প্রাণশক্তির উজ্জীবন নীতিকবিতায়
- মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ হাসসান
- ০৩ জুলাই ২০২০, ০০:০০
জীবন সফলতার সব কিছু যেখানে ঠাসা, তার নাম নীতিকবিতা, নীতি ও নৈতিকতার কবিতা। নীতিকবিতা আমাকে নিজের কথা মনে করিয়ে দেয়, পরের কথাও ভুলতে দেয় না। নীতিকবিতা আমাকে জাগায়, আমাকে ভাবায়। সুখরসে ভরিয়ে তোলে নীতিকবিতা, প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত করে।
নীতিকবিতা আমাকে শেখায়Ñ আকাশ ও জমিন হতে, সূর্য ও চাঁদ হতে; পাহাড় ও বায়ু হতে; খোলা মাঠ ও মাটি হতে; আদিগন্ত দিগন্ত হতে; সাগর-নদী-ঝরনা হতে; হতে হতে আরো হতে ...।
আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান- হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে- দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয় আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে, মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর- অন্তর হোক রতœ-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে পাষাণ দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে, গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা আমায় দিল ভিক্ষা।
নীতিকবিতা ছিল আদি বাংলা কবিতার প্রধান ফর্ম ও টার্ম। যারা নীতিকবিতা লিখতেন তাদের কদর ছিল সমাজে তুঙ্গে। সে কবিতার মানুষের মুখে-মনে ঘুরে ফিরত এক চঞ্চল মমতায়। একসময় পাঠ্যবইয়ে গুরুত্বের সাথে পড়ানো হতো। এখন তা-ও নেই। কারণ নীতি ও নৈতিকতার কথা থাকলে কি আধুনিক হওয়া যায়? পাঠ্যপুস্তকও এখন নানা কৌণিক নৈরাজ্যের জাজ্বল্যমান জলরঙা ছবি।
হাতের কাছে নীতিকবিতার একটি বই রাখুন। যখনই দুঃখ-হতাশা আপনাকে আঘাত করতে চায়, তখনই যেকোনো একটি পৃষ্ঠা খুলে পড়তে থাকুন, দেখবেন আপনি নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হয়ে উঠছেন। নীতিকবিতার একাধিক সঙ্কলন বের হয়েছে। চারটির নাম দিচ্ছিÑ নীতিকবিতা সংগ্রহ, মোহাম্মদ আবদুল হাই, সূচিপত্র, ঢাকা, বাংলা সাহিত্যের সেরা উপদেশমূলক কবিতা, বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র, উপদেশের কবিতা, বিশ^সাহিত্য কেন্দ্র, নীতিকবিতা সঙ্কলন, সমর মজুমদার।
নীতিকবিতার একটি সুবিধার দিক হলো, নীতিকবিতা ধর্মমতের জের ধরে চুলোচুলি করতে হয় না। নীতিকথা সর্বদলিক, সর্বধার্মিক ও সর্বমানবিক। পড়ুন জসীমউদ্দীনের এই কবিতা :
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী;-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি;
দীঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হয়েছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।
এ কবিতা কোন দলের, কোন ধর্মের, কোন ইজমের? না, কোনো দল-ধর্ম-ইজমের নয়। এ-কবিতা যেকোনো ভাষার, যেকোনো ধর্ম-মতের মানুষের জন্য। বিশ্বের যেকোনো ভাষায় এর অনুবাদ করা হলে, নীতিবান মানুষমাত্রই তা সাদরে গ্রহণ করবে। প্রত্যেকই এ ধরনের কবিতায় খুঁজে পাবে স্বভাবধর্মের এক সোনালি ফসল। সুখে-সঙ্কটে, আনন্দে-বিষাদে দেখতে পাবে মনের একখণ্ড বলিষ্ঠ-বাস্তব প্রতিচ্ছবি।
আমরা যারা আলস্যের নিঃশেষ নিদ্রায় ডুবে আছি, চতুর্দিকে বাঁশরী বাজলেও জাগার বাসনাই যাদের নেই; তাদেরকে নীতিকবিতা আর্তচিৎকারে ডাকছে Ñ
আর কবে তুমি উঠিবে ভাই?
সকলি উঠেছে; সকলি জেগেছে;
জাগিতে কি তব বাসনা নাই?
আর কবে তুমি উঠিবে ভাই?
দিকে দিকে শুন গভীর স্বননে
হরষে বাঁশরী বাজিছে সঘনে
সকলি উঠেছে এ শুভ লগনে
কেহই যে আর ঘুমিয়ে নাই
আর কবে তুমি উঠিবে ভাই?
যাহারা জগতে ছিল চির দীন
নিতান্ত নবীন অথবা প্রাচীন
আর কেহ দেখ নহে আর হীন
নব যুগ ভবে এসেছে ভাই
জাগিতে কি তব বাসনা নাই?
একজন সব কিছু পারছে। তাহলে আমি কেন পারব না? আত্মাবিশ্বাসকে বলীয়ান করতে হবে। নির্জীব আত্মাকে জাগাতে হবে। ভয়-বাধা-হতাশার পাষাণপুরী চূর্ণ-বিচূর্ণ করলেই অগ্রসর হওয়া যায়। এ জন্য নিজের ভেতর ঘাপটি-মেরে-থাকা বদ-অভ্যাস ঝেঁটিয়ে বের করতে হবে। লড়তে হবে আমরণ। করতে হবে নতুন নতুন পণ। তাই বলি, নীতিকবিতায় ভরসা রাখুন।
চাই শৌর্য, চাই বীর্য, তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ কর এই পণ
বিপদ আসিলে কাছে হবে আগুয়ান
দুই খানি বাহু বিশ্বে সবারি সমান।
...........................................
আত্মোন্নতি সাধনের পথ সুনিশ্চয়Ñ
অনুৎসাহ, অলসতা, নিদ্রা-তন্দ্রা-ভয়
ক্রোধ-লোভ-মোহ আদি দোষ পরিহার
পারদর্শী হবে তবে এই জেনো সার।
মানুষের জীবন সুখ-দুখের ঘূর্ণাবর্তে ঘোরে। জীবনে অবিমিশ্র আনন্দ বলতে কিছু নেই। হতাশার গনগনে গুঞ্জন তো জীবনযাত্রীদের মাঝে থাকবেই। সুখ-সঙ্কটের এ চক্করে আমি-আপনি সবাই সমান। এ জীবনে আঘাত ও সঙ্ঘাতের অমোঘত্ব মেনে নিয়েই অগ্রসর হতে হয়। এ জগতে চিরসুখী কেউ-ই নেই। হওয়া সম্ভব নয়। তাই
কোন জন এ জগতে/চিরসুখী সর্বমতে
অসুখের টের কিছু কখনই পায়নি।
কে কোথায় চিরদিন/শান্তি-সুধা-সিন্ধু লীন
অশান্তির উষ্ণ নীরে এক দিন নায়নি।
কার আশা অবিরত/পূর্ণ হয় ইচ্ছামত
কোন আশা কোন দিন ব্যর্থ হয়ে যায়নি।
এমন সৌভাগ্য কার/নিয়ত সুখ্যাতি যার
অলীক নিন্দার বোঝা একবার বয়নি।
ভয় আপনাকে ঝাপটে ধরেছে। ধরাশায়ী হয়ে কাতরাচ্ছেন আপনি। ভয়কে জয় করার মন্ত্রও কেউ শেখাচ্ছে না। তখন আপনি মনের সুখে জপতে থাকুন,
তুফানে পড়িয়া মাঝি হাল যদি ছাড়ে
তার কাছে নদীর তরঙ্গ আরো বাড়ে
নিরাশ হইয়া রোগী ওষুধ না খায়
দিনে দিনে রোগ তার আরো বৃদ্ধি পায়।
নিঃস্বার্থে ও নিঃশর্তে সৃষ্টির সেবা করার মতো কাউকে আপনি পাচ্ছেন না। মনে খুব দুঃখ। আবার কেউ আপনার সাথে হিংসে-বিদ্বেষের আচরণ করছে। অথবা আপনার মনে পক্ষপাতের মতো মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টি হয়েছে, আপনি আধ্যাত্মিক চিকিৎকসের সন্ধান করছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না, তখন বিশ্বকবি হাফেজ সিরাজীর কণ্ঠের আপনি কণ্ঠ মেলাতে পারেন :
কিন্তু ফলশালী হলে এ তরুগণ
অহঙ্কারে উচ্চশির না করে কখন
ফলশূন্য হলে সদা থাকে সমুন্নত
নীচ প্রায় কার ঠাঁই নহে অবনত
হাফেজ! করিবে যদি মহত্ত্ব প্রলাভ
তরুর সমান কর আপন স্বভাব।
সার্বিক নীতিভ্রষ্ট ও নীতিশূন্যতার এ কালিমাচ্ছন্ন সময়ে নীতিকবিতারই প্রবল প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যাতে ব্যক্তিতে, সমাজে, বিশেষ করে আমাদের সমাজের তরুণ ও কিশোরদের মাঝে নৈতিকতার নতুন জাগরণ সূচিত হয়। যুগের দোহাই দিয়ে যেন আমরা বাঁচার চেষ্টা না করি। কোনো বিষয়ে ‘আমি পারব না’ কথাটি যেন আর মুখ থেকে বের না করি :
পারিব না এ কথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার।
................................................
গোলাপে ছিঁড়িয়া কেহ কি পেরেছে হাসি তার কেড়ে নিতে?
ধুলায় পড়েও হাসি ফোটে তার পাপড়িতে পাপড়িতে! হ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা