২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ফররুখ আহমদের কবিতার শক্তি ও সামর্থ্য

-

দক্ষিণ আমেরিকার চিলির প্রখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) তাঁর নোবেল ভাষণে বলেছিলেন : ‘কবিতা লেখার কোনো ফর্মুলা আমি কখনো কোনো বইয়ে পাইনি, অগত্যা আমি লিখিতভাবে উপদেশসূচক একটি শব্দও কি কোনো পদ্ধতি বা কোনো শৈলীর কথা উচ্চারণ করার ইচ্ছা পোষণ করি না যাতে তরুণ কবিকুল আমার নিকট থেকে প্রত্যাশিত জ্ঞানের ছিটেফোঁটাও পেতে পারেন।... দূরগামী যাত্রাপথে কবিতা রচনার ব্যবস্থাপত্র আমি পেয়ে গিয়েছিলাম। মৃত্তিকা ও আত্মার ভিতর থেকে উৎসারিত দান আশিষ হিসেবে আমার ওপর অর্পিত হয়েছিল। আমার বিশ্বাস এই যে, কবিতা হলো এক পবিত্র ক্ষণস্থায়ী কর্মানুষ্ঠান, যার ভিতরে নৈঃসঙ্গ্য ও ঐক্য, আবেগ ও সকর্মতা, কারো একান্ত পৃথিবী, মানুষের একান্ত পৃথিবী ও প্রকৃতির গোপন উন্মোচন সমভাবে সমপরিমাণে অংশ নিয়ে থাকে। অনুরূপভাবে আমি সংশয়হীন এই ধারণায় উপনীত হয়েছি যে, এসব কিছুইÑ মানুষ ও তার অতীত, মানুষ ও তার অঙ্গীকার, মানুষ ও তার কাব্য সংরক্ষিত হয়ে থাকে সর্বদা প্রসারমান জনগোষ্ঠীর ভিতরে, এমন এক কর্মপ্রণোদনার মধ্যে যা কোনো একদিন বাস্তবতা ও স্বপ্নকে এক অখণ্ড সমগ্রতায় গেঁথে নেবে, কারণ এভাবেই তো তারা পরস্পরে মিলিত হয়।’Ñ বাঙালির ঐতিহ্য এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের চেতনা ধারণ ও লালনকারী কবি ফররুখ আহমদ (জন্ম : ১০ জুন ১৯১৮; মৃত্যু : ১৮ অক্টোবর ১৯৭৪)-এর চিন্তা, সমকালে এবং উত্তরকালে কীভাবে আমাদের জন্য আগ্রহ ও প্রেরণার বিষয় হয়ে উঠেছে, তা অনুধাবন করতে হলে কবির প্রতিবেশের ভেতর দিয়ে আত্মার আলোড়ন ও বেড়ে ওঠার সমগ্রতার ছবি পাঠ করাটা অত্যন্ত জরুরি। আবেগ ও বাস্তবতাকে স্বীকার করে ফররুখ ক্রমাগত যে অর্পিত কাজের বয়ান ও বয়ন অব্যাহত রেখেছেন, সে বিষয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এখন সময়ের প্রয়োজন।
ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা ‘রাত্রি’ ছাপা হয় ১৯৩৭ সালে (বুলবুল, শ্রাবণ, ১৩৪৪)। কবিতাটির বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট ও সরল এবং তা সমকালে সমাজ-রূপান্তরের প্রেরণার এক অনন্য ধারক। কবিতাটির পাঠ নেয়া যাক :
ওরে পাখি, জেগে ওঠ জেগে ওঠ রাত্রি এল বুঝি
ঘুমাবার কাল এল, জাগিবার সময় যে যায়
ওরে জাগ্ জাগ্ তবু অকারণে। রাত্রির ভেলায়
কোন অন্ধ তিমিরের স্রোতে আসা নিরুদ্দেশ যুঝি
হে বিহঙ্গ, দিকভ্রষ্ট নাহি হোয়ে যেন পথ খুঁজি
অবেলায়। এখানে সমুখে আছে ঝড়, আছে ভয়
এখনো আনন্দ আছে খুঁজিবার দূরন্ত বিস্ময়
তবু অন্ধকার এল দেখিলাম রিক্ত মোর পুঁজী।
এখনো যায়নি অস্ত সূর্য মোর ব্যথা আকুলিয়া
এখনো রয়েছে তার শেষ রশ্মি পাতায় পাতায়
তবু অন্ধকার এল, এল মোর আনন্দ ভুলিয়া
অনন্ত বেদনা সম রিক্ততার কঠোর ব্যথায়;
প্রতি পল্লবের বুকে জাগিল তিমির শ্যামলিমা
এ আমার স্বপ্ন নহে, এই কালো মোর মৃত্যুসীমা ॥
পরবর্তীকালে ফররুখের কবিতায় ‘রাত্রি’কে একটি প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে পাই আমরা। শুরু থেকেই এই শব্দ ও চিন্তার সুতোটি তাঁর সাহিত্যচর্চার নিত্যসঙ্গী। ‘রাত্রি’ মূলত অন্ধকার, অনগ্রসরতা, অস্বচ্ছতা, অজ্ঞতা, হতাশা, বিভ্রান্তি আর পাপবোধের ফলকচিত্র। ফররুখ আহমদ দেখেছেন আমাদের ভেতরে এক প্রচল অন্ধকার, দিনের আলোকের অন্তরালে এক প্রকট অস্বচ্ছতা লুকিয়ে আছে। তাকে তিনি প্রকাশ করতে চান, মুক্তি পেতে চান ‘রাত্রি’র সমূহ ভয়বহতা থেকে। চলে যেতে চান রাত্রিশেষের প্রবল আলোর বন্যায়। আত্মগ্লানি আর পিছিয়ে-পড়া প্রবণতার কড়া সমালোচক ফররুখ; সাহসী প্রকাশকও বটে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:
আজাদী পাওয়ার পর আমরা এমন এক উৎকট ভব্যতার শিকারে পরিণত হয়েছি, যেখানে কার্পেট-বিছানো ড্রয়িংরুমের একপাশে দামি শেলফে রেক্সিনে বাঁধানো অনেক অনেক বই সাজানো থাকে। কোনো দিন সেসব বইয়ের পাতা খোলা হয় না। সেখানে শুধু আলোচনা হয় হাল ফ্যাশানের বাড়ি-গাড়ি আর শাড়ি সম্পর্কে। লেখকদের উপরেও এখন ঐ তথাকথিত অভিজাত সম্প্রদায় প্রভাব বিস্তার করছেন, যার ফলে কঠিন শ্রম-সাধনার পথ ছেড়ে অনেক লেখক বাড়ি-গাড়ির স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়েছেন।’ (বই, ১৯৬৮)
কবি ফররুখ রিপন কলেজে ও স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালে ফ্যাসিবিরোধী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেন হে বন্য স্বপ্নেরা কবিতাগুচ্ছ। কিন্তু ১৯৪১ সালে তাঁর চেতনাজগতে পরিবর্তন আসেÑ ১৯৪০ সালে গৃহীত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে। সে বছর স্কটিশ চার্চ কলেজ ছেড়ে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন কলকাতা সিটি কলেজেÑ প্রকাশ করেন ‘কাব্যে কোরআন’ শিরোনামে মোহাম্মদী ও সওগাত-এ বেশকিছু সূরার স্বচ্ছন্দ অনুবাদ। এ কথা প্রায় সর্বজনবিদিত যে, ভারতবর্ষে মুসলমানদের উত্থানের দশকে (১৯৩৭-১৯৪৭) সাহিত্যে পাকিস্তান-চেতনা প্রচারের জন্য দুটি সংগঠন গড়ে ওঠেÑ একটি কলকাতায়, অপরটি ঢাকায়। ১৯৪২ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি’; তাঁদের তত্ত্ব বা দর্শন প্রচারে ব্যবহৃত হয় মাসিক মোহাম্মদী। লক্ষ্য: জাতীয় রেনেসাঁর উদ্বোধক পাকিস্তানবাদের সাহিত্যিক রূপায়ণ, হিন্দুদের থেকে পৃথক মুসলমানদের জীবনভিত্তিক আরবি-উর্দু শব্দবহুল বাংলা সাহিত্য রচনা এবং ভাষা সংস্কার করে নতুন ভাষা নির্মাণ। ধর্ম গৃহীত হয় সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হিসেবে। খাজা নাজিমুদ্দিনের (১৮৯৪-১৯৬৪) নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ক্ষমতারোহণের বছরে (১৯৪৩) ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’। পাক্ষিক পাকিস্তান ছিল ওই সংসদের মুখপত্র। পরে, পাকিস্তান-পর্বে, সরকারি মাহে-নও সাময়িকপত্রটি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ‘ফররুখ আহমদ পাকিস্তানবাদী’ কবি। ১৯৩৭-১৯৪৭ কালপর্বে ফররুখ আহমদের কবিতায় মুসলিম পুরাণের প্রয়োগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ফজলুল হকের পতনের পর নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা (১৯৪৩-১৯৪৫)Ñ এই সময়-পরিধিতে রচিত ফররুখের কবিতাফসল হলো সাত সাগরের মাঝি (রচনা : ১৯৪৩-৪৪)। এই গ্রন্থের ‘সিন্দবাদ’, ‘বা’র দরিয়ায়’, ‘দরিয়ায় শেষরাত্রি’, ‘আকাশ-নাবিক’, ‘স্বর্ণ-ঈগল’, ‘পাঞ্জেরি’, ‘সাত সাগরের মাঝি’, ‘তুফান’, ‘নিশান’ প্রভৃতি কবিতাÑ মুসলিম লীগ ও পূর্ব-পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির অতীত ইতিহাস ভূগোলে প্রস্থানের সাক্ষ্য বহন করে। নজরুলের কবিতার জাতীয়তাবাদী বীর কামাল পাশা বা আনোয়ার নয়, আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ হয়েছে তাঁর কাব্যের নায়ক।
কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ ব’য়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার, হে মাঝি সিন্দবাদ!
(‘সিন্দবাদ’: সাত সাগরের মাঝি; ফররুখ আহমদ রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, ১৯৯৫)
ভাষাকে কবিতার জন্য আকৃত করার একটি অনন্য পদ্ধতি হলো ভাষার মঞ্চনÑ প্রমুখন, সম্মুখন বা সম্মুত্থাপন ঘটানো। চেক ভাষাবিজ্ঞানী ইয়ান মুকারোভস্কি এবং হাব্রালেকের মতে, ‘সাধারণ যোগাযোগ রক্ষার বার্তায় ভাষিক উপাদানগুলো স্বচলিত আর কবিতায় তারা গতি-স্বচলিত। স্বচলনের ভাষিক উপাদানগুলো তাদের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় না, তারা কেবল যোগাযোগ রক্ষা করে। অন্যদিকে মঞ্চিত ভাষিক উপাদানগুলো তার নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।’ এ বিষয়েÑ কবিতার ভাষা-পদ্ধতি ও সামাজিক সামর্থ্য সম্পর্কে মত প্রকাশ করতে গিয়ে সাহিত্য সমালোচক পবিত্র সরকার প্রসঙ্গত মুকারোভস্কির উদ্ধৃতি টেনেছেন : ‘কবিতার ভাষা ভাষার একটা হড়ৎস থেকে সরে যায়, সরে যায় সৌন্দর্য সৃষ্টির কতকগুলো বিশেষ প্রকরণ সমাধা করার জন্য। স্ট্যান্ডার্ড ভাষাই সে হড়ৎসাÑ কবিতার ভাষা সেই হড়ৎস ভাঙ্গে।’ (সরকার, ১৯৮৫, ২২) মনে রাখতে হবেÑ ভাষার মঞ্চন ঘটানো কবিতার একটি লক্ষণ, বাধ্যতামূলক লক্ষণ নয়। তবে, সমাজসচেতন ও প্রখর-ভাষাবোধসম্পন্ন কবি কবিতার ভাষাকে মঞ্চনের দিকে গভীর অভিনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। তাঁর কবিতার আবৃত্তি-যোগ্যতা এবং সমকালীন ও উত্তরকালীন প্রাসঙ্গিকতা তারই প্রমাণ।
বিশ শতকের প্রথম তিন দশক বাংলা কাব্যে কতকগুলো মানবিক, সামাজিক এবং শৈল্পিক মূল্যবোধে সংস্থিত হওয়ার যুগ। এই মূল্যবোধসমূহ জীবনচেতনা, সমাজচেতনা, যুগচেতনা, অধিকারচেতনা, শ্রেণীচেতনা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যচেতনা, প্রকৃতিচেতনা, আধ্যাত্মচেতনা, ভোগবাদ, ঐতিহ্যপ্রীতি, নীতি-সজাগতা, আঙ্গিক-সজাগতা, সৌন্দর্যবোধ, আত্ম-উপলব্ধি এবং রুচি ও বৈদগ্ধ্য পরিচর্যা প্রভৃতির মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। তিরিশের যুগে সূচনা হলো বিদ্রোহেরÑ সাহিত্যের-শিল্পের বিদ্রোহ। মন ও প্রবৃত্তির প্রশ্নাতীত প্রসারণের সময় তখন। এই প্রবণতা অনেক প্রচলিতকে, প্রথাবদ্ধতাকে ভাঙতে; অনেক বিধি-নিষেধ, নীতি-নির্দেশনা লঙ্ঘন করতে ছিল উদগ্রীব। তবে সৌভাগ্যের বিষয় যে, এই বিদ্রোহ-উদ্যম মানবিকতার মৌলিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে অগ্রসর হতে চায়নি। বস্তুত বাংলা কাব্যের তিরিশ-পরবর্তী সময়কালটা আত্ম-সম্প্রসারণ তাড়নায় বিদ্রোহী হলেও অনেকটা গঠনমূলক। আর এর নিশ্চিত চারিত্র্য লাভ ঘটে চল্লিশের দশকেই। এই পর্যায়ের মূল বৈশিষ্ট্য হলো প্রেক্ষিত-পরম্পর্য-সঞ্চালনাÑ বিশ্লেষণমূলকতা এবং সর্বাত্মক বিশিষ্টতা। এই কাল-পরিসরেÑ এই বিশেষ প্রবণতায় ও ঐতিহ্যের ডানায় ফররুখ আহমদের আবির্ভাব ও বিচরণ। ‘ঐতিহ্যবোধটা ফররুখ আহমদের মজ্জাগত। ঐতিহ্যবোধে উজ্জীবিত হতে না পারলে ফররুখ আহমদ লিখতেও পারেন না। ঐতিহ্যের জগৎই তার স্বাভাবিক স্বস্তির জগৎ। আরব্য-উপন্যাস, ইরান ও আরবের সংস্কৃতি ও পুরাকথা এবং কোরানে উল্লিখিত কাহিনীর ঐতিহ্য একদিকে এবং অন্যদিকে মুসলিম অভ্যুত্থান যুগের ব্যক্তিত্ব ও ভাবধারার ঐতিহ্য তার কাব্যকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।’
অবিভক্ত বঙ্গে ক্রমশ ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উঠে এলে যে রাজনৈতিক পরিম-লটি ভারতবর্ষে মুসলিম চেতনায় ভিন্নমাত্রা তৈরি করল তা ব্যক্তি-মুসলমান বা সমকালের মুসলিম-মানসকে একটি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করলÑ যেখানে স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা কিংবা মর্যাদার বিষয়টি অনুপুঙ্খভাবে জড়িত। কাজী নজরুল ইসলাম মুসলমানদের ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করেছেন আধুনিক দৃষ্টিচেতনা থেকে। সেখানে জাতিত্বের পরিচয় বিধৃত থাকলেও সর্বজনীন মানবতাবোধ কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনাটাই বিশেষরূপে কাজ করেছে। ফররুখ কবি-ভাষাটি নির্মিত হয়েছে একদিকে তিরিশোত্তর কাব্যধারার উত্তরাধিকার হিসেবেÑ যেখানে প্রেমেন্দ্রমিত্রের ভাবচেতনা কাজ করেছে অন্য দিকে নজরুলীয় রোম্যান্টিকতাÑ যিনি অনিবার্যরূপে কবিতায় ধারণ করেছেন সমাজ-রূপান্তরের প্রস্তুতি ও যুদ্ধজয়ের স্বপ্নকে। সমকালে ফররুখ আহমদ এভাবেই কাব্যধারায় নিবেদিত ছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি আত্মস্থ করেছেন বাংলা কবিতার সমকালীন মূলধারা। সমকালীন কাব্যধারা, সমালোচনা, চেতনা-প্রেরণা এবং ফররুখের অবস্থান সম্পর্কে জানতে আবু হেনা মোস্তফা কামালের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করছি :
‘গোলাম মোস্তফা পরামর্শ দিলেন যে নজরুল কাব্যের একটি বিরাট অংশ যেহেতু পাকিস্তানী আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, অতএব নজরুল ইসলামের কবিতাবলির একটি সংশোধিত পাকিস্তানী সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া উচিত। নবীনদের মধ্যে সৈয়দ আলী আহসান আরো একধাপ এগিয়ে বললেন যে, প্রয়োজন হলে রবীন্দ্র-সাহিত্য বর্জন করেই নতুন রাষ্ট্রের সংস্কৃতি পরিকল্পিত হবে। ফররুখ আহমদ কোনো বিতর্কে অংশ নিলেন না। কিন্তু কাব্যের পটভূমি সরিয়ে নিলেন মধ্যপ্রাচ্যে, আর শব্দসম্ভারের সন্ধানে গেলেন দোভাষী পুঁথির বিস্মৃত জগতে। কখনো সেইসব বিষয় ও শব্দ আন্তরিক আবেগের সন্নিপাতে সার্থক কবিতা হয়ে উঠল, আবার কখনো তা আরোপিত বিশ্বাসের ভার সইতে না-পেরে হারিয়ে গেল মহাসমুদ্রে।’
ফররুখ আহমদ চল্লিশের দশকের কবিতাচর্চার ভেতরে যে কবি-স্বীকৃতি লাভ করেছেন তার প্রধান কারণ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যচেতনা। প্রসঙ্গত, সমকালে সামাজিক বা শাস্ত্রীয় অনুশাসনের বৃত্তে ব্যক্তিচেতনা বন্দী ছিল। ইউরোপে রেনেসাঁসের ভেতর দিয়ে এর প্রকাশ ঘটে। বস্তুত রোমান্টিকতার সূত্রপাতও সেখান থেকেই। এর সংজ্ঞার্থ সম্বন্ধে কবি ও সাহিত্য-সমালোচক বুদ্ধদেব বসু বলেছেন : ‘মানুষের একটি মৌলিক, স্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য চিত্তবৃত্তিÑ তারই নাম রোমান্টিকতা। যা ব্যক্তি-মানুষকে মুক্তি দান করে, স্বীকার করে নেয়Ñ শুধু ইস্ত্রি-করা এটিকেট-মানা সামাজিক জীবটিকে নয়, নির্ভয়ে মানুষের অবিকল ও সমগ্র ব্যক্তিত্বকে; তার মধ্যে যা-কিছু গোপন, পাপোন্মুখ ও অকথ্য, ঐশ্বরিক ও অনির্বচনীয়Ñ সেই বিশাল স্বতোবিরোধময় বিস্ময়ের সামনে, সন্দেহ নেই, মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তির নামই রোমান্টিকতা।’ ফররুখ আহমদ এমন কালের মাত্রাকে তাঁর কবিতায় প্রবিষ্ট করতে চেয়েছিলেন। যেখানে তিরিশোত্তর কবিচেতনার অনুসারী হয়েও তিনি প্রবলভাবে আত্মসচেতন হয়ে ওঠেন। সমগ্র বিশ্বের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সামাজিক-মানসিক ও শৈল্পিক সম্বন্ধগুলোকে আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় আত্মনিমগ্ন হন তিনি। এমন আত্ম-উপলব্ধিই তাঁর রোমান্টিক কবিচেতনার উৎসভূমি। তবে, সমকালীন বাস্তবতা ও প্রাসঙ্গিকতার ভেতর দিয়ে তাঁর কবিতাযাত্রা অনেকভাবে ব্যাপক অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে অগ্রসর হয়েছে। নিজস্ব বিশ্বাস ও আস্থায় তিনি সবসময় ছিলেন অবিচল।
বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়

 


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী

সকল