২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বেদনার দোলাচল

-

হ্যালো-ও, কে তিতির?
হ্যাঁ মা, তিতির বলছি। তোমার আক্কেলটা কী? মোবাইল ফোনটা কাছে রাখতে পার না? এক ঘণ্টা ধরে ট্রাই করে করে অস্থির হয়ে গিয়েছি। ওদিকে নিশ্চয় তোমার মোবাইল ফোনটা কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলেছে। আর তোমার কোনো খবরই নেই? বাবা এমন অসুস্থ, ভাই-বোন তিনজন থাকি দেশের বাইরে। কে কখন ফোন করে, তাছাড়া আমরা কে কোথায় থাকি কেমন থাকি, এসব চিন্তা করেও তো মোবাইলটা ঠিকঠাক রাখতে পারো।
আর মোবাইল! ওটার দিকে নজর দেয়ার টাইম আছে? সংসারের কাজকর্মের ভিতর ঘুরতে ঘুরতে লাট্টু হয়ে গেলাম। তার উপরে একজন রোগীর দেখভাল করা। তোরা তিনজন না হয় বিদেশে, বাকিদেরও তো দেখতে হয়।
তোমার যেই কথা। আমাদের বাংলাদেশে আবার হোম মেডের অভাব? থাকতে যদি আমেরিকায় তখন কী বলতে? সারা বছরই তো তোমার একজন ছোটা, আর একটা বাঁধা মেড থাকেই। তাও তুমি লাট্টু।
আর কাজের লোক। এগুলোর অত্যাচারে জর্জরিত। এরা না থাকলে যেন অথৈ সাগরে পড়ি। আবার থেকে যা করে, তাতে ছেড়ে দে কেঁদে বাঁচি অবস্থা। অবশ্য ভালো কাজের মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার এবারের ভাগ্যের খুবই খারাপ অবস্থা। তা-ও রেখেছি মোটে নাইয়ের চেয়ে আছে ভেবে সান্ত্বনা পুরস্কার বলতে পারিস।
বাদ দে ওসব। তুই কেমন আছিস? আমার নানু ভাইয়েরা কেমন আছে?
তোমার নানু ভাইয়েরা একেকটা পাজির পা ঝাড়া হয়েছে। দুটোয় মিলে যত রকমের শয়তানি আছে সব ট্রাই করছে। ঠিকমতো খাবার খাবে না। ওদিকে আইসক্রিম, চকোলেট, বার্গার আর কত কিছুর যে বায়না ধরে বসে থাকে ভাবতে পারবা না। বায়না পূরণ না করলে স্কুলে যাবে না বলে বিছানায় লেপ্টে থাকে। অবশ্য যেখানকার যেমন চল, পুরো তো আর মাছে ভাতে বাঙালি করতে পারব না। সে না হয় পারলাম কিন্তু মা তুমি দিনে দিনে ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছ কেন? একবারও জিজ্ঞেস করলে নাতো তোমার জামাই কেমন আছে? যে তোমার মেয়েকে আমেরিকার মতো জায়গায় রানীর হালে রেখেছে তার খবরই তো আগে রাখার দরকার? মাকে কোনো কৈফিয়তের সুযোগ না দিয়েই বলল, বাদ দাও। মা নাহিয়ান কোথায়? ফোন ধরছে না। মেসেজ দেখছে না। স্কাইপিতে বাবার সঙ্গে কথা বলব।
নাহিয়ান তো দুপুরে খেয়ে ঘুমাচ্ছে, তোর বাবাও।
ঘুমাক। ডেকে তোলো। বাবাকে ডেক না আমি শুধু চোখের দেখা দেখব। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে চোখের ঘুম আমার হারাম হয়ে গেছে। দিনরাত এক হয়ে গেছে। এখন কত রাত জানো? তোমাদের চোখে এত ঘুম আসে কোত্থেকে? বাহ্ মানুষও তোমরা! ফোন রাখছি, যাও নাহিয়ানকে ডেকে তোলো।
ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বেড়াল পায়ে নাহিয়ানের রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবে মেয়েটা এমন গভীর ঘুম দিয়েছে, কিভাবে ডাকি। ওদিকে তিতিরটাও তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। আলতো করে পিঠে হাত দিয়ে বলে তুই কি ঘুমাচ্ছিস?
