ফেলে আসা সেই মুখর শৈশব
- নাঈম আরিয়ান
- ২৪ জুলাই ২০২০, ০০:০০
এখন ঋতুতে বর্ষাকাল। এই বর্ষাকাল আর আমাদের জীবনের সোনালি সময়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্ষা মানেই বৃষ্টি, আর বৃষ্টি মানেই স্মৃতির বাহনে চড়ে সেই অপূর্ব সোনালি সময়ের দিনগুলোতে ফিরে যাওয়া। সেই দিনগুলোÑ সেই মধুর দিনগুলো। তাই তো বলিÑ
‘বৃষ্টি মানেই কল্পনার সীমানা ছুঁয়ে
হঠাৎ নেমে আসা সুখস্পর্শ,
বৃষ্টি মানেই বিষাদে বিরহকাতর
হঠাৎ মনে পড়া অতীত দৃশ্য।’
বৃষ্টি এমনই। স্মৃতিরা ফিরে এসে বিরহে কাতর করে দেয়। সুখ সুখ অনুভূতিতে হৃদয়ে বেদনা সিক্ত মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়। ফিরে যাই সেই ফেলে আসা দুরন্ত শৈশবে। কী ছিল না তখন! দলবেঁধে পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি, দাপাদাপি, সাঁতার কাটা, হাঁটু-সমান পানিতে ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা, কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া, কাদামাখা শরীর দেখে মায়ের বকুনি, মাছ ধরা, পাখি শিকার, ভিজে ভিজে কদম ফুল খোঁজা, ফুল দিয়ে দুষ্টুমী, ঘরে বসে থাকলে লুডু খেলা, গুটি খেলা, কখনো শিমের বিচি কখনো বা খিঁচুড়ি, সবই তো ছিল! আহা আমার সেই মন্ত্রমুগ্ধকর হারানো দিনগুলো।
গ্রামবাংলা চিরকালই তরুণ, চিরসবুজ। চিরসবুজ মায়া মাখা এই গ্রাম বর্ষাকালে একদম অন্যরকম রূপ ধারণ করত। চার দিকে থই থই পানি আর পানি। নদী, খাল, বিলে, পুুকুরে, মাঠে সবখানেই পানি। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিকটায় একদম ফাঁকা মাঠ। জায়গাটা খানিক উঁচু বিধায় খুব বেশি বৃষ্টি না হলে তেমন পানি জমত না। ওটাই ছিল আমাদের খেলার মাঠ। বৃষ্টি হলে আমরা দলবেঁধে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে যেতাম। এক দিকে ঝুম ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে একনাগাড়ে, আর অন্য দিকে সমানতালে চলছে আমাদের ফুটবল খেলা। মাঠে কখনো টাখনু সমান কখনো বা হাঁটুসমান পানি। তাতেই খেলা চলছে অবিরাম। কারো কোনো দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই। সাধারণত যেটা হয়, গ্রামের এসব খেলায় কেউ কোনো নির্দিষ্ট নিয়মের থোড়াই কেয়ার করে না, যে যেভাবে পারছে ফুটবলে লাথি দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রকাশ করতে মরিয়া। এভাবেই খেলার নামে কাদামাটিতে নিরবচ্ছিন্ন গড়াগড়ি চলত।
খেলা শেষেই আমরা পুকুরে চলে যেতাম। তারপর পুকুরেই একটানা লাফালাফি, দাপাদাপি চলত। একটু পরপরই মুরুব্বিরা বকা দিয়ে যেত। কিন্তু কে শুনে কার কথা! আমরা আমাদের মতোই পুকুর দাপিয়ে বেড়াতাম। সাঁতার কেটে কে ওই পাড়ে আগে যেতে পারে এটি নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। পানির নিচে ডুব দিয়ে কে কত দীর্ঘ সময় নিয়ে থাকতে পারে এটি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। আমি মনে হয় কোনোটাতেই জিততে পারতাম না। সাঁতার শিখতে দেরি হয়েছিল আর পানির নিচে তো কয়েক সেকেন্ড থাকলেই দম বন্ধ হয়ে আসে।
মাছ ধরা ছিল বর্ষাকালের অন্যতম রোমাঞ্চের ব্যাপার। সব জায়গায় যেহেতু পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকত, এ জন্য মাছও থাকত অনেক। উজানের পানিতে দলে দলে মাছ আসত। পুকুরে, মাঠে, ছোট ছোট গর্তে সেসব মাছগুলো এসে বন্ধুত্ব করতে চেষ্টা করত। কিন্তু তাদেরকে সে সুযোগ দেয়া হতো না। জাল দিয়ে মাছ ধরতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো সবার মধ্যে। একদিনের কথা স্পষ্টভাবে মনে ভাসে। সেদিন ভোরবেলায় বৃষ্টিতে ঘুম ভাঙে। একটু চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বেরিয়েই দেখি সব জায়গায় কই মাছ গিজগিজ করছে। বাড়ির উঠোনে, ঘরের সামনে-পেছনে, রসুই ঘরের কোণায়, লাকড়ির নিচে, গাছের টুকরার নিচে বলতে গেলে সবখানে কই মাছ। সবার বালতিতে বালতিতে কই মাছ পরিপূর্ণ। পরে গুনে দেখা গেল শুধু আমরাই একশটির উপরে কই মাছ পেয়েছি। খুব অবাক লাগে এখন! সেই দিনগুলো কোথায় হারাল! এখন কি সেই আগের মতো এভাবে মাছ ধরার ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়!
তখনকার সময়ে বর্ষাকালে অন্য যে ব্যাপারটি খুব রোমাঞ্চকর ছিল সেটি হলো পাখি শিকার করা। গ্রামে প্রচুর পাখি আসত। দোয়েল, কোয়েল, শালিক, ময়না, ঘুঘু, বকসহ নাম না জানা আরো অনেক পাখি। এসব পাখি ধরা হতো বিভিন্ন রকম কলাকৌশলে। কেউ ফাঁকা মাঠে খাঁচা বসাত। খাঁচার ভেতরে পাখির খাবার দিয়ে রাখত। পাখি খাবার খেতে খাঁচায় ঢুকলেই বোকা বনে যেত। আবার কেউ কেউ বড়শি দিয়ে ধরত। একটা ছোট বাঁশের কঞ্চিতে সুতা দিয়ে বড়শি বেঁধে রাখত। তার পর বড়শিতে কেঁচো বা অন্য কোনো কীটপতঙ্গ বিঁধে দিত। তার পর বড়শিটা এমন জায়গায় রেখে আসত যেখানে পাখিদের খুব আনাগোনা। পাখি খুব আনন্দিত মনে এসব কেঁচো বা কীট খেতে আসত আর ধরা পড়ত। এভাবেই আমরা শালিক, ময়না, বক ধরতাম। কে কতটা পাখি ধরতে পেরেছে সেটি নিয়ে খুব মাতামাতি হতো। এখন বুঝি এভাবে পাখি ধরা অপরাধ। কিন্তু তার পরও বলতে হয়, এই অপরাধের মাধ্যমেও যে অফুরন্ত আনন্দ আর সুখ আমরা পেয়েছিলাম সেই সুখ কি আর বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা পাবে! সেই স্মৃতিগুলো যে চির-অম্লান।
সেই সোনালি দিনগুলো আমাদের এখন আর কেউ ফিরিয়ে দেবে না। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, ঐশ্বর্যশালী, সুনীল সময়গুলো এখন কালের গহ্বরে নিঃশেষ হয়ে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা কখনো জানবে না সেই স্বপ্নের মতো সোনালি দিনগুলোর অনুভূতি। এখন তারা যেমন শৈশবের সেই প্রাচুর্য বঞ্চিত প্রাণ তেমন আমরাও যেন পরিণত হয়েছি একেকটা জীবন্ত রোবটে। অনুভূতিহীন, মায়াহীন। আমাদের এখন আর সেই উচ্ছ্বাস নেই। প্রাণচঞ্চলতা নেই।
এখনো বর্ষাকাল আসে এই শহরজুড়ে, এখনো বৃষ্টি হয়। কিন্তু আগের মতো বর্ষাকালের সেই অনুভূতি এখন আর মন রাঙায় না। এই ধূলিমাখা দালানকোঠার শহরে বর্ষা যেন নিষ্প্রাণ লাগে আমার কাছে। মন চাইলে তাও মাঝে মধ্যে দুই হাত বাড়িয়ে দেই শূন্যে। স্পর্শ নেই বৃষ্টির, ঘ্রাণ নেই প্রাণভরে। বৃষ্টি ছুঁয়ে যায় আমার ক্লান্ত অবসন্ন দেহ। কিন্তু ছুঁতে পারে কি আমার মন! বিষাদের আহ্বানে হৃদয়ের খুব গহিন থেকে মাঝে মধ্যে যেন কোনো এক অদৃশ্য সত্তা বলে উঠেÑ
‘জীবন এখন পুড়ে পুড়ে হয়েছে ধূসর ছাই,
বাঁচার জন্য অন্তত আমি
সেই সোনালি দিনগুলো ফিরে পেতে চাই।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা