১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জাফর আলম তাঁর সাহিত্যকর্ম

-

বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের ধারায় জাফর আলমের নাম অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। তিনি শুধু অনুবাদকই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক। গত ২০ জুন ২০২০ তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান বিধাতার সান্নিধ্যে।
জাফর আলমের জন্ম ১৯৪৩ সালে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। স্কুল জীবন থেকে তার লেখালেখি ও সাংবাদিকতা শুরু। পঞ্চাশের দশকে তিনি সাপ্তাহিক পল্লীবার্তা (পরবর্তীকালে পূর্বদেশ), দৈনিক সংবাদ এবং তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমানে বাংলাদেশ অবজারভার ) এবং বগুড়া জেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। তার শিক্ষা জীবনের শুরু হয়েছিল মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে। আর কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা দিয়ে। ১৯৬৪ সালে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানে (অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলা) সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দৈনিক জনপদে সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে সরকারি নির্দেশে দৈনিক জনপদ বন্ধ হয়ে গেলে তিনি ১৯৮০ সালে সংবাদপত্রের উদ্ধৃত সাংবাদিক হিসেবে তথ্য অধিদফতরে তথ্য অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ইতঃপূর্বে তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্র প্রকাশনা অধিদফতরের কপি রাইটার হিসেবে কাজ করেন। প্রকাশনার ক্ষেত্রে ছিল তার বিশেষ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা।
আশির দশকে সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে সাফল্যের সাথে কাজ করেছেন। তাছাড়া তিনি তথ্য অধিদফতরের সংবাদ কক্ষে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ডিউটি অফিসার হিসেবে দক্ষতার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাসে কাউন্সিলর (প্রেস) দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তিনি পশিমবঙ্গে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। কলকাতার বইমেলায় বাংলাদেশের প্রথম অংশগ্রহণ, কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশী চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন, জামদানি প্রদর্শনী এবং কলকাতা উপ-দূতাবাসে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের শিল্পীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, বাংলাদেশের উৎসবের আয়োজন এবং কলকাতার পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে তুলে ধরার জন্য জাফর আলম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া কবি নজরুলের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি কলকাতা থেকে সংগ্রহের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ বাস্তুহারা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কাশ্মির, পাঞ্জাব ও বৃহত্তর বঙ্গভূমি। তখন সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, কৃষণ চন্দরসহ ভারত ও পাকিস্তানের প্রগতিশীল লেখকেরা এই দাঙ্গার বিরুদ্ধে কলম ধরেন। জাফর আলমের অনুবাদের মাধ্যমে আমরা সেসব লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত হই। তিনি অনুবাদ করেছেন মূল উৎস ভাষা থেকে। উর্দু সাহিত্যের মূল্যবান লেখাগুলো আমরা তার কাছ থেকেই পাই। উর্দু ভাষার প্রতি কবি শামসুর রাহমানের ভালোবাসাও ছিল অকৃত্রিম। তাইতো শামসুর রাহমান তার আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন,
‘আর হ্যাঁ, আমিও উর্দু কবি ও কবিতা বিষয়ে সামান্য খোঁজখবর রাখতাম। এখনো রাখতে চেষ্টা করি, তবে দক্ষ অনুবাদক জাফর আলম সাহেবের ধারে কাছে যাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। উর্দু কবিতা বিষয়ে ঈর্ষাযোগ্য তার জ্ঞান। এই ভাষার বিভিন্ন কবির প্রচুর ভালো কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন বাংলা ভাষায়।’
কালের ধুলোয় লেখা/পৃষ্ঠা-২৬২ )
মুন্সি প্রেমচন্দ, কৃষণ চন্দর, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, ইসমত চুগতাই, কুদরতুল্লাহ শাহাব, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, মুলকরাজ আনন্দ, হেরমান হেসেসহ নানা খ্যাতিসান লেখকের লেখা অনুবাদ করেছেন। প্রেমচন্দের পর উর্দু সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কথাশিল্পী হচ্ছেন সাদত হাসান মান্টো। মান্টোকে নিয়েই তিনি কাজ করেছেন সবচেয়ে বেশি। তার অনুবাদ এত প্রাঞ্জল যে যতই পড়ি ততই মুগ্ধ হই।
জাফর আলমের অনূদিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ কৃষণ চন্দের পেশোয়ার এক্সপ্রেস, মির্জা গালিবের দাস্তাম্বুর, সাদত হাসান মান্টোর প্রবন্ধ সঙ্কলন কাফনের জামা এবং সাদত হাসান মান্টোর গল্প সঙ্কলন টোবাটেক সিং ও অন্যান্য গল্প। তার কিছু বই আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে।
মহান এই মহীরুহের সাথে আমার পরিচয় হয় ১৯১৭ সালে। তার সুচিন্তিত পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমাকে দিয়েছে লেখার ক্ষেত্রে অনেক অনুপ্রেরণা। তার কাছ থেকে জেনেছি আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকদের অনেক অজানা কথা। করেছি সাহিত্য নিয়ে বিস্তর আলোচনা। তার সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে এর আগে কেন তার সাথে আমার দেখা হলো না। বার্ধক্যের কারণে তিনি জরাগ্রস্ত হয়েছিলেন ঠিক কিন্তু চিন্তাচেতনায় তিনি ছিলেন প্রবল আত্মশক্তিতে বলিয়ান।
তিনি ছিলেন পরোপকারী ও অতিশয় মানবিক একজন মানুষ। যখন তিনি মানুষের কথা শুনতেন দরদ দিয়ে শুনতেন। তার অদ্ভুত নিষ্পাপ প্রাণবন্ত হাসিটি আমি ভুলতে পারি না। আস্তে আস্তে আমরা কেমন অভিভাবকশূন্য হয়ে যাচ্ছি। করোনাকালের এই সময়টাতে প্রতিটি ক্ষণ এখন আমাদের শুধুই আশঙ্কায়, উৎকণ্ঠায় কাটে। কখন না জানি কোনো দুঃসংবাদ শুনতে হয়।
অনুবাদের অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন প্রমা সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ১৯৯৭), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (২০০৪), কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ২০০২, কক্সবাজার পদক ২০০৩, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা ... এবং জনসংযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে বাংলাদেশ জনসংযোগ সমতির পক্ষ থেকে জনসংযোগ ব্যক্তিত্ব পদক ২০০৬ প্রদান করা হয়। এমনি বহু গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও সম্মাননা এবং সংবর্ধনায় ভূষিত হয়েছেন। তার আত্মজীবনী বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ২২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
জাফর আলম ছিলেন বাংলা একাডেমির ফেলো/জীবন সদস্য, বিসিএস (তথ্য সাধারণ) সমিতির প্রতিষ্ঠাতা জীবন সদস্য, বাংলাদেশ জনসংযোগ সমিতির সদস্য, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সহযোগী সদস্য এবং কক্সবাজার সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক পরে সহসভাপতি ছিলেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে যাবে কিন্তু তিনি রয়ে যাবেন বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে। অনুবাদ সাহিত্যে তার অবদানের দায় বাঙালি কখনো পরিশোধ করতে পারবে না। আমরা তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আর কবির ভাষায় বলতে চাই,
‘নয়নসমুখে তুমি নাইÑ
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই।’


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ৭ দিন স্কুল বন্ধের দাবি চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বিএনপি সাম্প্রদায়িক শক্তি, এদের রুখতে হবে : ওবায়দুল কাদের সাদিক এগ্রোর ব্রাহামা জাতের গরু দেখলেন প্রধানমন্ত্রী ভারতে লোকসভা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ভোট পড়েছে ৬০ শতাংশ সারা বিশ্ব আজ জুলুমবাজদের নির্যাতনের শিকার : ডা. শফিকুর রহমান মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশী : পররাষ্ট্রমন্ত্রী চন্দনাইশ, বাঁশখালী ও বোয়ালখালীতে ৩ জনের মৃত্যু গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সকল