২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

চার দেয়ালের যত্তসব

-

লেকচার টেবিলে দাঁড়ালেইÑ সবুজ রঙের যে দেয়ালটির মুখোমুখি হতে হয়। আন্দাজ, তার নাক বরাবর লেখাÑ আবরার হত্যার বিচার চাই, তবে বিশ্বজিতের মতোন নয়। নিরাপদ সড়ক চাই। অ্যাম্বুলেন্সকে সাইড দিন। ধুর! শালা, সাইকেল যাওয়ার রাস্তা নাই, আর অ্যাম্বুলেন্সের সাইড চাস? তার নিচের লেখাটিÑ আমি কি কাউকে গালি দিয়েছি, কারো বিরুদ্ধে বলেছি। চা খাবেন? ঢেলে দিই, দিইÑ তাহেরী আঙ্কেল। মিস ইউ তৃষা। মাই লাভ। নাম বললে চাকরি থাকবে না... এ লাইনের নিচ থেকে লম্বা একটা দাগ একেবারে ফ্লোরে গিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়েছে। ডিম ফাটানোর দাগ। গণিত স্যারের বদল চাই, দিতে হবে, দিতে হবে... মাননীয় স্পিকার, বাংলাদেশের সকল ক্লাস থেকে গণিত সাবজেকটি তুলে নেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি, মাননীয় স্পিকার... বাহুবলী টু- কাটাপ্পা, তুম গ্রেট হো।
ডান দিকের দেয়ালে বসানো একটি সুইচ বোর্ড। যাতে একটা সুইচও অক্ষত নেই। বোর্ড না থাকাতে জট পাকানো লাল ও কালো রঙের বৈদ্যুতিক তারগুলো বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। ভাল্ব কিংবা ফ্যান কোনোটির সুইচই তাদের হাত থেকে রেহায় পায়নি। সবগুলো ভেঙে তলিয়ে দেয়া হয়েছেÑ বোর্ডের গর্তের ভেতরে। দু’টি সুইচ ঝুলে আছে বাইরের দিকে। ওই সুইচ দু’টিই হয়তো মাথার ওপরের এই ফ্যান চারটিকে ঘোরাচ্ছে। ফ্যান দু’টির গায়েও কী কী সব লেখা কিন্তু গতির কারণে সেই লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না।
সাইফ আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বের হয়েছে গত বছর। অনার্সের পর থেকে হন্যে হয়ে সে একটা চাকরি খুঁজছে। পরিচিত কাউকে বলতে বাদ রাখেনি। কিন্তু কোথাও কোনো চাকরির ব্যবস্থা হয়নি। মনে মনে সে কোনো একটা পত্রিকাতে ঢুকতে চায়। প্রতিদিন তার আঁকা কার্টুনগুলো সারা দেশের মানুষ দেখবে। দেশের মানুষের ক্ষোভ-খেদ, অপ্রাপ্তি-হতাশা, মানুষের না বলতে পারা সব কথা সে এঁকে যাবে তার রঙতুলিতে। কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব, শিশির ভট্টাচার্য এবং মোরশেদ মিশু তারা তার স্বপ্নের মানুষ। কার্টুন তার স্বপ্নÑ তার প্রতিবাদের ভাষা। এর মধ্যে তার কিছু কাজ এখানে-সেখানে ছাপা হয়েছে। অনিয়মিত কিছু সাহিত্য পত্রিকার প্রচ্ছদের কাজ সে করেছে। গত বইমেলায় সে তিনটি বইয়ের কাজও করেছে। কিন্তু এ কাজে সে স্থায়ী একটা অবস্থান চায়। তবে পত্রিকা হাউজগুলোর বর্তমান যা অবস্থা তাতে সহজে তার স্বপ্ন পূরণ হবে এমন আশা করা কঠিন। পত্রিকার হাউজ বেড়েছেÑ বাড়ছেও প্রতিদিন। কিন্তু তারা যেন টাকা দিয়ে কোনো লোক রাখতে চাচ্ছে না। তবে কোনোভাবে একটাতে ঢুকতে পারলেÑ পরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া যাবে। সে কাজ করে যাচ্ছে। ঢাকাতে টিকে থাকার উপায় হিসেবে গত সপ্তাহে সে এই স্কুলটিতে ঢুকেছে। এই চাকরিটাও হয়েছে তাদের একজন টিচারের অনুরোধের জোরে। এখানে সে প্লে গ্রুপ থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত শিশুদের আর্ট শেখাচ্ছে। আজ সকালে শাখাপ্রধান তাকে পূর্ণ নামে ডাক দিলে সে উঠে দাঁড়িয়ে প্রক্সির কুপনটি হাতে নিলো। শাখাপ্রধান তাকে বলল, টেন, সেকশন বি-টু। বয়েজ বিল্ডিংয়ের ৪০৩ নম্বর রুম। জীববিজ্ঞানÑ অসুবিধা নাই তো? সাইফ আলি বলল, না স্যার। সাইফ আলিই বোধ হয় একমাত্র শিক্ষক যে, মনের থেকে বলল, না স্যার কোনো অসুবিধা নেই। তা ছাড়া যাদের প্রক্সি দেয়া হয়Ñ তারা কুপনটি হাতে ধরলেও সবাই ভেতরে ভেতরে নারাজ। আজকে সকালেও শাখাপ্রধান বলছিল, আমরা সবাই এক মিনিট সাইলেন্ট থাকি। আমাদের যাদের ৮টা তিরিশে ক্লাস ছিল। তারা ক্লাসে আসি। তাদের উচিত ছিল ক্লাসে চলে যাওয়া। আমাদের যাদের প্রথম পিরিয়ড আছে, তারা জাতীয় সঙ্গীতের আগেই ক্লাসে যাবেন এবং কোনো রুমে যদি সাউন্ডবক্স কাজ না করেÑ তা হলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। আর আজকে যাদের প্রক্সি ক্লাস আছে, প্রথমেই বলে রাখি। এ বছর রুটিনের অবস্থা এমন যে কারো সাথে আমার তর্কাতর্কি, এমনকি তার থেকেও বেশি কিছু হয়ে যেতে পারে। তবে এ বিষয়ে আমাদের সব শাখাপ্রধানের চেয়ারম্যান স্যারের আলাপ হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে একটি কমিটি করে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। তবে সে জন্য আমাদের সামনের জেনারেল মিটিং পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর একটা বিষয় যারা ছুটিতে আছেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, তারা পর কেউ নয়। আমাদেরই এক ভাই। আজ উনি নেই। কাল আপনিও না থাকতে পারেন। তা ছাড়া আমাদের সমস্যাগুলো তো আমাদের নিজেদেরই সমাধান করতে হবে তাই না। এতে সিনিয়র টিচারদের দু-একজন প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাদের কাছে এ মুহূর্তে এ সমস্যা সমাধানের উপায় জানতে চাচ্ছি। আপনারা কেউ ছুটি নিয়েন না, আমার প্রক্সি লেখা লাগবে না। আমারও সুবিধা হয়। সবাইকে ধন্যবাদÑ বলে তিনি যার যার প্রক্সির কুপনটি পৌঁছে দিতে শুরু করলেন। ঘাপটি মেরে বসে থাকা শিক্ষকরা শাখাপ্রধানের মুখে নিজের পূর্ণ নাম শুনেই চমকে উঠে বলছেন, জি স্যার এবং হাত পেতে নিচ্ছে প্রক্সির কুপনটি। কারো হয়তো টানা চারটা ক্লাস। তার পর একটা পিরিয়ড ফাঁকা। সাথে পঞ্চাশ মিনিটের লাঞ্চ বিরতি। তার পর আবার টানা দুইটা ক্লাস। লাঞ্চের আগের এই ফাঁকে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে একটা প্রক্সি।
এই প্রথম তাকে বড়দের ক্লাসে একটি ক্লাস দেয়া হলো। প্রক্সির কুপনটি হাতে পেয়ে তাকে বেশ ভালো লাগছে। এই এক সপ্তাহে সে ছোটোদের ক্লাসগুলোতে ছিল। শিশুদের সাথে তার ভালোই লাগে। প্লে গ্রুপের একটা শিশু। আরব নাম। ওই শিশু প্রথম দিনই ঝাঁপ দিয়ে তার কোলে উঠেছিল। শিশুটির দাবি, এ ম্যাম আসছা নাহি, ও মুজে ডাটতি কিউ? কিন্তু তাদের মায়েদের নিজেদের মধ্যে ফাস্ট হওয়ার কম্পিটিশনের ব্যাপারটি ভীষণ ভাবাচ্ছে। কেন তার মেয়েটিকে পেছনের বেঞ্চে বসানো হলো বা কেন অমুকের ছেলের বা মেয়েটির পাশে তার মেয়েকে বসানো হলোÑ এ রকম বিষয় নিয়েও গার্ডিয়ানদের মধ্যে বিরোধ বাধে। আর বার্ষিক পরীক্ষার পর তাদের মধ্যকার বিরোধ মেটাতে নাকি সরাসরি প্রিন্সিপাল স্যারকে সালিস করতে হয়। এত দিন সে কেবলি এগুলো শুনেছিল। অবশ্য এর আগে সে এ রকম একটা টিউশনি পেয়েছিল। তাদের শিশুকেও তারা ক্লাসে কেবলি প্রথম দেখতে চাইত।
ক্লাসরুমে প্রবেশ মুহূর্তে রুমভর্তি শিক্ষার্থীদের অনেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল। চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে আছে। তারা উঠে দাঁড়ায়নি। তারা কী বিষয়ে গল্প করছেÑ লেকচার টেবিলের এ পাশে দাঁড়িয়ে তা আন্দাজ করা যাচ্ছে না । তবে বিষয়টি যে তাদের কাছে ভীষণ মজারÑ অন্তত এটা নিশ্চিত। তাদের সবার মুখই সদ্য ফোটা ফুলের মতোন হাসিতে ঝলঝল করছে। ভীষণই সবল আর স্বতঃস্ফূর্ত সেই হাসির ঝলক। এবং আরো তিনজন শিক্ষার্থী হেড ডাউন করে আছে। তারা দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে তাদের মাথার নিচের ব্যাগগুলোকে। এ ব্যাগগুলো কিছুটা হলেও তাদের বালিসের ঘাটতি মেটাতে সহায়তা করেছে। তারাও উঠে দাঁড়ায়নি। তাদের কেউ হয়তো এতক্ষণে ডুবে গেছে ঘুমের অতল সাগরে। ট্রেনিংয়ে সাইফ আলিদের বলা হয়েছিল এ ধরনের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে। তাদের মা-বাবা দু’জনেই হয়তো চাকরি বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। এ কারণে মা-বাবা তাদের সময় দিতে পারে না। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশের বাসাতে ল্যাপটপ বা স্মার্টফোন আছে। রাতভর ফেসবুক চালায় অথবা গেমিং করে। আর সকালে স্কুলে এসে তাদের মধ্যে কেউ ঝিমায়, আবার কেউ কেউ ঘুমায়। আর নানান অজুহাত দেখিয়ে বাইরে যেতে চায়। নতুন টিচারকে তারা বেশি বিরক্ত করে। সাইফ আলি, হেড ডাউন করে থাকা এক শিক্ষার্থীর পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করল, এই ছেলে এর কী হয়েছে? হেড ডাউন করে আছে কেন? ছেলেটি বেশ লম্বা-চওড়া। সে উঠে দাঁড়িয়ে খুবই নরম স্বরে বলল, ও স্যার ওর না ভীষণ মাথাব্যথা। মাথা উঠাতে পারছে না। আগের ক্লাসেও এভাবে ছিল। মলয় স্যার তাকে অনুমতি দিয়ে গেছেন। ওই শিক্ষার্থীর কথা শুনেÑ সাইফ আলি কিছুটা ঘাবড়ে গেল। সাইফ আলি এ ব্যাপারে আর কিছু বলল না। সে তার লেকচার টেবিলের কাছে ফিরে যেতেই বামদিকের প্রথম বেঞ্চের একজন শিক্ষার্থী তাকে উদ্দেশ করে বলল, স্যার আপনি নতুন নাকি অন্য ব্রাঞ্চে ছিলেন? এই ছেলেটিকে তার যথেষ্ট ভদ্র মনে হলো। সে সবার উদ্দেশে বলল, আচ্ছা, এবার আমরা একটু চুপ করি। সবাই কথা বললে, কারোটাই তো শোনা যাবে না, তাই না। সবাই থামেনি। সাইফ আলি বলল, আমি নতুন টিচার। আমার গ্রাম ময়মনসিংহের ফুলপুরে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর মাস্টার্স শেষ করে বের হয়েছি। তোমাদের স্কুলে জয়েন করেছিÑ এই গত সপ্তাহে। আমি শিশুদের আর্ট শেখাই। আজকে তোমাদের জীববিজ্ঞানের স্যার ছুটিতে তাই আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। তবে আমার বেসিক যেহেতু সাইন্স ছিল। তাই আমি স্যারের মতোন না হলেও ক্লাসটা নিয়ে তোমার সাথে কিছুটা আলোচনা করতে পারি। এবার পেছনের দিক থেকে একজন সটান দাঁড়িয়ে বলল, ইয়েস স্যার, আমার বাড়িও কিন্তু ময়মনসিংহে। তবে ফুলপুরে না, হালুয়াঘাটÑ ওই কড়ইতলী কয়লার বন্দরের কাছে। সাইফ আলি তার কাছে এগিয়ে বলল, আচ্ছা পরে তোমার সাথে কথা হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দশজনও সাইফ আলির কথা শোনেনি। মোট কত শিক্ষার্থী তা দেখার জন্য সাইফ আলি বোর্ডের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বোর্ডের এক সাইডে পার্মান্টেট মার্কার দিয়ে লেখা, এখানে চাপা মারা নিষেধ। এ সেকশনে মোর্ট শিক্ষার্থী ৩৫ জনÑ তার মধ্যে ৩৩ জনই উপস্থিত। সাইফ আলি আবারো পেছন দিকে ঘুরতে ঘুরতে অনেকে এককণ্ঠে বলে উঠল, আল্লাহু আকবার। সে পেছন বুঝতে পারল নাÑ কারা এগুলো করছে! শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এখন কাগজ মুড়িয়ে কাগজের বুলেট বানাচ্ছে। কেউ আবার রাবারে টেনে সেই বুলেটে আহত করছে কাউকে। আহত জনও ছাড় দেয়ার পাত্র নয়Ñ সেও কাগজে বুলেট ছুড়ছে তার যাকে সন্দেহ হচ্ছে তাকে। দুই-তিনজন ছেলে রিং চিপস খাচ্ছে। সাইফ আলি ক্লাসের কন্টোল নিতে তার গলাটা একটু চওড়া করে বলল, আচ্ছা সামনে তোমাদের এসএসসি ফাইনাল। আর তো বেশি সময় নেই। এমন করলেÑ তোমরা পাস করবে কেমন করে? অনেকেই একসাথে বলল, কেন স্যার...? জেএসসি তো কথা কয়য়াই পাস করছি। এইবারও ব্যবস্থা কিছু একটা হইয়া যাইব। প্রতিষ্ঠান থেকে কোন না কোন ব্যবস্থা করে দেবে। স্যার জানেন, আমাদের রেজাল্ট কিন্তু খারাপ না। তাদের ইঙ্গিত স্পষ্ট, তারা হয়তো পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্র পাওয়ার আশা করছে অথবা ভাবছে পরীক্ষার হলে কোনো সুবিধা পাবে। আর বোর্ড থেকে কড়াকড়ি নির্দেশনা হচ্ছে, পরীক্ষার্থীদের নিজ সন্তানের মতো দেখবেন। কাউকে ফেল করানোর মানসিকতা নিয়ে খাতা মূল্যায়ন করবেন না। সাইফ আলি শুনেছে, কেউ ফেল করলে, তার ব্যাপারে নাকি বোর্ডে রীতিমতো কৈয়ফত দিতে হয়। প্রতি বছর পাসের হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতাতে এদের বলি দেয়া হচ্ছে। আর বলির আগে তাদের গলাতে সিল-মোহর অঙ্কিত যেই রঙিন কাগজের মালাটি পরানো হচ্ছেÑ তাতেই এরা যারপরনাই খুশি।
ক্লাসের পেছনের দিক থেকে কুকুরের ডাক ভেসে এলো। কিন্তু কে এই ডাক দিচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছে না। এরপর ভেসে এলোÑ বেড়ালের ও ছাগলের ডাক। সাইফ আলি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে গ্রামের স্কুল-কলেজে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল। এই ছেলেদেরকে সে বুঝে উঠতে পারছে না।
সাইফ আলি তার হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখল, এখনো ক্লাসের সময়ের পঁচিশ মিনিট বাকি। এতক্ষণ সময় সে কিভাবে পার করবে? এর মধ্যে দু’জন সহকর্মীসহ হেড স্যার এই ক্লাসে আসলেন। তিনি আসার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল। যারা গল্প করছিল তারাও। যারা হেড ডাউন করেছিল তারাও। হেড স্যারকে সাইফ আলি তার ডেমো ক্লাসের দিন দেখেন আর এই আজ দেখছেন। তিনি বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী পড়াচ্ছেন স্যার? পাঠের শিরোনাম লিখেন নাই। সতর্ক থাকবেন স্যার, এই প্রতিষ্ঠান ঢাকা বোর্ডে ফাস্ট হয়েছে। গত চার বছরে কোনো পাবলিক পরীক্ষাতে আমাদের একজন শিশুও ফেল করে নাই। আমরা এখন ঢাকার ব্র্যান্ড। সাইফ আলি শুধু মাথা নিচু করে কথাগুলো শুনলেন। হেড স্যার এ বিষয়ে আর কিছু বললেন না। তবে তিনি ঘুরে ঘুরে ক্লাসরুমটি দেখতে লাগলেন। তার সাথে সাথে ওই দুইজন সহকারী শিক্ষকও ঘুরতে লাগলেন। তাদের দেখে সাইফ আলিও তাদের পেছন পেছন ঘুরতে লাগল।
সামনের রোববারে স্কুলে শিক্ষা অফিসার আসবে, হাতে সময় আজকের দিনটিসহ মোটেই আট দিন। কিন্তু স্কুলের ক্লাসরুমের দরজা ও দেয়ালের যা অবস্থা, কোনো সভ্য মানুষ এ দিকে তাকাতে পারবে না। তাকালেও লজ্জায় মরে যাবে। আর শিক্ষা অফিসার মহাদয় তো একজন মেয়ে মানুষ। তিনি নতুন এসেছেন, শোনা যাচ্ছে তিনি খুবই কড়া মানুষ। গালর্স বিল্ডিংয়ের কী অবস্থা। ও বিল্ডিংয়ের ওয়াসরুমসহ সব জায়গা খুঁটিয়ে দেখা দরকার। মাত্র তিন মাস আগেইÑ বিল্ডিং মালিক পুরো স্কুলটি রঙ করে দিয়েছে। তার সাথে শর্ত মোতাবেক তিনি বছরে একবার পুরো বিল্ডিং রঙ করিয়ে দেবেন। আর বেশি লাগলে, তার খরচাদি স্কুলকে দিতে হবে। এই অবস্থাতে রঙ না করিয়ে তো আর উপায় নেই।
হেড স্যারের সাথে এসেছেনÑ তার ঘনিষ্ঠ দু’জন সহকর্মী। তাদের একজন আনোয়ার উদ্দিন শাহ, গণিতের শিক্ষক। আনোয়ার উদ্দিন শাহ হেড স্যারকে উদ্দেশ করে বললেন, স্যার, রঙ করানোর আগে গার্ডিয়ানদের ডেকে আগে দেখানো দরকার। কার গার্ডিয়ানকে ডাকবেন? এগুলো সব আবাসিকের ছেলেদের কাজ। ক্লাস চলাকালীন সময়ে তো কেউ এগুলো লিখতে পারবে না। ছুটির পরে এ কাজগুলো করে। গালর্স ও বয়েজ দুই বিল্ডিং মিলিয়ে চার শ’ সাতাশি জন ছেলে, আপনি কাকে ধরবেন? প্রশ্নগুলো আনোয়ার উদ্দিন শাহকে করে বসলেন আরেকজন সহকারী শিক্ষক লোকমান হোসেন। আনোয়ার উদ্দিন শাহ বলল, কেন সিসিটিভি ক্যামেরা চেক করলেই সব পাওয়া যাবে। এর জবাবে হেড স্যার বললেন, সিসিটিভি ক্যামেরার তার কেটে দিয়েছে, গত এক সপ্তাহে তিনবার। সাউন্ডবক্সের তারও কেটে দিয়েছে।
হেড স্যার দেয়ালের দিকে তাকাতে তাকাতে এই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গেলেন। হেড স্যার আর্মিতে ছিলেন, অবসরগ্রহণের পর এই স্কুলে জয়েন করেছেন। সার্মথ্যবান গার্ডিয়ানদের কাছে এ স্কুলের ডিমান্ড রয়েছে। ছেলেরা এতক্ষণ ক্লাসে ছিল বলে মনেই হচ্ছিল না। এখন তারা আবার মুখ খুলতে শুরু করেছে। সাইফ আলি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ক্লাসের সময় আছে আর মাত্র চার মিনিট। সে কিছু বলার চেষ্টা করল, তবে পারল না। নির্বাক সাইফ আলি মনে মনে ভাবল, আগুনের দোষ কী? যদি পুড়িয়ে দেয় সব কিছু, দোষ আমাদের, আমরা তাকে বন্দী করতে পারিনি লোহার খাঁচায়Ñ যেখানে রেখে তাকে শাসন করা যেত। তার কাছ থেকে আদায় করা যেত পর্যাপ্ত আলো ও তাপ...! তাদের মধ্যেই তো কেউ একজন সব লেখাগুলোর ওপরে উঠে লেখে রেখেছেÑ আবরার হত্যার বিচার চাই, তবে বিশ্বজিতের মতোন নয়।
আগামীকালই হয়তো এই লেখাগুলো ঢাকা পড়ে যাবে নতুন রঙের আড়ালে। কিন্তু আজেবাজে এইসব দেয়াল লিখন আর অরুচিকর-বিশ্রী ওই অঙ্কনগুলোই তো তাদের এক একজনের মনের দেয়াল। ক্লাসরুমের এই দেয়ালে তা প্রতিবিম্বিত হয়েছিল মাত্র। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement