২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফুলের আনন্দ

-

জন্মের পর জীবনের ঠিক কোন মুহূর্তে প্রথম ফুল দেখেছিলাম, কখন ফুল দেখে হেসেছিলাম, কখন ফুলকে ফুল বলে চিনেছিলাম, তার কিছুই মনে নেই। বুদ্ধি হওয়ার পর আমাদের ঘরের সামনে ফুলের বাগান করতে দেখেছি আমার ছোটচাচাকে। তার সাথে আমিও বাগানের ঘাস বাছতাম, ফুলগাছের গোড়ায় পানি দিতাম, বাগিচার পরিচর্যা করতাম। কোনো ফুলের গাঢ় উজ্জ্বল বর্ণ আমাকে অবাক করে দিতো! অন্যগুলোর মিশ্রিত সুবাস নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে বুকে টেনে নিতাম, খুশবুতে মাতোয়ারা হয়ে যেতাম! এভাবে কখন যে ফুলকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছিলাম, তার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। খালি যে ফুলই আমার ভালো লাগত তাই নয়, ফুলবাগানের সব অতিথিও ছিল সমানভাবে আমার মায়া-মমতার পাত্র। এখানে অতিথি বলতে আমি বোঝাচ্ছিÑ পোকামাকড়, মৌমাছি, প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি প্রভৃতিকে। আমরা যেমন ফুলের সুবাস ও সৌন্দর্যে বিভোর হই, আল্লাহর মাখলুক কীট-পতঙ্গরাও হয়।
এই সেই ফুল, যা আমার জীবনে বারবার এসেছে, ঘুরেফিরে এসেছে, বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে। কখনো দূর থেকে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছে, কখনো কাছে এসে হৃদয়-মনে দোলা দিয়েছে, বোধশক্তিকে জাগ্রত করেছে, অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। আবার কখনো আমি নিজেই ফুল নিয়ে খেলেছি, মাখামাখি করেছি, ভুল করে ফুল ছিঁড়েছি, ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি, গলায় পরেছি, আবার ফেলেও দিয়েছি, তবু কারো কণ্ঠে তুলে দেইনি, অথবা দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাইনি। এ ব্যাপারে যা খুশি তাই ভাবতে পারেন। দীর্ঘ জীবনে ফুলের সাথে আমার আত্মীয়তা, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি একেকবার একেক রকম হয়েছে। তাদের কোনো একটার সাথে আরেকটার মিল পাওয়া যায় না। আজ বয়সের শেষবেলা এসে আমি সেসবের একটা খতিয়ান নেয়ার চেষ্টা করছি। দেখছি, তাদের মাঝে কোনো অর্থবহ যোগসূত্র বের করা যায় কি না। যদি যায় তো ভালো, না গেলেও অসুবিধা নেই। জীবনে অনেক কিছু করতে গিয়েই তো ব্যর্থ হয়েছিÑ এ আর গোপন করে লাভ কী?
ফুল দিয়ে ঘর সাজানোর প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছে পাঠশালায় থাকতে। যে দিন পূজার ছুটি হতো সে দিন দেয়ালবিহীন, দুয়ার-ভাঙা, হেলেপড়া ইসকুলঘর খুব যতœ করে ফুল দিয়ে সাজাতাম। মাস্টার বাবু আসার আগেই এ কাজটা করতে হতো, আর তাই ওই দিন ইসকুলে যেতে হতো সকাল সকাল। এখন নিজেকে যখন প্রশ্ন করি, ছুটির দিন ফুল দিয়ে কেন ইসকুল সাজাতাম, তার কোনো উত্তর পাই না।
বাড়ির ঠিক সামনে মরা ধামাই গাঙের তীরে ছিল তিন জাতের বড় বড় তিনটি ফুলের গাছ। এদের একেকটা আমার জীবনকে একেকভাবে আবেগাপ্লুত করত। প্রথমটি কদম। কদম ফুল মানেই বর্ষার আগমনী বার্তা। গাছে যখন ফুল ফুটত ঠিক তখনই ধামাই গাঙও ফুটত, অর্থাৎ নদীর পানিতে স্রোত বইত এবং নাও চলাচল শুরু হতো। ওই কদম গাছের গোড়ায়ই বাঁধা থাকত আমাদের নৌকাগুলো। গাছ বেয়ে উঠতে পারতাম না, তাই নাওয়ের লগি দিয়ে কদম ফুল পাড়তাম। একটা ফুল হাতে তুলে ঘ্রাণ নিতে অনেকগুলো তাজা সবুজ পাতাকে ছিন্নভিন্ন করতে হতো, বিষয়টি এখন যেভাবে বুঝি, তখন সেভাবে মাথায় আসত না। কদম ফুলের সাদা সাদা লম্বা লম্বা চিকন কাঁটার মাথায় ফুলের রেণু থাকত, সেগুলো হাতে, গায়ে ও মুখে মাখতাম। হলুদ ফুলদল ছিঁড়ে জমা করতাম, দোকান দিতাম, কেনাবেচা খেলা খেলতাম। সেমাই দানার মতো সাদা সাদা পাপড়িকে বানাতাম চিনি আর হলুদগুলো হতো গুড়। চিনি চড়া দামে বিক্রি হতো, আর গুড় সস্তায়। তার মানে তখন বুদ্ধিসুদ্ধি কিছু হয়ে গেছে; কেননা চিনি আর গুড়ের দামের তফাতটা বুঝে গেছি। দোকানের খদ্দের ছিল ছোট ভাই এবং ঘরের কাজের ছেলেটা, মাঝে মধ্যে প্রতিবেশী সমবয়সী দুই ভাই জলিল-খালিকও এ খেলায় এসে যোগ দিত। মূর্তাপাতা ছিল আমাদের মুদ্রাÑ কেনাবেচার মাধ্যম।
কদম গাছের পাশেই ছিল একটা বড় সোনালু ফুলের গাছ। বছরের ঠিক কোন সময় সোনালু ফুল ফুটত তা এখন মনে নেই, কিন্তু যখন ফুল ফুটত তখন কড়া হলুদ রঙে গাঙের পাড় রঙিন হয়ে উঠত। স্কুল থেকে আসার সময় দূর থেকে দেখলে মনে হতো সোনালু ফুলের গা থেকে বিচ্ছুরিত হলুদ আলোর আভায় গোটা বাড়ি যেন ঝলমল করছে। সোনালু ফুলের পাতলা নরম পাপড়িগুলো মাটিতে পড়ে হলুদবর্ণে গাছগুলো একেবারে একাকার হয়ে যেত! গাঙের ধারে পুকুরপাড়ের ওই জায়গাটা খুব ভালো ছিল না। ময়লা-নোঙরা ছিল, গরু-ছাগল ঘাস খেত, গ্রামের মানুষজন গাঙের দিকে মুখ করে মলমূত্রও ত্যাগ করত। এমন ময়লা জায়গায় সোনালু ফুলের পূতপবিত্র রঙিন পাপড়িগুলো পড়ে থাকতে দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হতো! ভাবতাম, ওই নোংরা মাটিতে পরিষ্কার বিছানার চাদর বিছিয়ে সোনালু ফুলের জন্য জায়গা করে দিলে কেমন হয়!
উত্তর দিকে একটু দূরে ছিল বড় ও উঁচু এক শিমুল গাছ। বসন্তের শুরুতে যখন ওই গাছে ফুল ফুটত আর তার ডালে ডালে পাখির মেলা বসত, তখন সেখানে জন্ম নিত এক উৎসবমুখর পরিবেশের। শিমুল গাছের তলায় গেলে আমার ভীষণ ভালো লাগত, গাছতলা থেকে ঘরে ফিরে আসতে ইচ্ছা করত না। মনে হতো যেন বিয়ে বাড়ির আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে শিমুলতলায়। গাছের নিচে হাঁটতে গেলে পা ফেলার জায়গা পাওয়া যেত না, মাটিতে বড় বড় শিমুল ফুল ঝরে পড়ে থাকত। কোনোটা তাজাÑ সদ্য গাছ থেকে পড়া, কোনোটা বাসি, কোনোটার লাল রঙ বিবর্ণ হয়ে বিশ্রি বদসুরত হয়ে গেছে, কোনোটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে রূপ-লাবণ্য একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। মাথার ওপরে গাছে চলত পাখির উৎসব। বিভিন্ন জাতের হাজারো পাখি, ওড়াউড়ি করত, ওই বসে, তো ওই উড়ে, উত্তেজনা আর অস্থিরতায় তারা কেবল লাফাত, আনন্দ আর কলতানে মুখরিত করে রাখত গাছতলা। এ যেন তাদের উপচেপড়া আনন্দ, বিরামহীন এক মজার খেলা! যেন পাখির আনন্দরসের জন্যই কেবল শিমুল গাছের ডালে ডালে লাল লাল ফুল ফোটা। এমন আনন্দঘন পরিবেশে পাখির দেহ থেকে নির্গত বস্তুটা মাটিতে না পড়ে যে মাথায় পড়তে পারে, সে ব্যাপারে আমাদের কোনো খেয়ালই থাকত না। শিমুল ফুল যেভাবে পাখিকে আকর্ষণ করে অন্য ফুল কেন এভাবে করতে পারে না, এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজো পাইনি।
একটু বড় হওয়ার পর একসময় আমি নানার বাড়ি চলে গেলাম এবং সেখানে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। নানার বসতবাড়িটা খুব বড় না হলেও অন্দরমহল ও বাইর এ দুই অংশে ভাগ করা ছিল। বাইরে ছিল একটা দহলিজ ঘর, সামনে বিশাল খোলা আঙিনা। একসময় ওই ঘরের সাথে লাগোয়া একটা সুন্দর সাজানো ফুলের বাগানও ছিল। ফেন্সি বাঁশের বেড়া দিয়ে বাগানটাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল। মাঝখান দিয়ে ছিল ঘরে ঢোকার তিন-চার ফুট চওড়া রাস্তা। বাগানে ছোট-বড় অনেক জাতের ফুলের গাছ ছিল। তার মধ্যে দুটোর কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে। একটা সর্বজয়া ফুল (সিলেটে এটিকে ‘কলাফুল’ বলে), আরেকটা স্থলপদ্ম। কলাফুল এদিক-ওদিক দেখলেও স্থলপদ্মের দেখা দেশ-বিদেশের কোথাও আর মেলেনি। এ ধরনের গাছ ১০-১৫ ফুট উঁচু হতো এবং বড় বড় ফুল ধরত, ফুলের রঙ ছিল হালকা গোলাপি (পিঙ্ক)।
দহলিজ ঘর আর পুকুরের মাঝখানে ছিল এক সবজি বাগান, তার উত্তর দিকে ছিল প্রতিবেশীদের ঘন মূর্তাবন। বর্ষাকালে মূর্তাবনে যখন ছোট ছোট সাদা সাদা ফুল ফুটত তখন সেটাকে মনে হতো যেন আরেকটা ফুলবাগিচা। কিছু দিন পর ফুল ঝরে পড়ে মূর্তাগাছে যখন গোটা ধরত তখন মনে হতো, ওটা ফলের বাগান। বহুযুগ পর গ্রিসের ‘ভোলস’ শহরে এক আঙুর বাগান দেখে আমার মনে পড়েছিল নানাবাড়ির মূর্তাবনের কথা। তার পাশের জাম-জাম্বুরা গাছের তলা দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ছিল এবং এখনো আছে, গ্রামবাসীর চলার পথ। সে পথ লম্বভাবে গিয়ে মিশেছে পূর্ব-পশ্চিম বরাবর একটা বড় রাস্তার সাথে, যে রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে ছিল মসজিদে যাওয়ার পথ এবং আরো সামনে গেলে পড়ত বাজার ও তার সাথে কুশিয়ারা নদীর পাড়। ওই রাস্তার দক্ষিণ দিকে ছিল একটা হিজল গাছ।
গাছটার বয়স হলেও আকার আকৃতিতে বেশ ছোট্টই ছিল, কিন্তু তাতে কী? এর রূপমাধুর্যের কোনো কমতি ছিল না। হিজল গাছে যখন ফুল ফুটত তখন তার বাহারি রঙ এবং মনমাতানো খুশবুতে গাছতলা ম ম করত। মৌমাছিদের ওড়াউড়ি আর গুঞ্জনে সেখানে এক মায়াময় নির্মল আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হতো। খাওয়ার সময় ডাকাডাকি করলেও আমরা ওই হিজলতলা থেকে সহজে আসতে চাইতাম না। ঝরে পড়া হিজল ফুল কুড়িয়ে আনতাম, সেখানেও কেনাবেচা খেলা খেলতাম, মালা বানাতাম, গলায় পরতাম, ফুলের রেণু গায়ে মাখতাম। এখানেই শেষ নয়, সেই হিজল গাছের সাথে রয়েছে আমার আরো অনেক মধুর স্মৃতি। ডালের সাথে দুই গাছা দড়ি ঝুলিয়ে, রান্নাঘর থেকে বসার পিঁড়ি এনে, দড়ির ওপর বিছিয়ে দোলনা বানিয়ে দোল খেতাম। ওই দোল খাওয়ার আনন্দ-উচ্ছ্বাস লিখে বোঝানোর মতো ভাষা আমার জানা নেই! গাছটা আমার কত প্রিয়, কত আপন ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না! তার ডালে ডালে পাতায় পাতায় লেখা ছিল আমার শৈশবের মধুময় সব স্মৃতি কথা! আজ গাছটা হয়তো আর বেঁচে নেই, কেউ তাকে ছেঁটে, কেটে, টুকরো টুকরো করে শুকিয়ে চুলায় পুড়িয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে। এই বয়সে বিদেশবিভূঁইয়ে বসে নানার বাড়ির হিজল গাছের কথা যখন ভাবি, তখন ইচ্ছা হয় ফিরে যাই সেই ছোটবেলায়, ছুটে যাই বাদেপাশা, ইচ্ছা হয় গাছটাকে বুকে জড়িয়ে ধরি, তাকে আদর করি, চুমো খাই, আমার আনন্দাশ্রু দিয়ে গাছটাকে ধুইয়ে দিই!
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে, অর্থাৎ যে বয়সে মানুষের জীবনে ফুল এবং প্রেম একসাথে ফুটে, সে বয়সে আমার জীবনে এর কোনোটাই আসেনি। নিরস জীবনটা কেটেছে একেবারে নিস্তব্ধভাবে, নিঃশব্দে। নিজে না দিলেও ফুল দেয়া-নেয়া দেখেছি। কাউকে এমনও দেখেছি, নরম সুবাসিত ফুলের বিনিময়ে পেয়েছে শক্ত ও ধারালো কাঁটা, কঠিন পাথর; কাঁটা আর পাথরের আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে হৃদয়-মন, আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে তার গোটা জীবন। কেউ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কেউ পারেনি!


আরো সংবাদ



premium cement