২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলাউদ্দীন আল আজাদের একটি অপ্রকাশিত রচনা শাহীনের জন্য ভালোবাসা

-

শাহীন রেজাকে আমি আবিষ্কার করি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কবিতা দিয়ে। কবিতাটির নাম আমার মনে নেই, কিন্তু তার বিষবস্তুটা ছিল এরকম, অতিরিক্ত ভালোবাসার শিকল ছিঁড়ে কেউ একজন পালাতে চায়। অতিরিক্ত বিষয়টা তার কাছে সুখের না হয়ে ক্রমশঃ কষ্টের কারণ হয়ে উঠেছে। আর তাই সে এটা থেকে মুক্তি চাচ্ছে। আসলে পৃথিবীতে অতিরিক্ত কোনকিছুই সুখকর হয়ে ওঠে না। বেশি লবণ দিলে যেমন সালুন বিস্বাদ হয়ে ওঠে তেমনি অতিরিক্ত চিনিও পান অযোগ্য করে তোলে উপাদেয় চা কিংবা কফিকে।
এই বিষয়টা সেদিন আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছিল, সেই সাথে ভালো লেগেছিল কবিতাটির শব্দচয়ন এবং উপস্থাপনের সরলতা। তখনও ওর সাথে আমার পরিচয় ঘটেনি। ওকে প্রথম দেখি দৈনিক বাংলায়। তারপর আস্তে আস্তে পরিচয়টা গাঢ় হয়েছে। কবিতায় আজকাল পীর ধরার একটা রেওয়াজ চালু হয়েছে। শাহীনের মধ্যে এই রেওয়াজের ফাঁদে পা দেওয়ার কোন চেষ্টা আমি কখনও দোখিনি। বরং সে সবার সাথেই একটা সুন্দর সম্পর্ক রেখে এগিয়ে চলছে। আমার সাথে যেমন ঠিক তেমনি ফজল শাহাবুদ্দীন, আল মাহমুদ, কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের সাথে আমি তাকে মিশতে দেখেছি নিবিড়ভাবে। তবে ফজলের সাথে তার সম্পর্কটা একটু বেশিই ছিল বটে। হয়তো ফজল তাকে একটু বেশি কেয়ার করতো বলেই এই সখ্যটা গড়ে উঠেছিল।
শাহীন খুব বিনয়ী একটি ছেলে। ঠিক যেন ওর কবিতার মতো। শাহীনের কবিতায় আমি এক ধরনের বিনয়কে আবিষ্কার করেছি। কেউ কেউ বলতে পারেন, ‘কবিতার বিনয়’ - সেটা আবার কি! আমি মনে করি যেকোন সৃষ্টির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য যে বিষয়টি একান্ত জরুরি তা হচ্ছে বিনয়। একাগ্রতার সাথে বিনয় নামক বস্তুটাকে ধারণ করতে পারলে যে কোন সৃষ্টি মহান হয়ে উঠতে পারে। আমিত্ব এবং ঔদ্ধত্য- সৃষ্টির মাহাত্ম্যকে ক্ষুন্ন করে।
শাহীনের যে কবিতার বইটি আমাকে নাড়া দিয়েছিল তার নাম ‘ তোমার জন্য দুপুর'। সে কিছুকাল আগের কথা। নামটির জন্যই সম্ভবত বইটার কথা আমার স্মরণে আছে। ঝরঝর প্রেমের বৃষ্টিতে সিক্ত ছিল বইটির কবিতাগুলো। আমি ফজলের অফিসে বসে এক নিঃশ্বাসে এটি পড়ে শেষ করেছিলাম এবং এক ধরনের ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে ওকে ওয়েলকাম জানিয়েছিলাম কবিতার অঙ্গনে। ‘ও’ না বলতেই কথা দিয়েছিলাম দৈনিক বাংলায় অথবা সংবাদে এটির একটি রিভিউ করে দেবো, কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
আজ যখন ওকে নিয়ে কলম ধরেছি তখন ওর বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। কবি হিসেবে নামও হয়েছে একটু আধটু। আমার সামনে ওর সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি বই। এই বইটির নামও বেশ সুন্দর। ‘ প্রজাপতি ও বালিকারা'। বইটির একটি কবিতার তিনটি লাইন আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। কবিতাটির নাম ‘ আমি ও আমার বৃক্ষ'। লাইন তিনটি এরকম-
‘আমি বৃক্ষের পত্রালি থেকে গ্রহণ করি
জীবনের নির্যাস
কাণ্ড থেকে সাহসের বীজ এবং
শিকড় থেকে নিজের অতীত।’
প্রেমিক শাহীন রেজা'র এ এক ভিন্ন উচ্চারণ। পরিণত এ উচ্চারণ আমাকে শুধু চমকিত করেনি তার সাথে সাথে শাহীনের কবিতার প্রতি আমার মনে তৈরি করে দিয়েছে গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। আমি এখন বলতে পারি পরিণত এই অনুভূতি শাহীনকে একটা নতুন পৃথিবীর সন্ধান এনে দেবে। ‘শেষ ট্রেন’ কবিতাটিতে সে লিখেছে-
'শেষ ট্রেনের যাত্রীরা সারারাত জেগে থাকে
শেষ ট্রেনের হুইসেলে নিশুতির নিদ্রাভঙ্গ'
শাহীন তার কবিতা দিয়ে আমাদের নিশুতির নিদ্রাকে ভঙ্গ করে দিয়েছে। ওর ‘ প্রজাপতি ও বালিকারা’ কবিতাটি নিঃসন্দেহে একটি অন্যরকম কবিতা। কবিতার শুরুতে শাহীন বেশ স্মৃতিকাতর এবং কিছুটা অভিমানীও-
'স্মৃতিবনে তুমুল বৃষ্টি
কিন্তু কিছুতেই আমার স্বপ্ন ভেজে না।'
এই স্বপ্নাক্রান্ত প্রেমিক শাহীনই কবিতার শেষে এসে কেমন দার্শনিক, তার কণ্ঠে কি এক অদ্ভূত মায়াবী আর্তনাদ-
'একুশ বছর পর বালিকারা
কত সহজেই প্রজাপতি হয়ে যায়।'
বিবর্তনের মধ্যে চিরন্তন পরিণতি খোঁজার চেষ্টা শাহীনের পরিণত মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। আমি প্রেমিক অথচ চিন্তক শাহীন রেজা এবং তার কবিতার সাফল্য কামনা করতেই পারি, কারণ কবিতার পথ চলায় ইতোমধ্যেই সে তার অবস্থান জানান দিয়ে ফেলেছে। হ

লেখাটি কবি ফজল শাহাবুদ্দীন সম্পাদিত কবিকণ্ঠ এর জন্য লেখা হয়েছিল ২০০২ সালে। কিন্তু পত্রিকাটির ওই সংখ্যাটি ছাপা না হওয়ায় এটি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। সম্প্রতি এটি আবিষ্কৃত হয় ফজল শাহাবুদ্দীন এর বাসায় রক্ষিত কাগজপত্রের মধ্য থেকে। কবি শাহীন রেজার ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে এটি প্রকাশিত হলো।

 


আরো সংবাদ



premium cement