২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সেইসব সুন্দর

-

বছরের দীর্ঘ ছুটি ছাঁটায় আমি প্রায়ই বাগেরহাট যাই। বাগেরহাট জেলা শহর আমার প্রিয় একটি জায়গা। বাগেরহাট নামটা শুনলেই মনে হয় একসময় বোধ হয় এখানে বাঘেরহাট বসত। বাঘ বেচাকেনা হতো। আর যেহেতু কাছেই এ জেলাতেই সুন্দরবন অবস্থিত। সুতরাং একসময় এই অঞ্চলে বাঘ বেচাকেনা অসম্ভব নাও হতে পারে। যুক্তি অনুযায়ী অনুমান সঠিকও হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তবে বাঘেরহাট জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখেছি মূল নাম আসলে বাগ-ই-রাহাত। যার অর্থ হচ্ছে রাহাতের বাগান। সেই বাগ-ই-রাহাতই কালের বিবর্তনে দ্রুত উচ্চারণে বাগেরহাট হয়ে গেছে। এই ছোট্ট জেলা শহরটাতে এলেই আমি আমার শৈশব-কৈশোরে ঢুকে পড়ি। আমার সেই সময়টাতে ঢাকার সবুজবাগ এলাকাটা ছিল খুবই ছিমছাম গাছপালায় ঘেরা একটা সবুজ এলাকা। সামনে বিশাল বিশাল খালি জায়গায় নিয়ে একতলা দোতলা বাড়ি লন প্যাসেজ। সময়ের চাহিদা মেটাতে সবুজবাগে এখন একটা গাছ খুঁজে পেতে হলে অণুবীক্ষণ দূরবীক্ষণ দিয়ে হাতড়াতে হবে। আমার শৈশবের সবুজবাগ এখন বিশাল বিশাল অট্টালিকার এলাকা। সবুজবাগ লাগোয়া পশ্চিমের বিশ্বরোড পার হলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে স্টেশন। দক্ষিণে বাংলাদেশের বিখ্যাত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহার। পূর্ব দিকে বিশাল বালুরমাঠ। এতসব বিশাল বিখ্যাত অবস্থানের পাশে হারিয়ে গেছে গাছপালায় ঘেরা ছোট সবুজ সুন্দর সেই শৈশবের সবুজবাগ এলাকাটি। যেখানে প্রচুর ফলের গাছ আমাদের মৌসুমি ফলের চাহিদা মেটাত। গাছের ডালপালায় লাফিয়ে বেড়ানো, ঢিল ছুড়ে ফল পাড়ার সেই বয়সের সাথে এলাকাটাও নাই হয়ে গেছে।
এলাকাটার উত্তরে শেষ মাথা শেষ হয়েছিল একটা বিশাল ঝিলে। যে ঝিলটা মূলত তৈরি করা হয়েছিল, রেল ইঞ্জিনের পোড়া তেল আর বর্জ্য ফেলার কাজে। আমাদের শৈশবেই দেখেছি বিশাল বিস্তীর্ণ ঝিলটা বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় সারা বছরই কচুরিপানায় ভরা থাকত। ঝিলের পাড়ে সবুজ ইরানি কার্পেটের মতো ঘাসে মোড়া ছোট্ট মাঠটা ছিল কিশোর যুবক থেকে বয়স্ক ময়-মুরুব্বিদের অবকাশ যাপন কেন্দ্র। ঝিলের পাড়ে সন্ধ্যার পর সবুজ কচি ঘাস বিছানো মাঠটায় কমবেশি সবার মাদুর গামছা পেতে বসে গল্প করার, শোবার জায়গা করে দিতো। প্রচণ্ড গরম থেকে কিংবা খোলা আকাশের নিচে শুয়ে মিহি বাতাসের অবগাহনের সাথে দুর্দান্ত খোলা আকাশ। আকাশে তারাদের চকচকে মিছিল। ঘন দুধের গোল স্বরের মতো চাঁদ। আর নিচে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকের মিউজিক, আহা কোথায় সেই শৈশব। তাই এখন বাগেরহাট এলে সবুজে মোড়ানো এই ছোট জেলা শহরটাকে আমার শৈশবের সেই সবুজবাগ, আহম্মদবাগ, বাসাবো, মায়াকানন, কদমতলা এলাকার স্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে। বিশাল বিশাল গাছপালা, ঘন ঝোপজঙ্গল, চওড়া গলিপথ, গলিপথগুলোর ওপর গাছপালার ছায়ায় ঘেরা। গাছেদের পাতার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া রোদ রঙের দিনের আলো। রাতে আবার সেই গাছেদের ফাঁক ভেদ করে গলে পড়া ল্যাম্পপোস্টের আলো-আঁধারীর নির্জন মায়াবী পথ। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুকুর। সেই আহাম্মদবাগ মায়াকাননের চার ঘাটলা আর তিন ঘাটলা পুকুরগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয় সেখানকার সারিবাধা নারিকেল, পানিতে ঝুলে থাকা আমগাছের ডালপালারা। আর তার তলে দল বেঁধে দিনমজুর, কারখানা শ্রমিকদের গোসল এবং আমাদের নিশ্চিন্ত স্বাধীন গাছের ডালে ঝুলে আর পানিতে লাফিয়ে পড়ে দাপাদাপি। আহা নেই নেই। গাছগুলো কেটে তার ওপর অট্টালিকা তৈরি হয়ে গেছে কবে। পুকুরগুলোর চিহ্নও এখন আর আশপাশে কোথাও নেই। এখানে এসে দেখতে পাই, এই বাগেরহাটে সারি সারি নারকেল গাছ, সফেদা, আম, কাঠবাদাম, তেঁতুল গাছ সাজানো। শহরের রাস্তার পাড়ে বাড়ির ধারে স্কুল কলেজের সীমানায় সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অসংখ্য পুকুরের স্বচ্ছ পানির ছলছল দেখেছি। কয়েক মাস বা বছর পাড়ি দিয়ে যখন এখানে আসি; দেখি আজ ওই পুকুরটা নেই, নদীর পাড়ের বিশাল বিশাল সেই সিরিষ গাছগুলো ফুটপাথ তৈরির নামে কেটে ফেলা হয়েছে। এক সময় যেগুলোর ছায়ায় বসে আমি দড়াটানা নদীর ওপর ভাসমান জেলেদের নৌকায় করে মাছ ধরা দেখতাম। যেই গাছগুলোর ছায়ায় বসে নদীর জোয়ার ভাটার টান দেখতাম। দূরে ব্রিজের ওপর দিয়ে কখনো সখনো ছবির মতো চলমান গাড়িগুলো কী প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যেত। ওপারে শুধুই সবুজ আর সবুজ দেখতাম। মুনীগঞ্জ গুদারাঘাট থেকে মানুষজনদের পারাপার লক্ষ্য করতাম। আজ সেসব খাঁ খাঁ করে। খড়খড়ে ফুটপাথ তৈরি করা হয়েছে, বেঞ্চ পাতা হয়েছে। কিন্তু বসার জন্য কিংবা হাঁটার জন্য গাছের ছায়া, ডাল পাতার শিরশির শিহরণের শব্দ, পায়ের তলায় ঝরে পড়া শুকনো পাতার মচর মচর কিংবা মাথার ওপর গাছের ডালে বসে থাকা পাখিদের হরেক রকম ডাক, কোলাহল, মৌমাছি, ফড়িংয়ের গুঞ্জন কোথায় পাবো? ভাবিনি। হয়তো ভাবনার জায়গায় কেউ কড়া নাড়েনি। অথবা সেই সৌন্দর্যবোধই কাজ করেনি। গাছ বাঁচিয়ে, গাছকে ঘিরে ফুটপাথ করলে ফুটপাথের সৌন্দর্য কী আরো বৃদ্ধি পেতো না? যদি সৌন্দর্য দেখার চোখ না থাকে তাহলে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইউটিউবে সার্চ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শহরতলিগুলোকে দেখেন কিভাবে গাছকে বাঁচিয়ে সবুজকে সাথে নিয়ে রাস্তাঘাট বাজার-হাট তৈরি করা হয়েছে। বিশাল বৃক্ষগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে অদ্ভুত উদ্ভট আধুনিক নগরায়ণের নামে। অথচ কত কালের কত বছরের প্রাচীন এই গাছগুলো। কত সময়ের সাক্ষী তারা। সাক্ষী মানে এমন না যে তার তলায় দাঁড়ালেই সে গাছ তার দেখা অতীত সময়ের ঘটনার বিবরণ আপনাকে দেবে। বরং আপনি তার তলায় দাঁড়ালে তার ছায়ায় বসলে