২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমার তরুণবেলা

-

পেছন ফিরে তাকালেই নিজকে স্পষ্ট দেখতে পাই। আয়নায় চেহারাটি নেই আগের মতো। তারুণ্য বলতেই পাঠকদের আগ্রহ রোমাঞ্চ। লেখকরা রোমাঞ্চের উপলব্ধি সাজান রচিত গল্প উপন্যাসের আড়ালে। মনস্ক পাঠকদের জন্য আমার উপহার, তিনটি তাজা উপন্যাস: ‘হরিণাক্ষি’, ‘পুড়িব একাকী’, ‘কালজানির ঢেউ’। ওখানেই পাওয়া যাবে ভালোবাসার, তারুণ্যের উপাখ্যান। এ বছরের টাটকা উপহার: ‘ভালবাসি, আজ ও কালও’।
ভালোবাসার টানে তবু কিছু বলা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই পথটিতে হারিয়ে যেতে ভালো লাগে, পথের পাশে যেখানে কিংশুক, কৃষ্ণচূড়া সজ্জিত বনবীথি, চিরচেনা আর্টস বিল্ডিং, আমাদের স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়। আমতলা, জামতলা, বকুলতলা, মধুর রেস্তোরাঁ, লাইব্রেরি, লম্বা লম্বা টানা বারান্দা। মেয়েদের রহস্যাবৃত কমনরুম, কলকাকলি মুখরিত সুন্দর সিঁড়ি, অধ্যাপকদের বিশ্রামঘর, পুকুর ঘাটে বিশ্রাম, আর ফুলে ফুলে সুশোভিত পথ।
বারান্দায় রিকশা থেকে নামলাম আমি, সজ্জিত পোশাক, লাইব্রেরিতে ঢোকার জন্য প্রস্তুত।
আবু জোহা নূর মোহাম্মদ কোট টাই পরা লাইব্রেরিয়ান, সহাস্য মুখে বললেন, এত সকালে লাইব্রেরিতে?
বললাম: বিশ্ববিদ্যালয়ের আকর্ষণ তো লাইব্রেরি।
সাহিত্যরসিক উনি। বললেন, জানি জানি, সব জানি। কী বলতে চাইলেন আল্লাহই মালুম।
প্রথমেই পড়তে শুরু করি খবরের কাগজগুলো। ততক্ষণে স্লিপ দিয়েছি বইগুলোর জন্য।
আসার সাথে সাথে বইয়ের পাতায় ডুব।
‘আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’।

মধুর চায়ের দোকানে। চা পানে তেমন উৎসাহ নেই। সিনিয়রদের সাথে নানা আলাপ, সাহিত্য থেকে রাজনীতি, দেশ থেকে বিদেশ। ইব্রাহিম তাহা, সাত্তার ভাই, এ আর ইউসুফ, আমিরুজ্জামান, আখতার আহাদ। এরা সকাল থেকেই মধুর রেস্তোরাঁ আলো করে বসে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কত না কথা বন্দী স্মৃতি কোটরে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পূর্ব দিকের দোতলার বারো নম্বর কামরার আড্ডা। আবু সাঈদ জহুরুল হক সহৃদয় কবি, কাব্য পাঠক ও সংস্কৃতিবান অগ্রজের চারকোণা তক্তপোষের চারপাশে আমরা চারজন: হাসনাত আবদুল হাই [ওর বড় নামটা ছোট করায় আমার অবদান আছে], মুজিবুর রহমান, যার চুল কম থাকায় টাকু নামেই সবাই চিনে, মনসুর আহমেদ [গল্প লেখক] আর রাশিদুল হাসান বীরু। আমাদের প্রধান আকর্ষণ : সাহিত্য। তার সাথে কখনো চীনাবাদাম, চা, নানা ধরনের শৈল্পিক ও শোভন চর্চা, আর কখনো দল বেঁধে খাবার ঘরে গিয়ে খাওয়া। শিল্প ও সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি কখনো আবু সাঈদ জহুরুল হক, কখনো আবু হেনা মুস্তাফা কামাল, কখনো আনোয়ার উদ্দিন খান ও আমি। মাস ভর চলত সাহিত্য সঙ্গীত সভা। জহুরুল হক, আবু হেনা, মুজিব, মনসুর, আনোয়ারউদ্দিন, বিদায় না নিয়েই চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে।

আমাদের দল ছাত্রছাত্রীদের টানত বেশি, কারণ সঙ্গীত শিল্পীরা যেমন, ফেরদৌসী, আঞ্জুমান আরা, সৈয়দ আবদুল হাদী, খন্দকার নুরুল আলম, নজমুল হুদা, আনোয়ারউদ্দিন খান, আমাদের দলে। সংস্কৃতি সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের ভালো ভালো ছাত্রছাত্রীদের সংগঠন। জহির রায়হান, এনায়েতুল্লাহ খান, তারা ছিলেন সভাপতি। তাদের নাট্যানুষ্ঠানগুলো ছিল প্রাণবন্ত। আমাদের ছেলেমেয়েরাও নির্দ্বিধায় সেই নাটকে অংশ নিত। কার্জন হলের বড় হলটি নাট্য নিবেদনে ছিল মুখর। সংস্কৃতি সংসদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ড্রামা সার্কেল এ সময়ই আত্মপ্রকাশ করে। আনিস চৌধুরীর ‘মানচিত্র’ ও মুনির চৌধুরীর ‘কেউ কিসসু বলতে পারে না’ হৃদয়গ্রাহী। সতীর্থ জুলেখা হক মানচিত্রে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করে। মওদুদ আহমদ, জহরত আরা, সৈয়দা রওশন, বিভিন্ন নাটকে অভিনয় করে। প্রথম অভিনয় কার্জন হলে তুলসি লাহিড়ির ‘ছেঁড়াতার’। অভিনয়ে মূল চরিত্রে তুলসি লাহিড়ি, লায়লা সামাদ, পিতা আব্বাসউিদ্দন, কৌতুক অভিনেতা সাইফুদ্দিন, চাচা আবদুল করিম ও আমি। আমার চরিত্রটি নির্বাক ঢুলির অভিনয়, সাইফুদ্দিনের সহযোগী। কার্জন হলে আরো কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন ভাই, চাচা ও আমি।

কার্জন হলটি বর্তমানে নাট্যচর্চার জন্য পরিত্যক্ত। পাশ দিয়ে গেলে নাটকের সংলাপগুলো অতীতে ফিরিয়ে নেয়। বন্ধু ইকবাল আনসারি খান, মকসুদুস সালেহীন, বজলুল করিম, শাহ আলী হোসেন বেঁচে নেই। বেঁচে: দীন মোহাম্মদ খান, মুনিরা খান, মুস্তাফা মনোয়ার। ঢাকার নাট্য অঙ্গনের পথিকৃত ড্রামা সার্কেলও আর নেই। এদের সবচেয়ে সুন্দর পরিবেশনা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’। সৈয়দা রওশনের অভিনয় মনে রাখার মতো, তেমনি হাসান ইমামও। আমরা প্রথম দিককার নাট্য অভিনেতা। সলিমুল্লাহ হলে ‘দ্বীপান্তর’ নাটকে অভিনয় করেছি। প্রথম পুরস্কার মওদুদ আহমদই পেয়েছিল, আমি পেলাম স্বয়ং নাট্যকার তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়ের সান্নিধ্য ও স্বীকৃতি। কাগমারী কনফারেন্সে যাওয়ার পথে তাকে তারাচরণের গাওয়া গানটি গেয়ে শুনাই: ‘না মিটিল সাধ সখি, না মিটিল আশা’। গানটি সলিমুল্লাহ হলে যখন গাই, তারাচরণের কবিয়াল চরিত্রটি যেন মূর্ত হয়ে ওঠে। শেষ দৃশ্যে যখন আমাকে বধ করা হয় তখন ‘মা’ বলে যে আর্তনাদ করে উঠি তাতে আমার মা লুৎফুন্নেসা শ্রোতাদের মধ্যেই বসেছিলেন। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এখানেই আমার স্বার্থকতা। সৈয়দা রওশন আমার নায়িকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক ক্লাস উপরের ছাত্রী। তার ছোট বোন সৈয়দা জাহানারা লাইজু ভালো নৃত্যশিল্পী।
মনে পড়ছে নুরুল আলমের কথা। সে হয়তো বন বিভাগের বড় কর্মকর্তা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি। তার একটি ট্রাউজার ছিল, কালো রঙের উর্স্টেড। ঠাণ্ডা পড়লেই অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে সে প্যান্টটি বের করত। সারা বছর তার ওই কালো প্যান্টটি আমাদের দৃষ্টির সামনেই থাকত। দুষ্টুমি করে বলতাম : ‘আলমের প্যান্টটি নামিয়েছে রে’! চার বছর ধরে এই প্যান্টটি প্রত্যক্ষ করেছি।
ছাত্রনেতা রফিকুল্লাহ চৌধুরী ইতিহাসের ছাত্র। তার নোটগুলো আমার কাছে। সিএসপি হওয়ার পর কক্সবাজারে প্রথম পোস্টিং। সেখানকার সবেধন নীলমণি সমুদ্রের ধারে রেস্ট হাউজটি এখন আর নেই। যেখানে বিরাট পার্টি আমার ও আসমার অনারে। পরে বঙ্গবন্ধুর প্রধান কর্মকর্তা হয়েছিলেন। তার মেয়ে এখন স্পিকার। তার বন্ধু মোহাম্মদ মহসীন ফরেন সার্ভিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ পান।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের টেনিস কোর্টে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হেলিকপ্টারে অবতরণ একটি স্মরণীয় ঘটনা। হলের ইলেকশনে যে ক’জন বাগ্মীর কথা মনে পড়ে তারা হলেন : আবুল মাল আবদুল মুহীত, এ টি এম শামসুল হক, মিজানুর রহমান শেলী, নুরুদ্দীন আল মাসুদ। খাওয়া দাওয়া খুবই সাধারণ। মাসে একদিন ফিস্ট হতো। সেই দিন ভালো খাওয়া জুটত। একটি বাটিতে মাছের টুকরো অথবা গোশতের হাড্ডি সাথে বালতি ভরা তরল ডাল। এই ছিল সাধারণ খাওয়া। ছাত্ররা পেট না ভরায় সামনের একটি ডালভাতের দোকানে [সেলিমের দোকান] গিয়ে আবার খেতে বসত। অভুক্ত বন্ধুদের এ অবস্থা দেখে খুব মায়া হতো। আমরাও বাড়িতে খুব একটা বড়লোকির মধ্যে ছিলাম তা নয়, খুবই সাধারণ। তবু এদের চেয়ে রাজকীয়। বন্ধুরা আমাদের বাড়িতে ‘আমাদের সাহিত্যের আসরে’ গান গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ভালো চা নাশতা পেত।
বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়


আরো সংবাদ



premium cement