১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘হাজার স্রোতে ঝরছে জগৎ’

জন্ম : ৭ মে ১৮৬১, মৃত্যু : ৭ আগস্ট ১৯৪১ -

রবীন্দ্রনাথের কবিতার জগত বিরাট ও বৈচিত্র্যময়। কবির দৃষ্টি ছড়িয়ে রয়েছে ঘর থেকে বাইরে, অন্তর থেকে অসীমে। তিনি দেখেছেন নদী খাল বিল তাল নারিকেল কুঞ্জ, অবারিত প্রান্তরে সূর্যোদয়ের ও সূর্যাস্তের সমারোহ, মাথার উপরে স্তব্ধ নীলাকাশের জ্যোতির্বিকীর্ণ মহোৎসব।... গ্রামের ঘাটে বাঁধা বোটে মাঠের ধারে, ক্ষেতের পাশে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে চলছে কবির জীবনভোগের রসোৎসব। মানুষ ও প্রকৃতির বিচিত্র লীলার দর্শক কবির অন্তর্লোকে চলেছে গভীর রসনিমগ্ন মনন-চোখে যা দেখেছেন, বাইরে যা ঘটেছে তাকে ছাড়িয়ে দেখেছেন তার অন্তরতর সত্য। কবি তাঁর কবিতা আরম্ভ করেছেন এ পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর প্রতি ঐকান্তিক গাঢ় অনুরাগ নিয়ে, প্রকৃতির প্রতি এই গাঢ় অনুরাগকেই একমাত্র সম্বল করে তিনি সংসারের সৌন্দর্য সাধনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন, বিশ্ব প্রকৃতির সাথে নিজকে মিলিয়ে দিয়ে কবি গভীর আনন্দ অনুভব করেছেন। পৃথিবীর সর্বত্র, বিশেষ করে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারার মাঝে একটি অসীম অব্যক্ত জগতের খোঁজ পেয়েছেন কবি। তিনি গীতজগতের বিচিত্র ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন গ্রহ-চন্দ্র-তারায় তারায়। কবি তাই লিখলেন : ‘পৃথিবীর, চন্দ্রমার, গ্রহতপোবনের কোটি কোটি তারার সঙ্গীত, তোর কাছে জগতের কোন্ মাঝখানে না জানি রে হয়েছে মিলিত।’ কবি আধ্যাত্মিক জগতের রস উপভোগ করেছেন তপোবনের ঋষিদের মতো প্রকৃতির মাঝে। তিনি দেখেছেন বিশ্ব প্রভুর স্নেহধারা সর্বত্র একইভাবে প্লাবিত। কবি তাই গাইলেন : গিরি উঠিয়াছে ঊর্ধ্বে তোমারি ইঙ্গিতে নদী ধায় দিকে দিকে তোমারি সঙ্গীতে; শূন্যে শূন্যে চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা যত অনন্ত প্রাণের মাঝে কাঁপিছে নিয়ত। প্রকৃতি হতে উৎসারিত আনন্দধারা কবি হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে। তাইতো কবি একটি প্রভাতের হৃদয়ানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে গাইলেন : এই বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে, আলোক আমার তনুতে কেমনে মিলে গেছে মোর তনুতেÑ তাই এ গগন-ভরা-প্রভাত পশিল আমার অনুতে অনুতে। কবি রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি ও মননে প্রকৃতি যেমন সর্বদা উৎসাহ জুগিয়েছে তেমনি উপনিষদের বাণী ও প্রকৃতির উপমা দিয়ে প্রকাশ ঘটেছে। প্রকৃতির গ্রহ উপগ্রহের অক্লান্ত সৌর পরিক্রমায় কবি মনে জাগিয়ে তুলেছে নটরাজের কল্পনা। যেমন : ‘দেখিলাম যুগে যুগে নটনটী বহু শত শত ফেলে গেছে নানা রাঙা বেশ তাহাদের রঙ্গশালা-দ্বারের বাহিরে। দেখিলাম চাহি শত শত নির্বাপিত নক্ষত্রের নেপথ্য প্রাঙ্গণে নটরাজ নিস্তব্ধ একাকী।’ মহাকালের বিপুল নৃত্যছন্দে বাইরের গ্রহ-উপগ্রহ হতে ভেতরের নিজ সত্তায় অনুতে অনুতে যা পরিব্যাপ্ত কবি সেখানে দেখেছেন নটরাজের সৃষ্টিকে সংহত করার এ শান্ত রূপ। যেমন : ‘যে প্রথম প্রাণ একই বেগ জাগাইয়াছে গোপন সঞ্চারে রসরক্ত ধারে মানব শিরায় আর তরুর তন্তুতে, একই স্পন্দনের ছন্দ উভয়ের অনুতে অনুতে।’ কবি নটরাজ নাট্যকাব্যে লিখেছেন : নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু, পদযুগ ঘিরে জ্যোতি মঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।... আলোর স্পর্শে চেতনাকে নির্মল করে নেয়া ছিল কবির প্রাত্যহিক সাধনা। এই ‘আলোর মন্ত্র’ বিশ্ব চরাচর আলোকিত করার সাথে কবিসত্তাকে উদ্ভাসিত করে। কবি তাই লেখেন : বলি-হে সবিতা, সরিয়ে দাও আমার এ দেহ, এই আচ্ছাদন,Ñ তোমার তেজোময় অঙ্গের সূক্ষ্ম অগ্নিকণায় রচিত যে আমার দেহের অণু-পরমাণু, কবি আধ্যাত্ম্য সত্যের সন্ধান পেয়েছেন দূরের আকাশ থেকে আপন সত্তায়। এখানে এসে কবি সত্তা ও বিশ্বপ্রকৃতি যেন এক হয়ে গেছে। কবি তাই বলেন : ঐ চাঁদ, ঐ তারা ঐ তমঃপুঞ্জ গাছগুলি এক হ’ল, বিরাট হ’ল সম্পূর্ণ হ’ল আমার চেতনায়। কবি তার বহিঃসত্তার বিলীনতার ভেতর দিয়ে এক সত্যের সাথে আনন্দ আলোকে নিবিড়ভাবে যুক্ত হবার গভীর আকাক্সক্ষা পোষণ করেন। কবি তাই লেখেন : ‘এক কৃষ্ণ অরূপতা নামে বিশ্ববৈচিত্র্যের ‘পরে স্থলে জলে। ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যা’য় দেহ অন্তহীন তমিশ্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া, ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড় হাতেÑ ‘হে পূযন, সংহরণ করিয়াছি তব রশ্মি জাল’, কবির আধ্যাত্ম্য চেতনা সর্ব আবরণ বিযুক্ত হয়ে যেন ভুবনজোড়া বিশুদ্ধ আলোর প্রবাহের সাথে মিলিত হয়েছে। সেই চেতনা যেন সন্ধ্যাতারা, সমুদ্র ও গিরিশিখরে ছড়িয়ে পড়েছে। কবি তাই প্রকাশ করেছেন তার ‘কালরাত্রে’ কবিতায়। তিনি লিখলেন : ‘গান গাইলেম’, ‘চাইনে কিছু চাইনে’, যেমন গাইছে রক্তপদ্মের রক্তিমা, যেমন গাইছে সমুদ্রের ঢেউ, সন্ধ্যাতারার শান্তি, গিরিশিখরের নির্জনতা। সৃষ্টির একটি অখণ্ডরূপ কবি হৃদয় জাগ্রত হয়েছিল, কবির এই বোধ ও তার আনুষঙ্গিক অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে নৈবেদ্যে। এখানেও তিনি কল্পনার আলো ছুঁইয়ে দিয়েছেন বিরাটকায় নক্ষত্ররাজি হতে ক্ষুদ্রকায় অণু-পরমাণু পক্ষুন্ত। কবি লিখেছেন : “এই স্তব্ধতায় শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায়, মোর অঙ্গে রোমে রোমে, লোকে লোকান্তরে গ্রহে সূর্যে তারকায় নিত্যকাল ধ’রে অণু-পরমাণুদের নৃত্য কলরোলÑ তোমার আসন ঘেরি অনন্ত কল্লোল।”
বিশ্ব সৃষ্টির অন্তর্নিহিত অখণ্ড ঐক্যবোধ কবির মনকে পেয়ে বসেছিল। ‘অনন্ত জীবন’ কবিতায় সে বোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে : ‘সূর্য হতে ঝরে ধারা, চন্দ্র হতে ঝরে ধারা কোটি কোটি তারা হতে ঝরে, জগতের যত হাসি, যত গান, যত প্রাণ ভেসে আসে সেই স্রোতোভরে, মেশে আসি সেই সিন্ধু ‘পরে’। বিধান ও বিধাতার ভেতরকার সম্পর্কটির ধারণা ফুটে উঠেছে ‘মহাস্বপ্ন’ কবিতায় : ‘বিশাল জগৎ এই প্রকাণ্ড স্বপন সেই, হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিম্বের মতন। উঠিতেছে চন্দ্র সূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার, উঠিতেছে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।’ কবি তার ব্যক্তিধারাটাকে বিশ্বপ্রবাহের অখণ্ড ধারায় মিলাবার আকুল আগ্রহে লিখলেন : ‘শতেক কোটি গ্রহ তারা যে স্রোতে তৃণপ্রায়, সে স্রোতমাঝে অবহেলে ঢালিয়া দিব কায়, অসীম কাল ভেসে যাব অসীম আকাশেতে, জগঃ-কল-কলরব-শুনিব কান পেতে।’ কবি তাঁর সত্তাকে বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে মিলিয়ে দিয়ে একটি অপূর্ব আনন্দে বিভোর হতে চেয়েছিলেন। কবির ভাষায়Ñ ‘আজ ভোরবেলা উঠে এই জানালা দিয়ে তোমার গাছপালা বাগান দেখছি আর নিজকে ওদের সঙ্গে মিলাবার চেষ্টা করছি। এই বর্ষায় ওদের চেহারা কেমন কেমন খুশি হয়ে উঠেছে। ওদের কোথাও ভয় নেই, এইতো সৃষ্টির আনন্দ। নিজেকে যখন বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে সেই একের মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়, তখন যে কী আরাম। আর কোন ভয় ভাবনা মনকে পীড়া দিতে পারে না। এই গাছপালার মতো আনন্দে ভরে উঠি।’ কবির অনুভূতিতে পুরো বিশ্ব স্পন্দন কেবল আলোকরূপে বস্তুরূপে যেন ধরা না পড়ে তা যেন একটি অপরূপ সঙ্গীতের মতো বারবার অনুরণিত হয়েছে। কবির লেখায় : ‘অন্তরের মধ্যে একটি প্রকাণ্ড চির বিরহ বিষাদ আছে, সে এই সন্ধ্যাবেলাকার পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে কি একটি উদাস আলোকে আপনাকে ঈষৎ প্রকাশ করে দেয়-সমস্ত জলে-স্থলে-আকাশে কি একটি ভাষা পরিপূর্ণ নীরবতাÑ’ সেই নীরবতা বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবির চিত্তবীণাকে কেমন নিগূঢ় উপায়ে একই ছন্দে বেঁধে দিয়েছেন। আর তাই কবি আপনার কল্পনার দিক হতে বিশ্বের দিকে পরিপূর্ণ অনুভূতি নিয়ে প্রবেশ করবার সাধনা করেছেন। কবি তাই লিখতে পারলেন : আকাশ হতে আকাশ পথে হাজার স্রোতে ঝরছে জগৎ ঝরণা ধারার মতো। আমার শরীর মনের অধীর ধারা সাথে সাথে বইছে অবিরত। এভাবে কবির সত্তা বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একাকার হয়েছে তার কাব্য ভুবনে।


আরো সংবাদ



premium cement