সেখানে ঘটমান অনেক ঘটনা মনে পড়ে যাবে, যা কিনা আপনার ভেতর এক ধরনের অনুরণন তৈরি করবে। যে অনুরণন আপনাকে শান্ত রাখবে। আপনার সময়টা সুখস্মৃতিতে মুড়িয়ে রাখবে অনেকটা ক্ষণ। আর পুকুরগুলোর শান্ত পানিতে আপনি গোসল করুন বা অজু করুন তার শিহরণ অনুভূতি ঘরের স্থির পানি থেকে আলাদা। ঘাটলা বেয়ে নেমে পানির দিকে তাকিয়ে নিজের আবছায়া দেখার মধ্যে জীবনের হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তের বোধোদয় ফিরে আসে। নিজেকে নতুন করে দেখার, নিজের সাথে কথা বলার যে সুযোগ সময় ও মায়াবী সৌন্দর্যবোধ সৃষ্টি হয় তার আবছায়ার রেশ কোনো দামি আয়নায় পাওয়া যায় না, অনুভূতও হয় না। নিজের আবছায়ার সাথে বিস্তীর্ণ আকাশের প্রেক্ষাপট কোথায় পাবেন ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে। বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে এসব পুকুর। যখনই আসি তখনই শুনতে পাই, অমুক পুকুর নেই। ভরাট হয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ স্মৃতিকাতরতায় পুকুরের পানিগুলো বুকের ভেতর ছলছল করে ওঠে, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। বলতে চায় সিমেন্ট রড ইটা বালুর স্থাপনা মানেই সৌন্দর্য নয়। সুন্দর মানে সবুজ, সুন্দর মানে সূর্যের আলো ছড়িয়ে থাকা গাছের ডালপাতায়, পাতার ফাঁক গলে মাটিতে রাস্তায়, শান বাঁধানো পুকুরঘাটে। স্বচ্ছ ঘোলা পানিতে। সুন্দর মানে চাঁদের আলোর চাদর বিছানো গাছপালা নদীনালা পুকুর পানির স্রোত। চোখের এ দেখা আর প্রকৃতির নির্জনতার সাথে পাখির ডাক কলগুঞ্জনের সাথে কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের ঝিঁ ঝিঁ শব্দের সাথে, মৌমাছিদের গুন গুন, বর্ষায় বৃষ্টিতে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাক। পানিতে মাছেদের খলবল শব্দে বিভোর কান। নাকে নির্ভেজাল নিঃশ্বাস। ফুলের ফলের ঘ্রাণ, গাছ, মাটির সোঁদা গন্ধ কোথায় পাবেন। একবার ভাবেন। মাঠে মাঠে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের সমারোহ। আরেক দিকে সুদূর পানি আর পানি ঘেরা মাছের ঘের। ঘেরের চারপাশে লতানো সবজি গাছে ঝুলে থাকা সবজি লাউ কুমড়া শিম। এসব চোখে দেখার মায়া কানে শোনার মায়া নাকে ঘ্রাণ নেয়ার মায়ার মধ্য দিয়ে মস্তিষ্কে সুদূর চিন্তারই প্রয়াস ঘটাবে। কেননা গাছেদের কান্না দেখি না, ধ্বংস দেখি, মৃত্যু দেখি, তাই গাছের ধ্বংস বা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল। তার ডাল হাসে পাতা হাসে ফুল ফল এমনকি ছায়া পর্যন্ত সদা হাস্যময়। ফলের ঝুলে থাকা পাকা হাসি আর তার ঘ্রাণ প্রাণে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। প্রবহমান পানিতে অবগাহন, পানিতে কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকিয়ে দেখা নিজের আবছায়া, আবছায়ায় কথোপকথন, মনের অনেক অজানা অচেনা কঠিন কঠোর ব্যথাকে শীতলতায় মুছিয়ে দিতে পারে। মুখের মনের তিক্ত অনেক কিছুই ফুলের ঘ্রাণে কিংবা কোনো গাছের টক মিষ্টি ফলের স্বাদে তিক্ততা কাটিয়ে নতুন খোরাক তৈরি করে দিতে পারে মুখে ও মনে। পাখি অলস না করিতকর্মা, সে ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায়, লাফায় এ ডাল থেকে সে ডালে। অবসাদতগ্রস্ত মন কিছু সময়, উন্মুক্ত পাখির উচ্ছলতা কিছুক্ষণ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে শরীর মনের জড়তা দূর হয়ে তরতাজা অনুভূত হতে থাকে।
গাছেরা প্রতিবাদ করে না, পাখিদের প্রতিবাদের ভাষা আমাদের অজানা। মানুষ প্রতিবাদ করে। মানুষের প্রতিবাদ আজ মানুষ শোনে না। মানুষ ব্যবসা বোঝে। যে ব্যবসার অর্থ যে করেই হোক শুধুই লাভ করতে হবে। এই লাভের সাথে লোভ আষ্টেপৃষ্ঠে মানুষকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। লোভের এই সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে হিংসায় অহঙ্কারে। যা লোভকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে। আরো চাই আরো পেতে হবে। ধ্বংস করেই হোক আর নির্বংশ করেই হোক। গাছই হোক মাটিই হোক, পাখিই হোক আর পানিই হোক, সুন্দরের কোনো স্থান নেই এখানে। সুন্দর ও ভালো এখানে সুদূর পরাহত। মনে পড়ে বহু দিন আগে দেখা একটা শর্ট ফিল্মের কথা। যেখানে দেখা যায় একটা লোক মাটি খুঁড়ছে আর স্বর্ণ পাচ্ছে। যতই মাটি খুঁড়ে নিচে নামছে স্বর্ণের পরিমাণও তত বাড়ছে। এভাবে স্বর্ণের লোভে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে স্বর্ণ পেতে পেতে ক্রমাগত তলিয়ে যেতে থাকে মাটির নিচে। আর ওপরে স্বর্ণ জমতে জমতে স্তূপাকৃত হতে থাকে। এক সময় সন্ধ্যা নামলে চার দিক অন্ধকার হলে লোকটি আর অন্ধকার পথ বেয়ে উপরে উঠতে পারে না। অন্ধকারে নিজের কাছেই নিজে অচেনা হয়ে তলিয়ে যায়। প্রশ্ন থেকে যায় যে স্বর্ণের লোভে সে মাটি খুঁড়ে নিচে নামল সেই স্বর্ণ জমে স্তূপ হলো সত্যি কিন্তু তার জীবনে সেই স্বর্ণ কোনো কাজে এলো? বরং তার জীবনটাই শেষ করে দিয়ে গেল।
মনে পড়ে লিও টলস্টয়ের ‘ কতটুকু জমি দরকার’ সেই গল্পের কথা।
যেখানে দেখা যায়, সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে যতটুকু পথ পাড়ি দেবে সে ততটুকু জমির মালিক হবে। সূর্যোদয় থেকে পথ চলা শুরু, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তবু পথ চলা থামে না। লোভ তাকে থামতে দেয় না। যত পথ যাবে তত জমি পাবে। আরো চলো আর চলো। চলতে চলতে এক সময় মুখ থুবড়ে পড়ে। আর তখনই মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারে সাড়ে তিন হাত জমিই শুধু তার দরকার।
গাছের পাতারা ঝির ঝির বাতাসে নড়ে, ডালপালারা দোলায়, দোল খায়। পাখিরা এ ডাল থেকে সে ডালে লাফিয়ে, তাদের ভাষায় কথা কয়। হরেক রকম পাখি হরেক রকম ডাকাডাকি। পাতা ঝরে, মায়াবী ফলের মুকুলেরা, ফুলেরা সুগন্ধ ছড়ায়, ঝরে পড়ে পথের দু’ধারে। পথিকের পথকে ফুলে ফুলে মুড়িয়ে দেয়। সেসব পথে হেঁটে ফুল মাড়িয়ে যেতে যেতে থেকে থেকে জীবনের সময়টাকে মুহূর্তেই মায়াবী করে নিয়ে যায়। প্রবহমান পানির স্রোত যেমন ফাঁক ফোকর গলে নালা গর্ত নদী সমুদ্র খুঁজে ছুটে চলে। তেমনি মসজিদে মুয়াজ্জিনের আজান এসব গাছেদের তাদের অজস্র ডালপালা পাতা ফুল ফলের ফাঁক গলে ছুটে চলে পাখ পাখালির কানে। বাড়ির দরজা ভেন্টিলেটর জানালার ফাঁক গলে মানুষের কর্ণকুহরে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে আনা ভোরের আলোর হাতছানি, আর মুয়াজ্জিনের নামাজে আসো নামাজে আসো। নামাজেই শান্তি, নামাজেই শান্তি এই ডাকের প্রতিধ্বনিতে মুখর চার পাশের ডাকে সাড়া দিতে যারা মসজিদের পথে নামে তখন তাদের চোখ আর কান পেতে শুনতে পায়, গাছ আর পাখিদের ভেতর সেই শান্তির কী প্রবল উচ্ছ্বাস। পাখিদের কিচিরমিচির আর বাতাসে গাছেদের শির শির শিহরণ। তখন মনে হয় গাছ মানে শুধু ফুল আর ফলের লাভ লসের হিসাব নয়। গাছ মানে শান্তি সুখের উল্লাসে জীবনের অসাধারণ প্রেরণার উৎসও। ঝড়ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাসে বুক চিতিয়ে লড়াই করার সাহস গাছই দেখিয়েছে মানুষকে। কিভাবে প্রবল ঝড়ো বাতাসে নিজের ডালপালাকে সাথে নিয়ে হেলেঝুলে ভেঙে নুয়ে আবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হয়। কিভাবে ভাঙা ডাল পাতা ফুল ফল ঝরে পড়ার পরও আবার নতুন করে পাতা ফুল ফল গজাতে হয়। সেই গাছই যদি নাই হয়ে যায় তাহলে বুক চিতিয়ে লড়াই করার সাহস দেখতে পাবো না আর। যতই রড সিমেন্টের ঝালাই আর ঢালাই দিয়ে অট্টালিকা তৈরি করি না কেন সে শুধু নির্জীব হয়ে শুধু ক্ষয়েই যাবে। নতুন আশার বীজ মন বপন করবে না। মনে নতুন ফুলের সুঘ্রাণ জাগাবে না, নতুন ফলের রসে আস্বাদে শরীরকেও তাজা করবে না। দেহমন তার তৈরি করা অট্টালিকায় দেয়ালে ক্ষয় দেখবে, ধস দেখবে শুধু। এসব দেখতে দেখতে তার দেহমন ইট রড কংক্রিটের অট্টালিকার মতোই সেও একদিন অসাড় হয়ে রবে চার দেয়ালের মাঝে। দেহের সাথে মনও আটকে থাকবে জড়র জড়তায়। দেহের মতো অট্টালিকারও বয়স বাড়ে আর তার সাথে ক্ষয়ও বাড়ে। কিন্তু মনও যদি সেই সাথে ক্ষয় হতে থাকে তবে সে জীবনের জয়গান আটকে যাবে শুধুই যৌবনে। মানব চেতনার রঙ তার যৌবনেই সীমাবদ্ধ হতে পারে না। সে জেগে থাকবে কৈশোর তারুণ্য যৌবন বার্ধক্যেও। চামড়ায় ভাঁজ ধরবে, শরীর জরাগ্রস্ত হবে, কিন্তু মন তখনো সচেতন থাকবে। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ চোখ আটকে যাবে না একটু বুক ভরা নিঃশ্বাসের জন্য। ফুলের ঘ্রাণ, গাছে ঝুলে থাকা ফলেদের আশ্বাস, চোখ ধাঁধানো সবুজের উচ্ছ্বাসে, পাখিদের কলরবের জন্য চোখ কান নাকের হাপিত্যেশ থাকবে না। সুদূর চোখের মায়ায় ছড়িয়ে থাকা দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ। বহমান নদীর স্রোত। পুকুরের পানিতে থেকে থেকে মাছেদের লাফিয়ে পড়া ছলাত শব্দ ব্যাঙের ডাক। আহা সেই টুনটুনির ফুড়–ৎ ফুড়–ৎ লাফিয়ে চলা, চড়ুইয়ের খুটে খাওয়া দৃশ্যের ভেতর জেগে ওঠা প্রাণ। প্রাণের এসব ঐশ্বর্য ঠিকই বয়ে যাবে শরীরে মনে। যেথায় বার্ধক্য পরাজিত।

 


আরো সংবাদ



premium cement