২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জ্ঞানতাপস সৈয়দ আলী আহসান

-

সৈয়দ আলী আহসান নামক এই জ্ঞানতাপসের সাথে আমার পরিচয় কবি আল মাহমুদের অফিস কক্ষে তারই মাধ্যমে হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর কয়েক দিন আগে পর্যন্ত আমি তার পিছে পিছে লেগেছিলাম কিছু একটু নেয়ার জন্য। কতটুকু নিতে পেরেছি জানি না, তবে বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের প্রাচীন যুগ, মধ্য যুগ ও আধুনিক যুগের সব ঘরানা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা আমি পেয়েছি সত্যি কথা বলতে তারই কাছ থেকে। বিশ্ব সাহিত্যের অনেক লেখক-কবির সাথে স্যারের ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। যার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য পাতায় ফি-বছর নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হলে, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক-কবিদের নিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম লিখতেন। এখানে একটি কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয় যে, সেনেগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট , ফরাসি ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি- লিইপোল্ড সেভর সংঘের ছিলেন স্যারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্যারকে নিয়ে লেখা তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন-
“তুমি এলে,
তোমার চোখ আমার চোখের
সামনে দিয়ে চলে গেলো,
তোমার চোখ ঈষদুষ্ণ বাড়ির স্পর্শে
চুম্বকের স্বাদ পেল।”
তাঁকে নিয়ে বিখ্যাত কবি লেখক প্রবন্ধকার-অন্নদাশংকর রায় লিখেছিলেনÑ “তিনি একজন সত্যিকারের কবি। যেমন হৃদয়বান তেমন রূপদর্শী। যে ভাষায় লেখেন তা খাঁটি বাংলা। তাঁর কবি পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ পরিচয়।” আধুনিক উর্দু কবি- কলিম সাসারামী বলেছিলেন, “যখন বিধাতা সাহিত্যের জন্য একটি উজ্জ্বল কেন্দ্রবিন্দুর কথা ভাবলেন, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্যের দিগন্তে আবির্ভূত হলেন কিরণসঞ্চারী সূর্যের মতো! এবং তখন কাব্যলোকে আনন্দের সারতসার এবং উচ্ছলতা উৎফুল্লে নৃত্যরত হলো। স্বর্গ থেকে ধরিত্রী পর্যন্ত উপাদান সঙ্গীতে সমৃদ্ধ হলো।”
যা হোক, সময়ের আবর্তনে তার নিজ বাসভবন ধানমণ্ডিসহ, ঢাকা শহরের বিভিন্ন সাহিত্য আসর বা সাংস্কৃতিক আড্ডায়- যখনই তাকে অবসর পেয়েছি, নানা ছলছুতোয় নানা প্রশ্ন কোরে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছি। তিনি কখনোই আমার ওপর রেগে ওঠেনি। শান্ত শীতল চোখে চেয়ে মৃদু হেসে তিনি আমর সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আমার সাথে তার তিনটি বিষয়ের ওপর আলোচনা হতো সবচেয়ে বেশি। সেসব আলোচনার অত্যন্ত মূল্যবান বিষয়গুলোÑ যেগুলো আমাকে বিস্মিত করেছে, যেগুলো যেকোনো পাঠক বা শ্রোতা শুনলে বা পড়লে অবাক হবেন, সে গুলোই আমি এখানে তুলে ধরব।
বাংলা সাহিত্য: তখন এমন একটা সময় ছিলযে, প্রতিদিন একটি বার আমি যদি অবজারভার ভবন থেকে প্রকাশিত-কিশোর বাংলা; ডিএফপি, থেকে প্রকাশিত-নবারুন, সচিত্র বাংলাদেশ; বাংলাদেশ শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত- শিশু; বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত-ধান শালিকের দেশ, উত্তরাধিকার প্রভৃতি পত্রিকা অফিসে না যাই তো রাত্রে মনে হয় ঘুম আসত না। প্রতিদিন যাওয়া হতো এসব পত্রিকা অফিসগুলোয় আর গেলে পরেই প্রতিদিন নতুন নতুন সব নবীন-প্রবীণ ছড়াকার, কবি, গীতিকার, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, সম্পাদক এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসারপ্রাপ্ত অধ্যাপকসহ অবসারপ্রাপ্ত সেনা অফিসার এবং সচিব পর্যায়ের লোকজনদের সাথেও পরিচয় হতো। এতে আমি অবাক হতাম। তাদের দিয়ে আমি নানা সময়ে অনেক বড় বড় কাজ করিয়ে নিয়েছি; যার কারণে আত্মীয়-অনাত্মীয়রা মনে মনে আমাকে বিশাল একজন ভাবত।
যা হোক, আমি নবারুনে লেখা দিয়ে দিয়ে সোজা গেছি শিল্পকলা একডেমিতে। তখন প্রায় দুপুর। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আমি কবি আল মাহমুদের অফিসে ঢুকতেই দেখি স্যার বসে আছেন। স্যারকে সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বসলাম। কবি আল মাহমুদ আমাকে বললেন, দেখ বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছেÑ আজ কোনো কথা নেই। আজ আমরা একটু নীরবতা পালন করব। স্যার হেসে বললেন, তা কি আর হবে কবি? না, ও খুব ভালো ছেলে ওকে প্রশ্ন করতে দাও, ওকে জানতে দাও! তো আজকে তোমার মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছে? হাসতে হাসতে বললাম যে, স্যার, বাংলা কাব্য সাহিত্যে আমাদের যে দুই দিগন্ত, রবীন্দ্রনাথ আর কাজী নজরুল ইসলাম। তাদের দু’জনের জনপ্রিয়তার কথা তো আপনি আমার চেয়ে অনেক ভালো এবং বেশিই জানেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি এই দু’জনকে উতরে যাওয়া আর কোনো কবির পক্ষেই সম্ভব নয়! এই দু’জনের সম্পর্কে আমি আপনার মুখ থেকে আপনার নিজস্ব মতামত শুনতে চাই। আপনি একটু বলবেন।
মুচকি হেসে স্যার তখন তার সেই নিজস্ব ঢঙে বলতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, এই ধরনের লোকজনের কথাতে কান নে দেয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা এরা এই দুই মহান কবির দু-একটি লেখা পড়েছেন, মুখস্থ করেছেন; পরীক্ষায় পাস করার জন্য, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। এ ধরনের লোকজনের উনাদের সম্পর্কে কি বলবে, বলার মতো সেই পড়াশোনা বা মেধা তো নেই। সুতরাং ওসব লোকজনের কথাতে কান না দেয়ায় ভালো। তুমি যেহেতু লেখালেখি করো, তাই সারা জীবন এদের দু’জনকে খুব ভালো করে পড়বে, বারবার পড়বে। এ ছাড়া বাংলা সাহিত্যে কিন্তু আরো একজন কবি আছেন, যিনি সাংঘাতিক, তুমি হয় তো তেমন একটা পড়োনি; তিনি হচ্ছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধুসূদনের লেখা তোমার কেমন লাগে? খুব কঠিন তাই না? পড়বে বারবার পড়বে, মধুসূদন কিন্তু বিশাল এক কবি! আমি তাকে নিয়ে কিছু কাজ করেছি, তখনই বুঝেছি।”এই কথার উত্তরে আমি বলেছিলাম, “মধুসূদনের ওপর আপনার লেখা একটি বই- মধুসূদন : কবিকৃতি ও কাব্যাদর্শ আমি পড়েছি স্যার, আমার খুব ভালো লেগেছে।” বাংলা কাব্য সাহিত্য নিয়ে আরো অনেক কথাই হয়েছিল স্যারের সাথে। তো তিনি অত্যন্ত সহজে একজন কবি বা লেখক সম্পর্কে যে মন্তব্য করতে পারতেন, এটি ছিল আমার কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের ব্যাপার। তার মন্তব্য প্রকাশের ঢঙ ছিল একেবারে আলাদা।
বাংলাদেশ ও বিশ্ব চলচ্চিত্র : শিল্পকলায় একটি বেসরকারি চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব চলছে তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। তখন প্রায় প্রায় স্যারের সাথে বিভিন্ন জায়গায় দেখা করি আর তার মন্তব্য শুনি। তো সেই সুবাদে গেছি অনুষ্ঠানে। চলচ্চিত্র যে একটি বিশাল শিল্প মাধ্যম, তিনি তার ওপর অসাধারণ এক বক্তৃতা করলেন। দর্শক-শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বক্তৃতা শুনলেন। কে যে সেই বক্তৃতা বুঝেছিলেন। তা আমার জানা নেই, তবে আমি যে বুঝিনি সেটা আমি বলতে পারি নির্দ্বিধায়। সেই বক্তৃতায় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা বিষয়ের ওপর লিখিত জগদ্বিখ্যাত একটি বইÑ মেকিং এ ফিল্ম” এবং তার লেখক টি সি ব্রিজেস অ্যান্ড এইচ এইচ টিল্টম্যান সম্পর্কে বলেছিলেন। আমি পরের সপ্তাহেই ঢাকা নিউ মার্কেটের নলেজ হোম লাইব্রেরি থেকে বইটি কিনে পড়েছিলাম। অসাধারণ বই। বলা যায় তখন থেকেই আমার চলচ্চিত্রের ওপর একটি মোক্ষম ধারণা জন্মায়। যে কারণে পরবর্তীকালে আমি চলচ্চিত্র শিল্পের সাথে জড়িয়ে পড়ি। স্যার তাঁর সেই বক্তৃতায় স্তানিস্লাভোস্কি, আজেনস্তাইন, রামগোপাল ভার্মা, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃনাল সেন, আলফ্রেড হিচকক, রোমান পোলানস্কি, মোস্তফা আক্কাদ, কার্লো পন্টি- প্রমুখ বিশ্বখ্যাত সব চলচ্চিত্র পরিচালগণের কথা বলেছিলেন। পরবর্তীকালে অনেক কষ্ট করে আমি তাদের পরিচালিত বেশ কটি ছবি দেখেছিলাম। যার ফলে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমার একটি সঠিক ধারণা জন্মায়। আমি ওই সময়ে স্যারকে আমাদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, স্যার বলেছিলেন, “ঋরষস সধশরহম রং াবৎু নরম ধহফ পড়সঢ়ষরপধঃবফ রহফঁংঃৎু. ঞড়ফধু’ং ভরষস ঃড়সড়ৎৎড়ি রং হঁপয হড়ৎব ড়ষফ. ঊাবৎুফধু রঃ হববফং হবি ধহফ সড়ৎব হবি ড়হব ঃযরহমশরহম” তার পরে তিনি আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, এমন একদিন আসবে যখন এই বাংলাদেশের ছবি সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলবে, তবে এখন নয়। এর জন্যে সময় দিতে হবে, চলচ্চিত্র পরিচালকদের অধ্যবসায়ের প্রয়োজন আছে। আসতে হবে নতুন প্রজন্মের মেধাবী এবং হাতে কলমে প্রশিক্ষিত পরিচালক। আসতে হবে চলচ্চিত্রের নির্মাণ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে লিখতে পারা গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আমাদের দেশে বেশ কিছু ভালো ভালো ছবি হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হবে। তবে এখন যা হচ্ছে তা রুপালি ফিতায় বন্দী বায়োস্কোপের নামান্তর। তবে সারা বিশ্বে ভালো ছবির পরিবর্তে ব্যবসায়িক ছবি বেশি হয়। যাদের কোনো মান থাকে না। সে হলিউডই আর বোম্বে, মিসর বা চীন, জাপান হোক। সাধারণ মানুষে দেখে মজা পায় এই আর কী! সেখানে শিল্প মান কিছুই থাকে না। তবে আমি মাঝে মধ্যে টেলিভিশনে বিভিন্ন দেশের ছবির কিছু কিছু অংশ দেখি। মাঝে মধ্যে ভালো লাগে এবং অবাক হই যে, এমন শিল্পসম্মত চলচ্চিত্রও পৃথিবীতে নির্মিত হয়!
আমাদের সঙ্গীত তথা বিশ্ব সঙ্গীত : বাংলাদেশের বেশ কিছু শহর আছে জায়গা আছে যেমন: সৈয়দপুর, খুলনা, পার্বতীপুর, শান্তাহার, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুষ্টিয়া, যশোর। এসব শহরের বিভিন্ন মহল্লায় এখনো বিহারিদের বসবাস বেশি। শুধু বেশিই নয় তারা রীতিমতো রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি শিল্প, সাহিত্যেরও বেশ বড় বড় জায়গা দখল করে বসে ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে। পুরান ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিহারিদের বসবাসকারী জায়গাগুলোতে ধনী বিহারি ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসাররা মিলে এ দেশে পাকিস্তান বা ভারত থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশ বড় বড় ওস্তাদদের মোটা টাকার বিনিময়ে এ দেশে আনতেন এবং রাতভর গানের জলসা বসাতেন। ঢাকায় আমি এমন বেশ কিছু জলসায় গেছি। এমন এক জলসায় ধানমন্ডির এক বিহারিবাড়িতে আমার সাথে একদিন পরিচয় হয় জামালপুরের শ্রীপুর অঞ্চলের বিখ্যাত সেতারের ওস্তাদ মহিউদ্দীন শ্রীপুরীর সাথে। আমি তার সেতার বাজানো দেখে মুগ্ধ হয়ে নিউ মার্কেটের সুর নিকেতন থেকে একটি সেতার কিনি মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় এবং সেতার বাজানো শিখতে শুরু করি। তখনই আমি পরিচিত হই সেতারের ওস্তাদ সমীর দাসের সাথে। বলা যায় তখনই আমার সঙ্গীতের ওপর মোটামুটি ধারণা তৈরি হয়। অন্তত কোনটি সুর আর কোনটি বেসুর তা বুঝতে শিখি। সঙ্গীতের নানা ঘরানা এমনকি সুর সৃষ্টির নানা ধরনের কলাকৌশল সম্পর্কেও আমি ধারণা পাই। এমন একদিন শিল্পকলা একাডেমিতে একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে আমি স্যারকে দেখি এবং বিস্মিত হই। কেননা এটি তো কোনো সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠান নয়, এটি তো সঙ্গীতের অনুষ্ঠান এখানে স্যার কেন? অনুষ্ঠান শেষে চা-পানের আড্ডায় মুচকি হেসে আমি স্যারকে সঙ্গীত সম্পর্কে নানা ধরনের প্রশ্ন করি। বিশেষ কোরে পশ্চিমের ইংরেজি সঙ্গীত সম্পর্কে। তিনি ভারতীয়, আফ্রিকান, লাতিন, আমেরিকান, আরবীয়, ইউরোপ এমনকি আজকের আমেরিকান সঙ্গীত যেমন: পপ, জাজ, ব্লুজ, রক, রোল, রক অ্যান্ড রাল, কান্ট্রি সং এমনকি ভাংড়া সঙ্গীত সম্পর্কে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, আমাদের দেশের সরকারি বা বেসরকারি কোনো সঙ্গীত কলেজের শিক্ষকের পক্ষেও, তা সম্ভব নয়। কেননা সেতার হাতে নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশের বহু সঙ্গীত পরিচালকের বাড়িতে সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও গানের জলসায় আমি গেছি, সেসব জায়গায় আমি এমন উচ্চমার্গীয় কোনো আলোচনা শুনিনি। এ জন্যই কথাটা বলা। তিনি বলেছিলেন, ‘মাইকেল জ্যাকসন, স্টিভি ওয়ান্ডার, হুইটনি হাউস্টোন, বব মার্লি, ক্লিফ রিচার্ড, পল রবসন, কেনি রজার্স, জর্জ হ্যারিসনÑ এরা হচ্ছেন অনেক উচ্চমার্গীয় শিল্পী। এরা সঙ্গীতে ঝরনা ধারার থেকে সুরের প্রবাহমান নদীর স্রোতের সৃষ্টি করেন। মনে রাখবে গীতি, নৃত্য, বাদ্য এই তিনটির সমন্বয়ে উদ্ভূত অনুভূতিকেই সঙ্গীত বলা হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমাদের শিল্পীরা কোথায় পিছিয়ে আছে।’
বাংলা নাটক তথা বিশ্বনাটক : বাংলাদেশের নাটক সম্পর্কে তার ছিল অগাধ ধারণা এবং তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করতেন। সে টেলিভিশনের নাটক হোক আর মঞ্চনাটক হোক। তিনি বলতেন, ‘বাংলা সাহিত্যে নাটক দখল করে আছে উল্লেখযোগ্য এক জায়গা। শিল্পসাহিত্য সংস্কৃতির জগতের এক বিশেষ জায়গা দখল করে আছে বলেই স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বেশ কিছু মঞ্চনাটক রচনা করেছিলেন- যার মধ্যে বিসর্জন অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। নাটক হচ্ছে অভিনয় শেখার একটি মূল জায়গা। মঞ্চনাটক অভিনয় শিল্পী বানায়, অভিনয় শেখায়; যার জন্য এ নাটকই এক দিন দেখবে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রধান কাণ্ডারি হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে বিশ্বসাহিত্যে প্রবেশের দ্বার হবে নাটক। টেলিভিশনে চলত বিশ্ব নাটক সেই সাথে ঢাকার বেশ ক’টি নাট্যদল সেই সময়ে মঞ্চে এনেছিল বিশ্বখ্যাত বহু নাট্যকারের মূল্যবান সব নাটক। ভবিষ্যতে আরো হবে। এর মধ্যে শেক্সপিয়র ও মলিয়ের উল্লেখযোগ্য।
আমাদের নৃত্য, ভারতীয় নৃত্য ও বিশ্ব নৃত্য শিল্প : ভারতীয় নৃত্যের কথক, মনিপুরি ও ওডিসি সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ও অতি উচ্চমার্গীয় নৃত্যশিল্প হিসেবে পরিচিত। এই তিন নৃত্যের মহাগুরু নৃত্যশিল্পী হচ্ছেন লীলা শ্যামশন। একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা নৃত্য প্রদর্শন করে দর্শক শ্রোতাকে তাক লাগিয়ে দেয়ার বিরল এক রেকর্ডের মালিক এই নৃত্যশিল্পী। যেমন তার দেহবল্লরী! তেমন তার রূপ! তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্য প্রদর্শন করেছিলেন। আমি কবি আল মাহমুদের সহযোগিতায় সেই নৃত্যানুষ্ঠান উপভোগ করেছিলাম। মধ্যবয়সী নারী তিনি! কিন্তু কী যে নৃত্যের বাহার! কী যে তার শারীরিক শক্তি! কী যে তার শারীরিক কসরত! তা তিনিই জানেন, আর যারা তার নৃত্য উপভোগ করেছেন তারাই শুধু বিস্মিত হয়ে বলতে পারবেন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, আহা রে, নৃত্যও যে একটি শিল্প! তা চোখে না দেখলে বলা যাবে না। আমি ক’দিন পরে স্যারের দেখা পেলাম একটি স্বরচিত কবিতা পাঠের আসরে। সেখানে বাংলাদেশের বেশ বড় বড় কবিরা কবিতা পাঠ করতে এসেছেন। আমি অবশ্য কবিতা পাঠের সুযোগ পাইনি কেননা আমি তো আজো অত বড় মাপের কবি না! আমি গেছি স্যারের সাথে দেখা করব আর নৃত্য সম্পর্কে কিছু কথা জানব। কবিতা পাঠের আসর শেষে সবাই নানান কথায় ব্যস্ত। এর মধ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে, লম্বা এক সালাম জানিয়ে স্যারের সামনে হাজির হতেই তিনি তার স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি এখানে? তো এলেই যখন তখন একটা কবিতা পড়লে না কেন?’ আমি নিশ্চুপ। পাশে সোফায় বসে নানান কথায় জানতে পারলাম উনি আরো কিছুক্ষণ এখানে থাকবেন। ধীরে ধীরে প্রশ্ন করি এটা সেটার। পরে একসময়ে নৃত্য শিল্পের বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করলাম। তিনি শুরুই করলেন ইংরেজি সাহিত্যে নৃত্য, কোরাস ও ব্যালের প্রসঙ্গ নিয়ে। শেষ করলেন রামায়ণ মহাভারত এবং হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে নৃত্যশিল্পের অবস্থান দিয়ে। ওহ, কী যে তাঁর বর্ণনা! কী যে তাঁর কথার মধ্যে তত্ত্ব, তথ্য এবং ইতিহাসের বর্ণনা! তা বলে শেষ করা যাবে না! এমনকি রাশিয়া, ইতালি, গ্রিস প্রভৃতি দেশে যে উচ্চমার্গীয় ব্যালের প্রচলন আছে সে সম্পর্কেও তিনি বিশদভাবে বলেছিলেন। যতবারই যে বিষয়ে আমি স্যারের সাথে কথা বলেছি, ততবারই উত্তর পাওয়ার পরপরই আমি অবাক হয়েছি। আর ভেবেছি কী করে সম্ভব একজন মানুষের পক্ষে এত কিছু জানা! বিশেষ কোরে এই বয়সেও এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রাখা কি সম্ভব? স্যারের পক্ষে সম্ভব ছিল, আমাদের পক্ষে নয়! হ


আরো সংবাদ



premium cement