না-মা সুইমিং করছি। উ-হ-হু-মা ঠিকঠাক মতো ঘুমাতেও দিবা না, ডিজগাস্টিং।
তোর বড় আপা ফোন দিয়েছে। স্কাইপি অন করে বাবার রুমে যা।
এখন? ঘুম নষ্ট করে?
তিতির তো বলল ও নাকি ঘুমাতে পারছে না। আমরা এত ঘুমাই কী করে?
অ্যাহ ঢং! কাছে থেকে রাত জাগত, যখন তখন ডাক্তারের কাছে দৌড়াত বুঝত কেমন। দূরে থেকে কত কিছু বলা যায়।
স্কাইপিতে ঘুমন্ত বাবাকে দেখে সে কী কান্না। বুকের গভীর থেকে কষ্টের কান্না ও বাবা তুমি ভালো থেকো তোমার কিছু হলে আমরা বাঁচব কী করে? বুকের ভিতরটায় বড় কষ্ট হয় বাবা। আমরা আসছি বাবা তোমাকে দেখতে চিন্তা করো না।
নাহিয়ানেরও চোখে পানি আসে। তিতিরের মন অন্য দিকে ডাইভারট করতে নিজের রুমে চলে আসে। এসে বলে কেন চিন্তা করবে না আপা? তুমি কি আমেরিকা থেকে নার্স, ডাক্তার নিয়ে আসবে?
কান্না থামিয়ে তিতির বলে, তুই কি মুখে পিন নিয়ে বসে থাকিস? বিষাক্ত খোঁচা মারা কথা। তুই জানিস না বাবা আমাদের দেখলে অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। তা ছাড়া আমরাও তো বাবার দেখাশোনা করতে পারব। তুই কি একাই সব সোয়াব পেতে চাইছিস?
শুধু সোয়াব কেন আপু সয় সম্পত্তিও।
অ্যাহ সম্পত্তি! তোর বিয়ে কি ফকির কাঙ্গালের কাছে দেবো? সম্পত্তির আসায় হাত পেতে বসে আছিস। বাবাকে বলব সব বেচেটেচে খেয়ে মরতে।
তাহলে আপা এবার আসার সময় আমার জন্য একটা বর নিয়ে এসো। আমিও তোমাদের মতো বিদেশে সেটেল্ড হবো।
অ্যাই থাম। তুই আমাকে ছাগল ভাবছিস? ফেসবুকের সুন্দর সুন্দর ছবি, কমেন্ট এটা সেটা দেখে কিছু বুঝি না? আমায় আগে আসতে দে তোর খবর আছে।
নাহিয়ান বুঝতে পেরেছে যে, মৌচাকে ঢিল পড়েছে। দ্রুত পায়ে বাবার রুমে এসে বলে, বাবা জেগেছে নে কথা বল।
শুরু হয় বুকফাটা কান্না। বাবা তুমি চিন্তা করো না। আমরা ভাই-বোনেরা সবাই আসছি, প্রসেসিং চলছে। কয়েক দিনের মধ্যেই চলে আসতে পারব। তুমি ঠিকঠাক মতো খাবার খেও। এই বয়সে ডিম- দুধটা রেগুলার করতে হয়।
শরীরের ঘাটতি পূরণ তো করতে হবে, হাড়গোড় ঠিক রাখতে হবে তবে দুধের সর ডিমের কুসুম খেও না।
হ্যাঁরে মা, ওসব ডাক্তার বলেছে।
বললে কী হবে? মানতে হবে তো। বাবা আমাদের আসা অবধি ওয়েট না করে এনজিওগ্রামটা করে ফেললেই ভালো হয়।
না-না অত তাড়াহুড়োর দরকার নেই। তোরা আয়, তা ছাড়া আমি চাচ্ছি এনজিওগ্রাম করে সাথে সাথে যে কয়টা রিং লাগে পরে ফেলব। দু-দু’বার কষ্ট ও খরচের চেয়ে এক সেটিংই ভালো।
নো বাবা নো। কষ্টের চিন্তা করো ঠিক আছে। কিন্তু খরচের চিন্তা করো না।
সপ্তাহখানিকের মধ্যে তিন ভাই-বোনই চলে এলো। ঢাকার নামকরা প্রাইভেট হসপিটালে ভর্তি হয়েছে। আত্মীয়স্বজনেরাও ছুটে এসেছে। কারো হাতে তসবিহ, কেউ দোয়া দরুদ পড়ছে, কেউ নামাজে বসে আছে, কারো চোখে জল টলমল করছে। আবার কেউ কেউ আলোচনা সমালোচনার ঝড়ও তুলছে ওয়েটিং রুমটিতে।
ওনারে কী বলব আর! লাইফ স্টাইল যাদের ঠিক নেই ওদের অসুখ বিসুখ হবে না তো কাদের হবে?
মুরব্বি গোছের এক মহিলা দীর্ঘশ^াস ফেলে বলেÑ এ জন্য ঘরের বউ-রাই দায়ী। বেশি বেশি তেল খাইয়ে কোলেস্টেরল ধরিয়ে দেয়।
লবণ খাইয়ে হাইপ্রেশার বাড়ায়। ঝাল খাইয়ে গ্যাস্ট্রিক আলসার বানিয়ে দেয়। আর মিষ্টি জিনিসের তো তুলনাই নাই। যেমন রান্না করে তেমন কিনে কিনে আনে। ডায়াবেটিস না ধরে যাবে কোথায়? ঘরে ঘরে ডায়াবেটিসের ডিব্বা।
পাশ থেকে অল্প বয়সী এক তরুণী বলে, হ্যাঁ খালাম্মা, আপনার লাইফ স্টাইল তো ভালো। তবে কোনো রোগই তো আপনার বাদ নেই।
আরে বয়স হয়েছে, বার্ধক্যতো আসবেই। রোগব্যাধি না এলে মরব কোন উছিলায়?
নীলু সব শোনে আর দীর্ঘশ^াস ফ্যালে।
হসপিটাল থেকে বাড়ি আসার পর তিনটি রিং পরিয়ে আত্মীয়স্বজন, পড়শি, বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ, দূরের মানুষ, পালা করে আসছে যাচ্ছে। সমবেদনা ব্যথিত হচ্ছে। অনেকে আবার মোটামুটি ডাক্তার কবিরাজ হয়েই আসছে। এভাবে না, ওভাবে, ওভাবে না সেভাবে। এটা খাবে না ওটা খাবে। তিতিরের মাকে বলে রাতে আবার নাক ডেকে ঘুমিও না। রোগীর দিকে নজর রেখো। সময়মতো মেডিসিন দিও। খাবারদাবার বুঝেশুনে দিও। হাতে পায়ে তেল ঘষে দিও আরো যে কত কী! বিশেষ করে আ-হা-উহুর তাড়নায় চারদিকের ভালোবাসায় রোগীর হৃদয় দুঃখ বিলাসিতায় টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। আর সেই দুঃখের পেছনে একজনই দণ্ডায়মান তার পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনের স্ত্রী নীলুফার।
সে তো মুখে কিছু বলেনি হসপিটালে রোগীর সাথে থেকে, খেয়ে না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সেবা যতœ করেছে, কষ্ট পেয়েছে, ভালোবেসেছে, নিজের জীবনের বিনিময়ে স্বামীর জীবন ভিক্ষা চেয়েছে, কারো চোখে তো পড়লই না, যার জন্য করল তার চোখে তো পড়লই না, বরং বৃত্তের ভিতরে কোনা খুঁজতেই থাকে খুঁজতেই থাকে।
নিজেকে বড় ব্যর্থ মনে হয় নীলুর। স্বামীর কঠিন চেহারা আর ঔদাসীন্য বেদনায় আচ্ছন্ন করে রাখে। তার কষ্টের উচ্ছ্বসিত অশ্রু সংবরণ হয় আবার হয়ও না।
সংসার, ছেলেমেয়ে, স্বজন, রোগী আরো কত কী সব মেইনটেন করতে করতে ঝিমিয়ে পড়ছিল নীলু। ঝিমুতে ঝিমুতেই সংসারের হালখানা ধরেই রেখেছিল শক্ত হাতে। হঠাৎ একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেল। যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ করে নিয়ে এসেছিল স্বামীকে, সে-ই হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে রোগী গেল নিজেই।
প্রথম দিন টেস্টের জন্য সব করা হলো। দ্বিতীয় দিনে বেশির ভাগ রিপোর্ট পাওয়া গেল। ডাক্তার বলল, ওনার তো অনেক সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার, শ্বাসকষ্ট , হাড় ক্ষয় ভিটামিন এ, বি, সি, ডি সবই প্রায় শেষ। ওনাকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়াবেন, সাথে পথ্য, খাবারের চার্ট দিয়ে দিচ্ছি মেইনটেন করবেন। হালের গরু যেমন চাষ ঠিকই করে, তবে মাঝে মধ্যে বসে যায়। পিছন থেকে হাঁট, হাঁট শুনলে তবে আবার হাঁটে। অনেক রোগী আছে নিয়মিত কিছুই করে না বিশেষ করে মহিলারা। উনাদের আপনারা পিছন থেকে একটুু হাঁট হাঁট বইলেন। না হলে সব রোগ মিলে জটিল হয়ে উঠলে যে কোনো সময়ে ধপাস করে পড়ে সময়ের আগে অসময়ে জায়গামতো চলে যাবে।
বাড়িতে আসার পর থেকে সবাই মাস্টার বনে গেল, এটা করো না, ওটা করো না, হাঁটতে হবে দৌড়াতে হবে। জিহ্বায় দড়ি বাঁধতে হবে। ঘুম কমাতে হবে আরো কত কী?
নীলু বলে, আমার এতসব ব্যাধি শরীরে কখন বাসা বাঁধল টেরই পেলাম না।
আহ-মা, ওরা কি তোমার বাড়ির ভাড়াটিয়া যে অ্যাডভান্স করে ভোটার আইডি কার্ড জমা দিয়ে সঠিক ডেটে উঠবে। সুগার যাকে ধরে তার বারোটা, এটা হয়েছে নীরব ঘাতক। নীরবে আসে সরবে যায়, যায় কি একা? রোগীকে নিয়েই যায়। তবে কন্ট্রোল করলে সুস্থ লোকের চেয়েও ভালো থাকতে পারা যায়।
নীলু ওষুধ পথ্য খাওয়া শুরু করল যদিও আস্তে আস্তে সব গোলমেলে হতে লাগল। এ বেলায় খায়তো ও বেলায় ভুলে যায়। কখনো কখনো মনে পড়লে ও সময়ের অভাবে খেতে পারে না। ছেলেমেয়ে এত দিন পরে এসেছে, কিছু দিনের মধ্যে চলেও যাবে। ওদের যতœাদি রান্নাবান্না রোগীর জন্য আলাদা রান্না, রোগী দেখার যত আত্মীয়স্বজন আসে তাদের মন জোগানো, নীলুর ব্যস্ততা গেল প্রচণ্ড বেড়ে। এ দিকে রোগী দেখতে এসে রোগীর সামনে বসে সতীর আমলের আষ্টিকালের কষ্টি কথার কলের গান বাজায় তো বাজায়। কলের গানের শেষ কথা যত দোষ নন্দ ঘোষ, ঘরের বউয়ের চলা ফেরা সেবা যতেœ পুরুষের হায়াত। সতী নারীর পতি মরে না। এরকম কথা শুনে স্বামী বেচারা ফুলে ফেঁপে গ্যাস বেলুন হবার দশা। ঢাক ঢোলের বাড়িটা তো আমার স্বজনরা ঠিক মতোই দিচ্ছে। নাচুনি বুড়ির কাজটা কেনইবা আমি বাদ দেবো? হেলে দুলে তালে, তালে, একটু নেচেই নেই। ছেলেমেয়েদের বলে আমি কথা বললেই তো দোষ, এখন শুন সবাই কেমন বলে। নীলুর দু’চোখের দৃষ্টি আবছায়া হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়েদের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা, দুর্বলতা, বড় বেশি, বাবার কথায় প্রশ্রয় না দিলেও মাকে বোঝায় সবটাতেই বাবাকে নয়।
নীলু ধরা গলায় মাঝে মধ্যেই বলে তোমার হম্বি, তম্বি, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মধ্যেই জীবন পার করছি। যে ঘরে স্বামীর শ্রদ্ধা ভালোবাসার খামতি সেখানে সন্তানদের স্বজনদের ভালোবাসা থাকলেও প্রকাশ করার স্পৃহা থাকে না। কারো যদি থেকেও থাকে অগচরে কিছুটা বেরিয়ে আসে।
অ্যাহ যদি মনে লাগে কষ্ট করে আছো কেন? চলে গেলেই তো পারো।
আমার অপমানের বোধটা ধারাল থাকলেও, মরিচা পড়ে ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই যেতে পারছি না। তবে যেদিন যাবো কেঁদে বুক ভাসিয়েও কূল পাবে না।
মেজো মেয়ে চৈতী বলে, অলক্ষুণে কথা বলবা না তো মা। আর বাবা, অসুস্থ শরীরে এত উত্তেজিত বা কথা বেশি না বলাই ভালো। আর মা তুমিও যেমন! স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা, ঢেকেই রাখলে প্রকাশ করতে পারলে না কোনো দিনও।
এমনভাবে কথা বলো সে কথায় কেউ সন্তুষ্ট হতে পারে না। একটু কৌশলী হলেই হয়। কিন্তু সেটা কোনো দিনও পারলে না।
সত্যি কথাই বলেছিস মা। সবাইকে অন্তর দিয়েই করে গেলাম, মুখ দিয়ে পারলাম না। সবাই যে মুখেরই শুনতে চায় অন্তরেরটা নয়, বুঝতে বুঝতে বড় দেরি হয়ে গেল।
ছেলেমেয়েদের যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। এর মধ্যে দুই জামাইও এসেছে। শ^শুর অসুস্থ বলে কথা, জামাইরাসহ মনপ্রাণ দিয়ে কিছু করার চেষ্টা করে। সবাইকে পেয়ে বাবা আদরে বেশ খুশি। বাবা পাশ ফিরে শুতে গেলে উহ শব্দটা বের হলেই সব দৌড়াদৌড়ি করে চলে আসে, কী হলো, কী হলো? সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা। বাবা হেসে বলে এত চিন্তা করিস কেন তোরা? আমি ভালো আছি।
ছেলেমেয়েরা চোখ মুছে আর বলে বাবা কিছু লুকোবে না। একটু খারাপ লাগলেই বলবে। প্রয়োজনে আমরা তোমায় বিদেশে চিকিৎসা করাব।
অসাড়তা শারীরিক দুর্বলতা অবসাদ গ্রাস করে টেনে নেয় বিছানায় নীলুকে, ফ্যাকাশে মুখের দিকে চেয়ে তিতিরের বাবা বলে, তোর মায়ের ওষুধ পথ্য কি ঠিকঠাক খাওয়া হয়? নাকি ডাক্তার দেখানো আর পয়সা খরচ করাই সার?
নীলু বেশ খুশি হতে যাচ্ছিল এটা ভেবে যে তার মুখখানা যে ফ্যাকাশে লাগছে সেটা তার স্বামীর চোখে পড়েছে। কিন্তু পয়সার কথা শুনে চোখের পাতা দু’খানা ভিজে উঠল। আর সেটা গোপন করার জন্য নীলু পাশ ফিরে রইল। নীলু একবেলা বিছানায় শোয় তো আরেক বেলা সংসারে কাজে লেগে যায়। এদিকে বিকেল থেকে তিতিরের বাবার শরীর ভালো যাচ্ছে না। ঘরের সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। কেউ প্রেসার মাপে, কেউ ডায়াবেটিস মাপে, কেউ হাত পা ম্যাসেজ করে, কেউ পানি খাওয়ায়। নীলু বসে চোখ মুছে আর আল্লার কাছে দোয়া করে আল্লাহ ছেলেমেয়ের সাথে যাতে দীর্ঘ হায়াত নিয়ে বেচে থাকে তাদের বাবা।
বিকেলে সবাই মিলে বাবাকে নিয়ে গেল ডাক্তারের কাছে। কিছু টেস্ট করে তিন চার ঘণ্টা ভর্তি থেকে চলে এলো বাড়িতে। রাতটা সবাই থাকতে বলল্লেও জোর করেই রোগী চলে এলো। সবাইকে বলল, খারাপ লাগলে আবার আসব নিজের গাড়ি আছে। হসপিটাল কাছে আছে, ভয়ের কিছু নেই।
বাসায় এসে বাবা ঘুমায়। সবাই লাইট অফ করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরের মাঝে শুয়ে বসে আছে পাহারা দেয়ার জন্য। নীলুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তাই সবাই তাকে বলল, যাও মা আমরা তো আছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও তো। বাবার এখানে টেনশনে ঘুমাতে পারবে না। পাশের রুমটায় ঘুমাও, নীলু বাধ্য মেয়ের মতো সেটাই করল।
সকালে তিতির উঠে দেখে ঘরের সব কাজ পড়ে আছে। মায়ের রুমের ফ্লোরে কাজের মেয়েটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তিতির ডাকে মালেকা এই মালেকা বেলা নয়টা বাজে এখনো ঘুমাচ্ছিস?
ধড়ফড়িয়ে মালেকা উঠে বলে প্রতিদিন খালাম্মা ডাক পাইড়া তোলে। আজকা ডাক দেয় নাইতো সজাগ পাই নাই ।
ও ,মা উঠে নাই? মশারির বাইরে থেকে ভেতরে চেয়ে বলে, মা, ও মা, ওঠো নাই কেন? বাবার নাস্তা দিতে হবে না? ওষুধ নিয়ে বসে আছে । ঘরে জামাই টামাইরা আছে ওদেরও তো নাস্তা দিতে হবে। মায়ের সাড়া নেই । আবারো ডাকে, শেষে মশারি তুলে মায়ের গায়ে ধাক্কা দিয়েই বোঝে মা দুনিয়া ছেড়ে চিরস্থায়ীর বাসিন্দা হয়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।
ঘটনার আকস্মিকতায় এমনই বিমূঢ় হয়ে যায় সবাই, প্রথমে কেউ বিশ^াসই করতে পারেনি।
কাচের জানালা গলিয়ে প্রগাঢ় মায়াবী আলোর প্রসরণে ¯িœগ্ধ হয়েছে কামরা, মায়ের লাশের পাশে বসে সবাই কেঁদে ভারী করল সোনালি সকালের নির্মল বাতাস, নীলুর শীতল হাতখানা তার স্বামী নিজের উষ্ণ হাতের মাঝে নিয়ে বলে, এতবড় ফাঁকিটা কেমন করে দিয়ে চলে গেলে তুমি? এরকমটা যে হবে চিন্তাও তো করতে পারিনি কখনো, এতদিন মনে হয়েছে পুরু পৃথিবীটা আমার। পৃথিবীর মানুষগুলো আমার কিন্তু এই মুহূর্তে কেন আমার মনে হচ্ছে এ পৃথিবীতে আমার কেউ নেই, কিছু নেইবড় একা করে গেলে আমায়, বড় শূন্য করে গেলে।
নাহিয়ান হাত পা ছুড়ে কাঁদে বিলাপ করে বলে, মা আমাদের কোথায় ভাসিয়ে দিয়ে গেলে, এ সংসার চলেছে তোমার সাথে আর মা চলেছে সংসারের সাথে। সবার কষ্টের জায়গায় স্নেহের হাতটা মায়ের থাকলেও কেউ সেটা বুঝতেই পারেনি, হয়তো সেটা বোঝানোর জন্যই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে।
চৈতী ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে বলে বাবা আমরা তো যে যার জায়গায় চলে যাবো। নাহিয়ানের বিয়ে হয়ে যাবে, তাহলে তুমি থাকবে কী করে?
দু’চোখ লাল করে কেঁদে কেঁদে তিতির বলে, মার সঠিক মূল্যায়নটা আমরা দিতে পারিনি। তুচ্ছ তাচ্ছিলের মধ্যেই মার জীবনটা কাটছিল। জীবনের সুন্দর সময়গুলো সবার পেছনে ব্যয় করলেও কারোই সময় হয়নি তাকে একটু সময় দেয়ার।
আত্মীয়স্বজন পাড়াপড়শিতে ভরে গেল বাড়িঘর।
তিতিরের বড় খালা বুক চাপড়ে কেঁদে বলে পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল আছে যাবার কেন নেই? আমায় ফেলে আমার ছোট বোনটা কেন আগে চলে গেল? তিতিরের বাবার দিকে চেয়ে বলে, একজন নারীর শরীর পুরুষের সাময়িক প্রয়োজন হলেও একজন নারী ও তার ভালোবাসার প্রয়োজন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত । বেঁচে থাকতে কেউ বোঝে না।
অতিরিক্ত চিন্তা, পরিশ্রম নিজের দেহের অযতœ, অসময়ে আহার নিদ্রাই তাকে নিয়ে গ্যাছে আমাদের মাঝ থেকে। তোরা এত ব্যতিব্যস্ত আর আনন্দে ছিলি বাবাকে নিয়ে যে, মায়ের দিকে ফেরার সময়ও পেলি না। পিছন দরজা দিয়ে চুপিসারে চিরতরে চলে গেল মা, তোরা টেরও পেলি না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement