্ষ করে সেÑ কেমন যেন অপরিচিত, অসুন্দর বিদঘুটে-হামিদুল বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। তার নাক ডাকার তীব্র আওয়াজ কুকুরের ওই শব্দের চেয়ে কম নয়। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement