২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

মহামারী : গভীর দৃষ্টির বিবেচনা

-

প্রতিটি মহামারী স্রষ্টার ইচ্ছেতে একবার করে ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়েছে। কোটি প্রাণের বিনিময়ে মানবসভ্যতাকে তিনি জয়ী করেছেন। বিচ্ছিন্ন কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়কে অস্তিত্বের সংগ্রামে হারিয়ে দিলেও গোটা মানবজাতিকে দিয়েছেন উত্তরণের দিশা। তখন আবার আমরা হয়েছি বেপরোয়া কিংবা ধ্বংসাত্মক আচরণে প্রকৃতিকে করেছি ক্রুদ্ধ। স্রষ্টা কেবল হেসেছেন আপন মনে! বান্দা যখন বেপরোয়াভাবে খুন, লুণ্ঠন, অশ্লীলতা, ব্যভিচার, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা ফ্যাসাদ সৃষ্টিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ বিভিন্ন অন্যায়ে মেতে উঠে তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের সতর্ক করতে বিভিন্ন পরীক্ষায় ফেলেন। এতে মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে যেমন-ঠিক তেমনি গণজমায়েত বন্ধ করা, ঘরে নামাজ আদায় করা, কূটনৈতিক সফর বাতিল, হজ বন্ধের মতো ঘটনাও ঘটেছে। সেই সুবাদে ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা দেখতে পাই-মহামারীর সঙ্গে মুসলমানদের পরিচয় নতুন কিছু নয়। বিশ্ব ইতিহাসে যখন ইসলাম রবি ঊর্ধ্ব গগনে বিজয়ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছে তখনো মহামারী আঘাত হেনেছে মানবজীবনে।
যতদূর জানা যায়, ১৮শ’ হিজরি থেকে শুরু করে ৭৪৯ বা ৮৩৩ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে মারা যায় বহু মুসলিম। ২১৯ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে গোটা মিসর প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আক্রান্ত হয়নি এমন কোনো বাড়িই ছিল না। ২২৮ হিজরিতে আজারবাইজানে প্লেগের আক্রমণে এত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল যে সবার দাফনের জন্য পর্যাপ্ত কাফন পর্যন্ত ছিল না। ৪০৬ হিজরিতে প্লেগের আক্রমণে বসরার রাস্তাঘাটে পড়েছিল লাশ। ৪৪৮ হিজরির ভয়াবহ মহামারী নিয়ে লিখতে গিয়ে ইমাম আদ দাহাবি রহ: লিখেছিলেন, মিসর আর আন্দালুসে এমন এক প্লেগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল যা মানুষ আগে কখনো দেখেনি। এটি এমন এক ভয়াবহ দুর্যোগ ছিল যে-কোনো মুসল্লি না থাকার কারণে মসজিদগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ৭৭৯ হিজরিতে আল মাক্বরিজি লিখেছেন, এ এক এমন ভয়াবহ মহামারী ছিল যে মসজিদগুলোতে আজান দেয়ার মতো কেউ ছিল না। বেশির ভাগ মসজিদই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সিরিয়ার দামেস্ক শহর ধ্বংসমুখে পড়ে এ সময়। কেবল তাই নয় ‘সিরিয়ায় মহামারী দেখা দিলে হজরত ওমর রা: তার গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সফর স্থগিত করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৫৭২৯) কুরআন-হাদিসে মহামারী ও বালা-মুছিবতকে মানুষের গুনাহের ফসল বলা হয়েছে। সে হিসেবে করোনাভাইরাসও হয়তো আমাদের গুনাহ ও অন্যায়ের ফসল।
প্রতিটি মহামারী আমাদের দাম্ভিকতার বুকে ছুরিকাঘাত করে জানান দেয় আমাদের নির্বুদ্ধিতার, অন্যায়ের কিংবা অহংবোধের। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমি তাদের প্লাবণ, পঙ্গোপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি। এগুলো স্পষ্ট নিদর্শন; কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়।’ (সূরা আরাফ, আয়াত : ১৩৩) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে; যার ফলে তাদের কৃতকর্মের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তাদের তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা রূম, আয়াত: ৪১) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘হে মুহাজিররা! তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। তবে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি যেন তোমরা তার সম্মুখীন না হও।
১. যখন কোনো জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী আকারে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। তাছাড়া এমন সব রোগের উদ্ভব হয়, যা আগের লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি।
২. যখন কোনো জাতি ওজন ও পরিমাপে কারচুপি করে তখন তাদের ওপর নেমে আসে দুর্ভিক্ষ, কঠিন বিপদ।
৩. যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহলে আর কখনো বৃষ্টিপাত হতো না।
৪. যখন কোনো জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের ওপর বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করেন এবং সে তাদের সহায়-সম্পদ সবকিছু কেড়ে নেয়।
৫. যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব (কুরআন) মোতাবেক মীমাংসা করে না এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানকে গ্রহণ করে না, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ) যুগে যুগে আমরা এই কাজগুলোই করেছি সন্তর্পণে। তাই একুশ শতকে এসেও আমাদের সঠিক পথে কিংবা অন্যায় থেকে ফিরে আনতেই হয়তো বিশ্বময় চলছে এই লকডাউন। যাতে আমরা ঘরমুখী জীবনে সঠিক পথে ফিরে এসে পরিমিত জীবনবোধে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
ইসলাম, পৃথিবীতে সর্বশেষ এবং আধুনিক ধর্ম। যেখানে বাড়াবাড়ি করার কোনো সুযোগই নেই। অথচ ধর্মান্ধরা আপন স্বার্থসিদ্ধিতে ইসলামকে যাচ্ছেতাইভাবে ব্যবহার করে চলেছে। সঠিক তথ্য গোপন করার ব্যাপারেও ইসলামে রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। ইসলামের দৃষ্টিতে মহামারী আক্রান্ত অঞ্চলে আজান, নামাজ এবং হজের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা মানুষকে সুস্পষ্টভাবে জানানো খুবই জরুরি। এ নিয়ে ফেতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করাও রীতিমতো অন্যায়। কুরআন এবং হাদিসে মহামারী থেকে রক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের কথা উল্লেখ রয়েছে। যদি কোনো অঞ্চলে আবহাওয়াজনিত প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ঝড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কুয়াশা অথবা মহামারী দেখা দেয় তবে সেসব অঞ্চলের আজানের শব্দে পরিবর্তন করা যেতে পারে মর্মে অনেক হাদিসে বর্ণনা রয়েছে। সহিহ হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা: মুয়াজ্জিনকে তা করতেও বলেছেন। হাদিসে দু’টি শব্দ এসেছে। একটি হলো ‘সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম। আর অন্যটি হলো ‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’। প্রচণ্ড এক শীতের রাতে হজরত ইবনে ওমর রা: যাজনান নামক স্থানে আজান দিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন- ‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’ অর্থাৎ তোমরা আবাসস্থলেই নামাজ আদায় করে নাও। পরে তিনি সবাইকে জানালেন যে, রাসূলুল্লাহ সা: সফরের অবস্থায় বৃষ্টি অথবা তীব্র শীতের রাতে মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বললেন এবং সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করতে বললেন যে, তোমরা নিজ বাসস্থলে নামাজ আদায় করো।’ (সহিহ বুখারি : ৬৩২) ইবনু আববাস রা: হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর মুয়াজ্জিনকে এক প্রবল বর্ষণের দিনে বললেন, যখন তুমি (আজানে) ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ বলবে, তখন ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ বলবে না; বলবেÑ ‘সাল্লু ফি বুয়ুতিকুম’ (তোমরা নিজ নিজ বাসগৃহে নামাজ আদায় করো)। অনেকে তা অপছন্দ করল, তখন তিনি বললেন, আমার চেয়ে উত্তম ব্যক্তিই (রাসূলুল্লাহ সা:) তা করেছেন। জুমা নিঃসন্দেহে জরুরি। আমি অপছন্দ করি তোমাদের মাটি ও কাদার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করার অসুবিধায় ফেলতে। (সহিহ বুখারি : ৯০১) মুমিন মাত্রই এই মুহূর্তে আমাদের সবাইকে আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালা ও সিদ্ধান্তের ওপর সন্তুষ্ট থাকাই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক বস্তুকে পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি।’ (সূরা আল ক্বমার, আয়াত : ৪৯)
তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান। বৈশ্বিক এ মহামারী করোনায় লকডাউনে অবস্থান করছে পুরো বিশ্ব। এ থেকে নিরাময় লাভ করতে এখনো কোনো প্রতিষেধক তৈরি হয়নি, নেই কোনো কার্যকরী চিকিৎসা। মুক্ত থাকতে প্রয়োজন ঘরে অবস্থান করা। তাই এ সময় মসজিদে নামাজ ও জামাত যেমন সীমিত রয়েছে তেমনি ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ হজের আনুষ্ঠানিকতার জন্য মুসলিম বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কারণ যুদ্ধ কিংবা মহামারীতে হজ বাতিলের নজির রয়েছে বিশ্ব ইতিহাসে। সে ক্ষেত্রে হজ বাতিলের ঘটনাও একেবারে নতুন কিছু হবে না। কারণ ‘আব্বাসীয় আমলে ইসমাঈল বিন ইউসুফের মক্কা আক্রমণের কারণে প্রথমবার হজ বাতিল হয় ৮৬৫ সালে। এরপর কট্টর শিয়াদের আক্রমণে ৯৩০ সালে, যেখানে ৩০ হাজার হাজী শহীদ হন। হাজীদের হত্যা করে জমজম কূপে ফেলে দেয়া হয় এবং ফিরে যাওয়ার সময় তারা সাথে করে হাজরে আস্ওয়াদ বাহরাইনে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে হাজরে আসওয়াদ পুনরুদ্ধার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক দশক হজ বন্ধ ছিল। রাজনীতির কারণে ৯৮৩-৯৯০ সাল পর্যন্ত হজ বাতিল হয়। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আব্বাসীয় খিলাফত এবং মিসরভিত্তিক ফাতেমীয় খিলাফতের মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে ৮ বছর হজ বন্ধ থাকে। কেবল যুদ্ধেই নয়, মহামারীর কারণেও হজ বাতিল হয়। হেজাজ প্রদেশে প্লেগের কারণে ৮ হাজার মানুষ মারা যাওয়ায় ১৮১৪ সালে হজ বাতিল হয়। এরপর ১৮৩১ সালে ভারত থেকে যাওয়া হজযাত্রীদের মাধ্যমে মক্কায় প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে এবং চার ভাগের তিন ভাগ হাজী মৃত্যুবরণ করায় হজ বাতিল হয়। এছাড়া প্লেগ এবং কলেরার কারণে ১৮৩৭-১৮৫৮ সালের মধ্যে তিন বারে মোট ৭ বছর হজ বন্ধ ছিল।’ (হারাম শরিফের ওয়েবসাইট, মিডল ইস্ট আই, টিআরটি, দ্য নিউ আরব)
আগেই বলেছি, ইসলাম সর্বশেষ এবং সর্বাধুনিক ধর্ম যেখানে অন্যায় কোনো কিছুই নেই, বরং রয়েছে সঠিক সমাধান। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘ জেনে রাখো, আল্লাহর বন্ধুদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’ (সূরা ইউনূস, আয়াত : ৬২) এ প্রসঙ্গে রাসূল সা: বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মহামারীতে পতিত হয় এবং নেকির আশায় সে ধৈর্যসহকারে সেখানে অবস্থান করে এবং এ বিশ্বাস রাখে যে, আল্লাহ তায়ালার হুকুম ব্যতীত কিছুই হয় না, তাহলে সে শহীদের সওয়াব পায়।’ (সহিহ বুখারি : ৫৪০২) তাই আসুন পবিত্র রমজানে আতঙ্কিত না হয়ে রাষ্ট্রীয় বিধি মেনে সতর্ক ও সাবধান হয়ে বেশি বেশি আল্লাহর নামে জিকির ও তওবা করি। কারণ, সত্যিই পরিবেশের প্রতি ঋণ পরিশোধের আর সম্পদের সুষম বণ্টনের সময় হয়েছে। সময় হয়েছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের।


আরো সংবাদ



premium cement