২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কবিতায় বর্ষার বহুরূপ

-

‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা,
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা।’

Ñবিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই পঙ্ক্তিমালা কোনো প্রেমাতুর মন জীবনে উচ্চারণ করেনি তেমনটি সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবিতামাতৃক বাংলাদেশে ঋতুবৈচিত্র্যে জনমানুষের জীবন সঙ্গতকারণে প্রভাবিত। এই প্রভাব সব শ্রেণী পেশার মানুষের ওপরই লক্ষণীয়। কবি এবং কবিতাও তাই ষড়ঋতুর সোন্দর্য, উপমা যেমন উপেক্ষা করতে পারে না তেমনি এসব জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে এখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনাচারে বা জীবনবোধে দুঃখ-বেদনামাখা ঘটনাগুলোকেও এড়িয়ে যেতে পারে না। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে কমবেশি সবগুলোর সরব উপস্থিতি দেখা গেলেও বোধ হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধধারা কবিতায় বর্ষার প্রভাব একটু বেশিই!
বর্ষা বহুরূপী! বর্ষা যেমন প্রেমের উপমায় ব্যবহার করা যায়, তেমনই বিরহের উপমায়ও খাপখায় যথাযথ।
‘কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ প্রেমের কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে। সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি, এই ভরা বর্ষা... Ñমহাদেব সাহা’
অথবা
‘বৃষ্টি বৃষ্টি
জলেদের চাঁদনি
দে সোনা এনে দে
মন সুখ রোশনি। Ñরুদ্র গোস্বামী’
বর্ষাকে জীবনে সুখের আগমন এবং সুখের বিদায় দু’ভাবেই দেখানো যায়, ঠিক একইভাবে দুঃখের আগমন ও বিদায় রূপেও দেখানো যায়।
‘আষাঢ়ের রাত্রে’ আল মাহমুদ ব্যক্ত করেছেনÑ
‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’
মেঘ-বৃষ্টিকে ভয় এবং মেঘমুক্ততাকে সাহস, ঝড়কে দ্রোহ এবং ধ্বংসের উভয় উপমায় ব্যবহার করা যায়। অন্য কোনো প্রাকৃতিক ঘটনাকে বোধ হয় এত রূপে উপস্থাপন করা যায় না বিধায় কবিতায়ও মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়ের আধিক্য।
‘তখনো অস্ত যায়নি সূর্য, সহসা হইল শুরু
অম্বরে ঘন ডম্বরু-ধ্বনি গুরুগুরু গুরুগুরু!
আকাশে আকাশে বাজিছে এ কোন ইন্দ্রের আগমনী?
শুনি, অম্বুদ-কম্বু-নিনাদে ঘন বৃত্তহিত-ধ্বনি।
বাজে চিক্কুর-হ্রেষা-হর্ষণ মেঘ-মন্দুরা-মাঝে,
সাজিল প্রথম আষাঢ় আজিকে প্রলয়ঙ্কর সাজে।’ (ইন্দ্র পতন Ñকাজী নজরুল ইসলাম)
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য বৃষ্টির দিনে যেমন সুন্দররূপে প্রতিভাসিত হয়, তেমনই কদর্যেও কম যায় না বর্ষা।
‘আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলাট-মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝ্ঝুম নিরালায়,
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়!’ (পল্লী বর্ষা Ñজসীম উদদীন)
বাংলা কবিতায় বর্ষার প্রভাব কেন একটু বেশিÑ এ বিষয়টির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা বেশ কঠিন, তবুও একটু সহজ-সরল এবং অগভীরভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে!
আমরা জানিÑ ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য ও শিল্পের লিখিত বা লেখকের বাস্তব জীবনের অনুভূতি হচ্ছে সাহিত্য। পদ্য হলো সাহিত্যিক ধারার একটি রূপ আর কবিতাই হলো পদ্যের মূলত মুখ্যরূপ। জীবনের সাথে সম্পর্কিত সব ধরনের কর্মকাণ্ড, বোধ, চিন্তা-চেতনা, রূপকথা কবিতার মাধ্যমে কবিরা উপস্থাপন করেন পাঠকদের সামনে। জীবনের ওপর বেশি প্রভাব বিস্তারকারী ঋতুটি কবিতায়ও বেশি প্রভাব বিস্তার করবে সঙ্গতকারণে। প্রশ্ন উঠে গেল, তাহলে বর্ষাই কি আমাদের জীবনে বেশি প্রভাব ফেলছে? আমার মনে হয়Ñ হ্যাঁ, অন্য সব প্রাকৃতিক আচরণের চেয়ে বর্ষাই আমাদের মন ও জীবনযাত্রার ওপর সেই আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বহুমাত্রিক রূপে প্রভাব ফেলে আসছে। বাংলা সাহিত্যের যুগবিন্যাসের ধারাবাহিকতায় এখন আমরা বর্ষার উপস্থিতি একটু দেখে আসি!
বাংলা সাহিত্যের যুগবিন্যাস আমাদের জানা আছেÑ প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। প্রায় সব যুগের সাহিত্যকর্মে বর্ষার উপস্থিতি দেখা যায়! চর্যাপদে সরাসরি বর্ষা ঋতুর উল্লেখ নেই সত্য, তবে বর্ষাকালে মানুষের জীবনচিত্রের আঁচ পাওয়া যায়। চর্যায় নদী ও নৌকা-সংক্রান্ত রূপকের সংখ্যাধিক্য, গুণটানা, দাঁড়টানা, পাল তোলা, উজান বাওয়া প্রভৃতি বারবার চর্যায় উল্লিখিত হয়েছেÑ যার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে বর্ষাকালে ভর যৌবনা নদী ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি রূপ পাওয়া যায়। ৩৮তম পদে দেখা যায়Ñ
‘কায় ণাবডহি খান্টি মন কেরোয়াল।
সদগুরুবচণে ধর পতবাল।’
অর্থাৎ- কায় হইল ছোট নৌকাখানি, মন হইল কেরোয়াল। সদগুরু-বচনে পতবাল (পাল) ধর। (অনুবাদ : সুকুমার সেন)
এবার মধ্যযুগের কবিতায় বর্ষার রূপমা-উপমা কেমন তা একটু দেখা যাক। মধ্যযুগের প্রথম নিদর্শন বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনÑ আনুমানিক ১৪ শতকের শেষার্ধে বা ১৫ শতকের প্রথমার্ধে বড়ু চণ্ডীদাস রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী অবলম্বনে এ কাব্য রচনা করেন। এখানে বর্ষাকালের স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনÑ
‘আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মেঘ/বরিষে যেহ্ন/ঝর এ নয়নের পানী।/আলবড়ায়ি/সঙপুটে প্রণাম করি দুইলোঁ সখিজনে/কেহো নান্দ কাহ বনঞিকে আনী।’
এটি বর্ষা বিরহের পদাবলির অন্যতম নজির। কালিদাসও মেঘ-বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ‘কালকেতু উপাখ্যান’-এ ফুলরার ১২ মাসের দুঃখ বর্ণনায় বর্ষাকালের বিবরণে জানাচ্ছেনÑ
‘আষাঢ়ে পুরিল মহী নেবেমেঘে জল।
বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বর।’
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রধান কাব্য মনসামঙ্গল বা পদ্মা-প্রাণ। বর্ষার প্রকোপে এ সময় সাপের বিচরণ বেড়ে যায়, তাই সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভক্তকুল দেবীর আশ্রয় প্রার্থনা করে। এ ছাড়া মধ্য যুগের অমূল্য সাহিত্য ময়মনসিংহ গীতিকা। এখানেও বর্ষা ঋতুর উপস্থিতি দেখা যায়। যেমনÑ দেওয়ানা মদিনা পালায় আছেÑ
‘আইল আষাঢ় মাস লইয়া মেঘের রাণী।।
নদী নালা বাইয়া আইসে আষাঢ়িয়া পানি।।
শকুনা নদীতে ঢেউয়ে তালেপার করে।
বাণিজ্য করিতে সাধু যত যাহে দেশান্তরে।।’
আধুনিক যুগের কবিদের কবিতায় ঋতুবৈচিত্র্য ফুটে উঠেছে কমবেশি সবগুলোরই তবে বর্ষা এবং বসন্ত বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এই সময়ে মহীরুহ বৃক্ষের মতো বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুকে নিয়ে প্রচুর কবিতা, গল্প, গান লিখেছেন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কখনো কখনো আবার বর্ষার কবিও বলা হয়ে থাকে।
রবীন্দ্রনাথের বহু জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নববর্ষ, সোনার তরী, আষাঢ় সন্ধ্যা, আষাঢ়, ‘বর্ষামঙ্গল’ প্রভৃতি। ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ

‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়,
এমন মেঘস্বর বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়...’
নজরুল, জীবনানন্দ, জসীম উদদীন, ফররুখ থেকে শুরু করে সমসাময়িক প্রায় সব প্রথিতযশা কবিদের কবিতায় বর্ষা স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন আঙ্গিকে। সুফিয়া কামাল, রফিক আজাদ, আহমদ রফিক, অমিয়সহ ওপার বাংলার বাঙালি কবি কেউই বর্ষার বন্দনা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। পাওয়া যাবে না এমন একজন কবি যে তার কবিদশায় বর্ষা নিয়ে একটি পয়ার লেখেননি, বর্ষাকে উপমা করে লেখেননি একটি ছত্র। এসব কবিতার দুই চরণ দিলেও কয়েক হাজার পৃষ্ঠা হবে বৃষ্টির পদাবলি পূর্ণ।
সুতরাং পরিশেষে আমরা বলতে পারিÑ মানুষের সহজাত জীবনাচার এবং জীবনবোধের ওপর বর্ষার অসম্ভব রকম প্রভাবের কারণে বাংলা কবিতায় বর্ষার বহুরূপী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। পাঠকমনের, কবিমনের এভাবে সমন্বিতভাবে সব মানুষের সুখ-দুখ, প্রেম-বিরহ, ভালো থাকা-মন্দ থাকা বর্ষার পঙ্ক্তিমালায় সাজানো আছে, থাকবে বাংলা সহিত্যে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এবং আরো সমৃদ্ধ হবে কবিতাকুঞ্জ বাংলার বৈচিত্র্যময় সাহিত্যকাননে।

 


আরো সংবাদ



premium cement