২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নজরুল নাটকের বিষয়ভাবনা

-

তিনি প্রধানত কবি। কাব্যপ্রতিভা তার চরমে পৌঁছেছে। আপামর জনসাধারণ তাকে কবি হিসেবেই জানে। সেজন্য জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন বাংলাদেশে। কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও নজরুলের সাহিত্যপ্রতিভা ছিল বহুবিধ। তিনি কবিতা ছাড়াও সাহিত্যের সব শাখাতে স্মরণীয় অবদান রাখতে পেরেছেন। বাংলাসাহিত্য তার কাছ থেকে গ্রহণ করেছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, গজলসহ নানাবিধ সাহিত্যকর্ম। এসব সাহিত্যকর্ম বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন প্রেম ও দ্রোহের কবি। তার সাহিত্যকর্মের বেশির ভাগেই রয়েছে নর-নারীর প্রেম, মানুষে মানুষে প্রেম, সামাজিক প্রেম, জাতিগতপ্রেম ও দেশপ্রেম। রয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দ্রোহ, শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ, জুলুমের বিরুদ্ধে দ্রোহ। সেজন্য নজরুল বিদ্রোহী কবির অভিধা লাভ করেছে। কিন্তু নজরুলের নাটকে দ্রোহের অনুপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও প্রেমের প্রকাশ ঘটেছে অবারিতভাবে।
কাজী নজরুল ইসলাম যে সময় সাহিত্য রচনা করেছেন, সে সময় পৃথিবীতে চলেছে যুদ্ধের দামামা। দুই দু’টি বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১ জুলাই ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সালে। এ যুদ্ধ চলেছে ৪ বছর ১৩৩ দিন। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে এবং শেষ হয়েছে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সাল। এই যুদ্ধটিও চলেছে ৬ বছর ১ দিন। এই দু’টি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। যুদ্ধের স্বভাব হচ্ছে ধ্বংস করা। অর্থনীতি, মানবতা, মানবিক মূল্যবোধ সবকিছুকে ধ্বংস করে দিয়ে পৃথিবীকে সর্বসান্ত করেছিল বিশ্বযুদ্ধ। সর্বসান্ত হওয়া পৃথিবীতে তখন চলেছে ক্ষুধা, দরিদ্রতা। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার চেষ্টায় মানুষ যে যার মতো করে জীবনযাপন করেছে। ফলে আইনশৃঙ্খার অবনতি হয়েছে। সামাজিক বিশৃঙ্খলার এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা সীমা অতিক্রম করেছিল জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন দিয়ে। এই দুর্বৃত্তদের (বিশেষ করে ইংরেজদের) দমন কল্পে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন শরীরে, মনে ও সাহিত্যে বিদ্রোহী। সেজন্য নজরুলের সাহিত্যকর্মের পাতায় পাতায় স্থান পেয়েছে দ্রোহ ও প্রেম। নজরুলের দ্রোহ ছিল সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে আর প্রেমের জয়গান তিনি গেয়েছেন চিত্তের পরিশুদ্ধতার জন্য। দ্রোহ দিয়ে নজরুল বঞ্চনাকে উচ্ছেদ করে অধিকার ফিরে পাবার চেষ্টা করেছেন আর প্রেম দিয়ে জীবনকে মসৃণ করার স্বপ্ন দেখেছেন। দ্রোহ ও প্রেমের সমন্বয়ে নজরুলের সাহিত্যকর্ম সমৃদ্ধ হলেও নাটক হয়েছে ব্যতিক্রম। নজরুল নাটকের বিষয় করেছেন প্রেম, প্রকৃতি, নরনারীর আবেগ ও কল্পকাহিনী; প্রভৃতি। এসব বিষয়বস্তুতে নজরুল জীবনকে ভিন্ন স্বাদে আস্বাদন করার প্রয়াস পেয়েছেন। ফলে নর-নারীর প্রেম ও আবেগাবদ্ধ জীবনযাপনের আলেখ্য হয়ে উঠেছে নজরুল নাটকের পটভূমি।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন লেটো দলের সদস্য। গানে গানে কাহিনীর অবতারণা করে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। বারো-তেরো বছর বয়সে নজরুল পালা গানের আসর মাতিয়ে বেড়াতেন। গান লেখা, সেসব গানে কাহিনী ও সংলাপ সমন্বয় করা, আসর ঠিক করে সেখানে রাতভর পালাগান পরিবেশন করা ছিল নজরুলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এসব করতে গিয়েই জন্ম নিয়েছে নজরুলের নাটক। সেজন্য নজরুলের নাটকে গানের আধিক্য দেখা গেছে। গানের আধিক্য থাকার কারণে সমালোচকদের কেউ বলেন, নজরুলের নাটক নাটক নয়, হয়েছে গীতিনাট্য; আবার কেউ বলেন, ওসব নাটক কাব্যনাট্যের রূপ পরিগ্রহ করেছে।
লেটো গানের আসর থেকেই নজরুলের নাটকের জন্ম। লেটো গানের সুর ও কাব্যময়তায় আশ্রয় করে গড়ে উঠল নজরুলের নাটক ঝিলিমিলি (১৩৩৭ বঙ্গাব্দ), ‘আলেয়া’ (১৩৩৮ বঙ্গাব্দ), শিল্পী, সেতুবন্ধ (১৯৩০ খ্রি.), মধুমালা (১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) ও ভূতের ভয় ইত্যাদি। এসব নাটক রচনার আগে কবিজীবনের শুরুতে পালাগানের উপযোগী করে নজরুল সৃষ্টি করলেন- দাতা কর্ণ, শকুনি বধ, চাষার সং, মেঘনাধ বধ, কবি কালিদাস, আকবর বাদশা প্রভৃতি নাট্যপালা। এছাড়া নজরুলের একাঙ্কিকা নাটিকার তালিকায় রয়েছে- ‘ছিনিমিনি খেলা’, খুকী ও কাঠবিড়ালী, জুজুবুড়ির ভয়, পুতুলের বিয়ে, শ্রীমন্ত, আল্লাহর রহম, কবির লড়াই, কালির কেষ্ট, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, বনের বেদে উল্লেখযোগ্য। এসব রচনা নজরুলের নাটক রচনার প্রারম্ভিক প্রচেষ্টা। এসব রচনার বিষয়বস্তুতে নজরুল কোনো প্রকার ভণিতা, সংকেত কিংবা প্রতীকির আশ্রয় গ্রহণ করেননি। সরল বিষয়বস্তুর সাধারণ সাদামাটা পরিবেশন দিয়েই নজরুল দর্শক নন্দিত হতে পেরেছেন।
গানপ্রিয় ও কাব্যিক নজরুলের সত্তার ভেতর যে প্রেম ও বিরহ ঘনীভূত হয়েছিল তার প্রকাশ তিনি নাটকেও ঘটালেন। রচনা করলেন নটক ‘আলেয়া’। এ নাটকের বিষয়বস্তুতে লক্ষ করা গেল বিরহ-বেদনা। ‘আলেয়া’ নাটককে কেউ কেউ প্রতীকী নাটক বলতে চায়। আলোর লুকোচুরির সাথে প্রেমকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে এ নাটকে। আলোর লুকোচুরি খেলাকে আলেয়া বলা হয়। নাটকটির জনপ্রিয়তা ছিল প্রশংসনীয়। আলেয়া প্রায়ই গ্রাম্য জনপদের বিরান প্রান্তরে বিলের ধারে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলেই আবার নিমেষেই নিভে যায়। নজরুল অবলোকন করলেন, নরনারীর জীবনে প্রেমের বিষয়টিও আলেয়ার মতো লুকোচুরি খেলে। জীবনে কত প্রেম যে জন্ম নেয় আবার ক্ষণিক পরেই সেই প্রেম বাতাসের সাথে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। আলেয়া নাটকটি প্রেমের আলো-আঁধারির এ আখ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। নাটকের প্রধান চরিত্র জয়ন্তী। জয়ন্তীর প্রেম, প্রেমে অস্থিরতা, সিদ্ধান্তহীনতা এবং আবেগের বাড়াবাড়ি শেষপর্যন্তু নাটকের ট্র্যাজিক রসকে গাঢ় করে তুলেছে। এ নাটকে জয়ন্তী, মীনকেতু ও উগ্রাদিত্যের ত্রিভুজ প্রেম নাটকের কাহিনীকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়েছে। কিন্তু জয়ন্তী শেষমেশ কাকে ভালোবাসে তা নিরুপিত হয় না। অমীমাংসিত প্রেমের নাট্যরূপে দর্শক আপ্লুত হতে পেরেছে। গীতিকাব্যের কাব্যিক সংলাপে নাটকটির নাট্যসৌন্দর্য ম্লান হয়েছে বলে মনে করা যায় না।
কল্পনা ও বাস্তবতার সমন্বয়ে লেখা নজরুলের আরেকটি নাটক ‘ঝিলিমিলি’। প্রেম ও বিরহ নাটকটির উপজীব্য বিষয়। নজরুল রোমান্টিক হলেও এ নাটকে তার প্রভাব পড়েনি। নাটকে বাস্তবতার কাছে প্রেম পরাস্ত হয়েছে। পিতার বাস্তব যুক্তির তাড়নে ফিরোজা ও হাবিবের প্রেম পরিণতির দিকে এগোতে পারে না। নাটকের কাহিনীতে দেখা গেছে, চেয়ে না পাওয়ার যন্ত্রণা ও অপূর্ণতার তীব্র বেদনাবোধ দানা বেঁধেছে। মানবমনের একটি অব্যক্ত কষ্ট ঝিলিমিলি নাটকের নাট্যমঞ্চের পরিবেশকে শীতল করে তোলে। ফিরোজা ও ফিরোজার পিতা মির্জা সাহেবের দৃঢ়চেতা সিদ্ধান্ত নাটকের প্লট তৈরিতে সাহায্য করেছে। ফলে বাস্তব জীবন আবেগের সাথে সন্ধি করতে পারে না। কাজেই বাবার যুক্তির কাছে ফিরোজার প্রেম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে ফিরোজার চাওয়াকে কল্পনার আবরণে বাস্তবতার সাথে নিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এতে ফিরোজা হতে পেরেছে জীবনঘনিষ্ঠ নারী। ফলে নাটকটিতে প্রেমের নবতর ধারণা দর্শক অনুধাবন করতে পারে।
নজরুল রচিত রূপক ও সাংকেতিক ধারার আরেকটি নাটক সেতুবন্ধ। এ নাটকটি রচিত হয়েছে তিন দৃশ্যের একাঙ্কিকা হিসেবে। নাটকটির বিষয়বস্তু হয়েছে প্রকৃতি ও মানুষ। মানুষ প্রকৃতির বিপক্ষে গেলে প্রকৃতি কীভাবে প্রতিবাদী হযে ওঠে সে দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে এতে। নদী শাসন করে পদ্মায় সেতু তৈরি করা হলে প্রকৃতি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারে না। ঝঞ্ঝা ও তাণ্ডবে জলের তোরে সেতুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এতে প্রকৃতির কাছে মানুষের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। নাটকে প্রকৃতি ও মানুষ পাশাপাশি অবস্থান করেছে। মানুষ কতভাবে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। সেসব প্রচেষ্টায় হয় প্রকৃতি জিতেছে অথবা মানুষ জিতেছে। প্রকৃতিকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মানুষকে বারবার বিপদে পড়তে হয়েছে। বিপদ কাটিয়ে মানুষ আবার সামনের দিকে এগিয়েও গেছে। প্রকৃতির সাথে মানুষের এই যে দ্বন্দ্ব তা এক জায়গাতে স্থির থাকেনি। এ নাটকে জীবনের গতিময়তাকেই নজরুল পরিষ্কার করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
রূপকথার অনিবার্য সঙ্গীতময়তাকে কেন্দ্রের বিষয় করে নজরুল ইসলাম রচনা করলেন ‘মধুমালা’ নাটক। এ নাটকের বিষয়বস্তু রূপকথার মধুমালা-মদনকুমার, কাঞ্চনমালার গল্প। নাটকের চরিত্রগুলো বাস্তবতার ঘাতপ্রতিঘাতে বেড়ে উঠেছে। রূপকথার চরিত্রগুলো পার্থিব সংসারে এসে স্বপ্নের আবহ তৈরি করেছে। মদনকুমার স্বপ্নে দেখা অপরূপা রাজকুমারীর সন্ধানে অজানার উদ্দেশে বের হলে পথে আরেক রাজকন্যা কাঞ্চনমালার সঙ্গে পরিচয় ও প্রণয় ঘটে। তারপর কাঞ্চনমালাকে রেখে আবার মধুমালার সন্ধানে ছুটে চলে মদনকুমার। শেষাবধি মধুলার সাথেও তার সাক্ষাৎ হয় এবং প্রণয়ের পরিণতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মধুলাকে সাথে করে মদনকুমার সমুদ্র ভ্রমণে গেলে বিষণœ যোগিনী কাঞ্চনমালাকে দেখে। মধুমালা কঞ্চনমালার পরিচয় পেয়ে উপলব্ধি করতে পারে মদনকুমারের প্রেমে ফাঁক রয়েছে। অপমান আর অন্তরযন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মধুমালা সাগরের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে জীবনপ্রদীপ নিবিয়ে দেয়। জীবন যে একই সররেখায় চলে না এবং রূপকথাও জীবনকে পরাস্ত করতে পারে নজরুলের ‘মধুমালা’ নাটকটি সে কথা দর্শককে স্মরণ করিয়ে দিতে চায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement