২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমার তরুণবেলা

-

গত সংখ্যার পর

বড় বড় শিমুলের গাছগুলো, কৃষ্ণচূড়ার গাছগুলো কোথায় উধাও হলো। আমাদের চেনা বিশ্ববিদ্যালয় পেছনে ফেলে অন্য একটি বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বছরে। সেই পুকুর নেই, নেই আমতলা, নেই মধুর রেস্তোরাঁ। না, দিনগুলো আর সোনার খাঁচায় বেঁধে রাখা গেল না। এই পথেই যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতারা মিছিল করেছেন, এই ক্যাম্পাসেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিগুলো যে বন্দী।
বিকেল বেলা উদাস মনে আমতলায় বসে কবিতা পড়তাম, কার উদ্দেশ্যে তা শুধু আমার জানা। পড়াশোনায় মন বসত না, কার জন্য তা শুধু আমিই জানি, মওদুদ এসে বলত, লাইব্রেরিতে ঢুকবি না?
আমি বলতাম, আজ আমগাছের তলায়, বকুল তলায় বসে থাকব। তুই যা।
মওদুদ পড়াশোনায় অমনোযোগী। কিন্তু মনোযোগ দিলেই সবাইকে ডিঙ্গিয়ে, এতই তার মনোযোগ। আমি উল্টো। সারাক্ষণ শুধু বই নিয়েই আছি, পড়ার বই নয়, অন্য বই।
আনোয়ারউদ্দিন খান, মিষ্টি গলার শিল্পী আর অর্থনীতির ছাত্র। বন্ধুত্ব হয়ে গেল সাথে সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হারমোনিয়াম পাতা আর তবলাও একজোড়া। যখন আমি গাইতাম সে তবলায়, আর আনোয়ার গাইলে আমি তবলায়। কী যে সুন্দর সুন্দর গান তা বলার নয় :
‘পথে যেতে দেখি আমি যারে
কপালে টিপের যাদু কপোলে ফাগুন
কুন্তলে অমানিশা, হৃদয়ে ফাগুন
আমি মনের মানুষ বলি তারে’
সহপাঠী আখতারির জন্য এই গান। ও শুধু মুখ টিপে হাসত। এ শুধু গানের ও সুরের ভালোবাসা। আর কিছু নয়। আখতারি জলিল এখন পরপারে। সহপাঠিনী বুলবুলও চলে গেছে তার সুন্দর হাসিটি নিয়ে। আমাদের সময়ের বেস্ট স্পোর্টসম্যান : কাজী আবদুল আলিম। বেস্ট অল রাউন্ডার : আসফুদ্দৌলাহ্। তার কৃতিত্ব, সাঁতারে, সঙ্গীতে, বক্তৃতায়, লেখায় ও মেধায়। যাকে বলে চৌকস। সিভিল সার্ভিসে সফলতমদের মধ্যে শীর্ষে: তওফিক ইমাম, মোকাম্মেল হক, আনিসুজ্জামান খান, রাশিদুল হাসান, হাসনাত আবদুল হাই, শামসুল হক খান, হেদায়েতুল হক, এ টি এম শামসুল হক। অনেকের নাম ভুলে গেছি। এরা ছিলেন বলেই দেশটি সফলতার পথে এগিয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার সেহাবউদ্দিন সবার মধ্যে অগ্রণী। কারণ তিনি প্রথম রাষ্ট্রদূত যিনি বাংলাদেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার লেখা আত্মজীবনী একটি অপূর্ব গ্রন্থ। সেহাবউদ্দিন আমার সহপাঠী। ঠিক তেমনি এ টি এম শামসুল হকের আত্মজীবনীতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের চিত্রটি সফলভাবে উপস্থাপিত। তওফিক ইমাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার দলিলগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে লিপিবদ্ধ করেছেন। কবি শামসুর রাহমান, হায়দার আকবর খান রনো, হাসনাত আবদুল হাই, মোরশেদ চৌধুরী ও ড. আনিসুজ্জামান তাদের আত্মজীবনীতে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন উপভোগ্য করে তুলে ধরেছেন। আমিও চেষ্টা করেছি লিখতে ‘জীবন নদীর উজানে’ গ্রন্থে, যতটুকু সম্ভব।
মধুদা সবাইকে ভালোবাসতেন। আমাদের ছাত্রদের ছিল নানা দল। আমি ছিলাম শিক্ষা ও সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি, আর এনায়েতুল্লাহ খান, কখনো জহির রায়হান সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। অর্থাৎ ডান ও বামের দ্বন্দ্ব। মধুদার কাছে সব সমান। আমরা আমতলায় দারুণ বক্তৃতা করতাম। মারামারিও হতো, তবে আস্তিন গোটান পর্যন্তই, দু-চারটে চেয়ার মধুদার দোকান থেকেই নিয়ে এসে ঠাস ঠাস শব্দ করে ভাঙা হতো। ব্যস, মারামারি শেষ। মনকষাকষির অবসান। দু’পক্ষই আবার সেই মধুর দোকানে এসে চা-সিগারেট-সিঙ্গারা ধ্বংস করা।
অধ্যাপকদের মধ্যে কারো ‘ইনপুট’ মনে রাখার মতো নয়, যেন যন্ত্রচালিত মেশিন। প্রথম দশ মিনিট রোলকল [সময়ক্ষেপ] দ্বিতীয় দশ মিনিট তোমরা কেমন আছ, শেষের তিরিশ মিনিট ইতিহাস চর্চা, বেশির ভাগ নোট থেকে, যার কিছুই মনে রাখার মতো নয়। এর মধ্যে যতœ নিয়ে ক্লাসে আসতেন মোহর আলী, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। প্রথম জন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসিত, দ্বিতীয় জন আলবদরের হাতে নিহত। ইতিহাসের প্রধান ড. হালিম বড় পণ্ডিত ছিলেন, তার বক্তৃতায় ছিল না তার প্রতিফলন। তেমনি প্রফেসর আবু সাঈদ, এম এ খায়ের, সন্তোষকুমার ভট্টাচার্য্য। এরা যেমন ছিলেন অমায়িক, তেমনি অতি সাধারণ। ড. আহমদ হাসান দানী প্রতিটি লেকচার তৈরি করে আসতেন। একটাই অসুবিধা, তা হলো ছাত্রছাত্রীরা তার প্রতি কতখানি মনোযোগী তা যাচাই করতেন না। একদিন মুনির চৌধুরীর ক্লাসে গিয়ে বসলাম। কী অপূর্ব বাচনভঙ্গি, ইংরেজি বাংলায় দক্ষতা, যেন একটি অপরূপ স্বর্গীয় পরিবেশে প্রবেশ করেছি। এমনটিই ছিল ইংরেজি অধ্যাপক আবু হেনার ক্লাস।
পরিচয় শতজনের সাথে, বলা উচিত, সহস্রের সাথে। অনেকের কথা বলা হয়নি। যেমন : জাকিউদ্দিন আহমেদ, ব্যবসায়ী, কাজী আনোয়ারুল মেহেদী [জলপাইগুড়ির জমিদার নন্দন পুত্র], গাজী সাহাবউদ্দিন আহমেদ [সচিত্র সন্ধানী সম্পাদক], গ্রুপ ক্যাপ্টেন আশরাফ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আবদুর রহিম, কবি রেজাউল করিম ভূঁইয়া, মাহবুবুর রহমান খান [বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর, প্রয়াত], ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, ড. আবদুল মমিন চৌধুরী, ড. মহসীন, ড. মোকাদ্দেস, ড. এনামুল হক, মীর বেলায়েত হোসেন, নুরুদ্দিন আল মাসুদ, মোহাম্মদ রেয়াসাতউল্লাহ, আসফ খান, হাজার খানেক রোটারিয়ান বন্ধু, বাংলাদেশের প্রতি গ্রামে অন্তত একশত গ্রামীণ কবি ও শিল্পী।
স্মৃতির বারান্দায় বসে। সেখানে ফুটে আছে সুগন্ধবাহী শুভ্র জু্ইঁ, আর তার সাথে অর্ধ শতাব্দীর ‘হিরামন মঞ্জিল’। এই বারান্দায় আগত শত বিদগ্ধ জনের স্পর্শ। তাদের হাসি, চকিত কথা, গান, আবৃত্তি যেন এখনো চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পাই। বাড়িটি, বারান্দাটি পরিত্যক্ত, শত বছরের এই সুরভিত বাসস্থান হয়ত অচিরেই ধসে পড়বে, জায়গা করে দেবে বিশাল অট্টালিকার জন্য ফ্ল্যাট, যেখানে ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে’। হ্যাঁ, ওইখানে ওই একচিলতে বারান্দায় অনেক ইতিহাস বন্দী।
‘জীবন নদীর উজানে’ গ্রন্থে আমার কালের কথা বর্ণিত। পড়লে ভালো লাগবে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement