২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রমজান-সাহিত্যের সরলতা ও বাণিজ্যিকতা

রমজান-সাহিত্যের সরলতা ও বাণিজ্যিকতা -

জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একবারো হয়তো ভেবে দেখি না আমাদের বর্তমান বয়সের পিছনে কতটা সময় শুধু মাত্র ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। কতটা সময় কাটিয়েছি মোবাইলে অযথা কথা বলে আর বন্ধুবান্ধবদের বকাঝকা করে। সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না বলেই আমরা হয়তো সময়ের হিসেবের জন্যও অপেক্ষা করি না। তবে বয়সের প্রতিটা সেকেন্ডের হিসেবের বদলা যে সৃষ্টিকর্তা আমাদের কাছ থেকে নেবেন, জানতে চাইবেন এটা ভুলতে চাইলেও আমরা ভুলতে পারি না।
সময়ের হিসাবে ৩৬৫ দিনকে এক বছর ধরা হয়। আবার এক বছরকে মাসের হিসেবে ১২ মাসে ভাগ করা হয়। ভুল আমরা করিই। খুন, গুম, অন্যের হক মেরে খাওয়াসহ নির্যাতন ধর্ষণ, হুমকি, ধমকি দিয়েও আমরা বেঁচে যাই কিন্তু ভুলে যেতে পারি না। আমাদের এ কৃতকর্মও আল্লাহর কাছে যেমনটি ফেরেশতা ফেস করেন আবার আমরাও শপথ মাফিক সময়ে সময়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ আমাদের মাফ করে দেন।
মাফ চাওয়া। ক্ষমা পাওয়া এবং অধিকতর সওয়াব পাওয়ার সময়ের হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হচ্ছে রমজান। আরবিতে যাকে সাওম বলা হয়, যার বাংলা অর্থ বিরত থাকা।
পৃথিবীতে চলমান ৪ শতাধিক ধর্মের মধ্যে একমাত্র ইসলাম ধর্ম ছাড়া কোনো ধর্ম বলতে পারে না কিংবা বলেও না যে নির্দিষ্ট একটি মাসে ইবাদত করলে সত্তর গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। এটি একমাত্র ইসলাম ধর্মেই। আর সে সময়টি হচ্ছে রমজান। এ মাসে যেকোনো একটি ভালো কাজের সওয়াব সত্তর গুণ। এ মাসের নামই তো বিরত থাকা (মন্দকাজ থেকে)।
সময়ের সঙ্গেই চলে সাহিত্য। প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে চলে নানা গবেষণা ও লেখা এমনকি বই প্রকাশনা। এ সময় হিসেবে রমজান মাসকে নিয়ে অথবা রোজার বিষয় নিয়ে নেই উল্লেখ করার মতো কোনো সাহিত্য। রমজান বিষয় সাহিত্য যথেষ্ট বিদ্যমান একমাত্র বিশ্বের সেরা সাহিত্যগ্রন্থ তথা সব সমস্যার সমাধান সমাদৃত আল কুরআনেই।
এ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘হে যারা ঈমান এনেছ তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো।’ (সূরা বাকারা : ১৮৩)
হজরত আদম যখন নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তাওবাহ করেছিলেন তারপর তার সন্তানদের উপরে ৩০টি রোজা ফরজ করে দেয়া হয়।
নূহ আ:-এর যুগেও রোজা ছিল। কারণ, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন,
‘হজরত নূহ আ: বছরের অধিকাংশ সময় রোজা রাখতেন।’ Ñ ইবনে মাজাহ ১৭১৪
হজরত দাউদ আ:-এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোজা হজরত দাউদ আ:-এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় থাকতেন।’
রমজান নিয়ে কয়েকটি অসাধারণ বিষয় বাংলা সাহিত্যে পঠিত আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় কবিতা ‘কেন জাগায়লি তোরা’তে। এতে রমজান মাস ও রোজাকে তিনি বিপ্লবীভাবে উপস্থাপন করেছেন। “মাহে রমজান এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’/ নামিবে তাহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।/এই উপবাসী আত্মা, এই যে উপবাসী জনগণ,/ চিরকাল রোজা রাখিবে না-- আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ।”
কবি ফররুখ আহমদ তার ‘শবে-কদর’ কবিতায় লিখেনÑ
‘এখনো সে পুণ্য রাত্রি নামে পৃথিবীতে, কিন্তু প্রাণ
এক অন্ধকার ছেড়ে অন্য এক আঁধারে হারায়,
ঊর্ধ্বের ইঙ্গিত আসে লক্ষ মুখে, অজস্র ধারায়;
নর্দমার কীট শুধু পাপ-পঙ্কে খোঁজে পরিত্রাণ।
.... আত্মার প্রশান্তি গ্রাস করে ছায়া উদভ্রান্ত মতের;
সে আজ দেখাতে রাহা এ সংশয়, ... শবে কদরের’
রমজান সৃষ্টিকর্তাকে নিজের সততা ও বিশ্বাস দেখানোর মাস।
‘রোজাদারের জন্য দুটি খুশি। একটি হলো তার ইফতারের সময়, আর অপরটি হলো আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’(বুখারি ও মুসলিম)
এ মাসেই ত্যাগের মহিমা প্রকাশ করা যায়। মানুষ চাইলেই লুকিয়ে থেকে, মানুষের অন্তরালে আহারে দিনাতিপাত করতে পারে। অথচ একমাত্র আল্লাহভীতির কারণে দীর্ঘ এক মাস নিজের সততার পরিচয় দিয়ে আসে।
সাহিত্যে এ সততার পরিচয় খুব বেশি তাও বলা মুশকিল। রমজান মাস এবং রোজা প্রসঙ্গ নিয়ে খুব একটা সাহিত্য চর্চা কিংবা লেখা না হলেও রমজান মাসকে সাহিত্যিক ও সম্পাদকরা ভিন্নভাবে ব্যবহার করে থাকেন এবং বস্তুত দুনিয়াবি কাজে ফায়দা নিয়ে থাকেন। রমজান মাস আসার প্রায় কয়েক মাস আগে থেকেই দেশের পত্রিকাগুলো ঈদ সংখ্যা প্রকাশ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একটা সময় এটি পহেলা বৈশাখ সংখ্যা হিসেবে বের করা হতো। একমাত্র রোজার বিষয় না থাকলেও রোজার ঈদ সংখ্যা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় এ সংখ্যা। দেশের উল্লেখযোগ্য ও জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের লেখা নিয়ে সজ্জিত করেন এ সংখ্যা, যেখানে রমজান মাস কিংবা রোজা নিয়ে লেখা থাকে বলে মনে হয় না। অথচ থাকে রাজনৈতিক এবং সুরসুরিমূলক প্রেমের অখাদ্য পরিবেশনা। এর জন্যই আসলে কারা দায়ী ঠিক করা বলা মুশকিল।
অনেক প্রকাশক এবং সম্পাদক বলে থাকেন অধিক বিজ্ঞাপন তথা পত্রিকার বাণিজ্যিক কারণে এটি করা হয়। তাদের কথা অনুযায়ীই অপনীত হওয়া যায় যে শুধু রমজান নয়, যেকোনো উৎসবেই বাণিজ্যিক বিষয় বিবেচনার কারণে মূল প্রসঙ্গ হারিয়ে যায়। প্রসঙ্গত, সাহিত্যিকরা যতই রসালো লেখা লেখুক, প্রকাশ কিংবা সাহিত্য সম্পাদক না ছাপালে তা কখনো পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছাবে না। সে অনুযায়ী মৌলিক বিষয় হারিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে সম্পাদক কিংবা প্রকাশ যে প্রথম দায়ী তা অস্বীকার করার জো নেই।
আবার ভয়ের কথাও বলা চলে যারা রমজান মাসকে নিয়ে লিখেন মানে ইসলাম ও কুরআনের কথা যে লেখায় আসে এতে করে পশ্চিমা ধাঁচের প্রায় বেশির ভাগ বাংলা সাহিত্যিক এটিকে এড়িয়ে যেতে চান এবং অনেকাংশে বাঁকা চোখে তাকান।
মূলত এ কারণেই সাহিত্য সংযত অবস্থায় পাঠক মহলে পৌঁছাতে পারেনি। সত্যিকার অর্থে যে উৎসব উপলক্ষে পত্রিকা একটি সংখ্যা বের করতে চাইবে সে উৎসবের সব দিক সংখ্যায় ফোটে ওঠা উচিত। অন্যথায় বাণিজ্যিক বিষয় বিবেচনা করে মূল বিষয় হারিয়ে গেলে সাহিত্য প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে। আর এর জন্য লেখক সাহিত্যিকরা যেমন দায়ী তেমনি দায়ী সম্পাদক ও প্রকাশ এর বলি হচ্ছেন পাঠক। এবারের রজমান মাস উপলক্ষে সব গ্লানি আর ক্লেদ মুছে সাহিত্য এবং পত্রিকার সাহিত্য পাতা ফিরে পাক সজীবতা। যেখানে প্রসঙ্গ এবং উৎসই হবে মূল বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল