২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এক গন্তব্যহীন বালকের গল্প

-

১৯৭১ সাল।
সীমান্তবর্তী চুনারুঘাট থানা। তিন নম্বর সেক্টর এলাকা। গোছাপাড়া গ্রাম।
রাজার বাজার প্রাইমারি স্কুলে পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাম্প বসেছে। এলাকায়, হাটে বাজারে জনচলাচল সীমিত। শোনা যাচ্ছে এরা নাকি ইউসুফ খানের দল। আতঙ্কে মানুষ আখের ক্ষেতে লুকিয়ে থাকল কয়দিন। কিছু দিন কেটে গেলÑ রাজাকারদের লাফঝাপ, এ বাড়ির মুরগ, ওবাড়ির খাসি টানাটানি করে। মাঝে মধ্যে বাল্লা সীমান্ত অভিমুখী লোকাল বোর্ডের রাস্তায় খানসেনাদের আনাগোনা দেখা যায়।
মন্টু তখন এগারো বছরের বালক। গণ্ডগোলে স্কুল তখন বন্ধ। পড়াশোনা করতে হয় না। সে দিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ। অন্যান্য দিনের মতোই সেই রাতেও খাওয়ার পর ঘুমাতে যায় মন্টু। তারা তিনজন পুবের ঘরে থাকত। মন্টু, বড়দা টেনু ও পিসতুতো ভাই মনোরঞ্জন। মনোরঞ্জন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ত। সে এখানেই থাকত। তার বাড়ি বাহুবলের জাইরা গ্রামে। সবাই ঘুমের ঘোরে। হঠাৎ কিছু মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু ভাষা স্পষ্ট নয়। দাদাকে জাগাল মন্টু, মনোরঞ্জনও জাগল। দাদা চুপ থাকতে বলল। বাবা অক্ষয়চন্দ্র শুক্লবদ্য। বাবার কান্না শুনেই সবাই বুঝে গেলÑ পাঞ্জাবিরা আক্রমণ চালিয়েছে। তখন সময় আনুমানিক রাত ৪টা হবে। প্রতিরাতের মতো বাবা উঠে গরুকে ঘাস-খড় দিচ্ছিলেন, গোয়ালঘর থেকে ফেরার পথে পাঞ্জাবিরা তাকে আটক করে। কিছুক্ষণেই তার মেজো কাকা যতীন্দ্রকে মারধরের ও কান্নার আওয়াজ শোনা গেল।
এ দিকে মন্টুরা তিনজন ভয়ে কাঁপছিল। মন্টু দাদাকে বলল, চলো আমরা বেড়া ভেঙে পালিয়ে যাই। দাদা রাজি হলো না। বলল, বাবাকে ওদের হাতে রেখে পালাতে পারব না। অগত্যা তিনজনই বাইরে বেরিয়ে এলো। ওরা দুইজন সামনে, মন্টু পেছনে। পেছন থেকে সে সরে একটু অন্ধকার পথের দিকে পা বাড়ায়। কয়েক পা যেতেই ‘টেরো’ শব্দ শুনে থমকে দাঁড়ায় এবং ফিরে আসে। ওর মেজো কাকার বারান্দায় বাবা, কাকা, দাদাকে বসিয়ে রাখল। মনোরঞ্জন ও মন্টু তাদের পেছনে বসে পড়ল। তাদের কাছাকাছি তরিক চৌকিদারকে পাঞ্জাবিদের সাথে দেখা যাচ্ছে। আমুরোড রেল গুদামের পেছনে থাকে সে।
হঠাৎ দেখা গেল রাখাল কাকার দরজা ভেঙে উনাকে টেনে হেঁচড়ে ধরে এনে বসিয়ে রাখল। একজনকে পাহারায় রেখে বাকিরা সব ঘর তন্নতন্ন করছে। একটু সুযোগ বুঝে মন্টু ও মনোরঞ্জন পালবাড়ির দিকে ছুটে। পাল বাড়ির দিকে যেতেই দেখে সেখানেও পাঞ্জাবিরা। ভয়ে পা চলছিল না। কাঁপতে কাঁপতে পশ্চিম দিকের ধানের বাইন ক্ষেতের দিকে পালিয়ে যায় দু’জন। কয়েক বিঘা দূরে ধানগাছের আঁড়ালে লুকিয়ে পড়ে তারা। মাঝে মধ্যে টর্চের আলোতে হানাদারদের নৃশংসতা দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ দেখা গেল, পাল বাড়ির রাখাল ছাবু মিয়া পুরো উলঙ্গ অবস্থায় ওদের দিকে দৌড়ে আসছে। তাকে আস্তে করে ডেকে থামিয়ে দিলো মন্টু। তার গায়ে জড়ানো গামছা পরতে দিলো ছাবুকে। তাকে নাকি তারই লুঙ্গি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। কোনো রকম সে পালিয়ে আসে।
তখন অন্ধকার কমতে শুরু করেছে। হঠাৎ দেখে তার কাকা গোপাল প্রাণপনে ছুটে আসছেন। তাকে থামিয়ে জানা গেল, বাড়ির নারী, শিশু সহ সবাইকে পাল বাড়িতে নিয়ে গেছে।
হঠাৎ আগুনের লেলিহান শিখায় সমস্ত গ্রাম তপ্ত হয়ে ওঠে। ধোপাবাড়ি, পালবাড়ি নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে প্রচণ্ড গুলির আওয়াজ। একসাথে ডজন প্রায় তাজাপ্রাণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আগুনের লেলিহান শিখায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ধোপাবাড়ি, পালবাড়িতে যেন শতচিতা একসাথে জ্বলে ওঠে। ভোরের হালকা আলোয় মনে হচ্ছিল শ্মশানে পরিণত হলো দুটো বাড়ি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, নারী, শিশুদের নিয়ে হানাদার বাহিনী পুবের রাস্তার দিকে চলে গেল।

তখন সূর্যের আলোয় আলোকিত চার দিক। এদিক, ওদিক থেকে বালকেরা ছুটে এসেছে। মন্টুও গুটিপায়ে পালবাড়িতে গেলো। স্পষ্ট দেখতে পেল, এখানে বাবা, ওখানে মেজো কাকা, বড়দা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে নিথর দেহে। পাল বাড়ির আরো চারজন ভূমিতে লুটিয়ে আছেন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে। হঠাৎ কান্না শুনে ওর বড়দা নড়েচড়ে বলেওঠে,‘মন্টু, তুই বেঁচে আছিস, একটু জল দে না (অস্ফুট আওয়াজে)।’ ঠিক তখনই এক বালক বলে ওঠে, ‘পাঞ্জাবি আসছে।’ প্রাণভয়ে সে পালিয়ে যায়। অনেকটা পর দুই হাতে পুকুরের জল নিয়ে ফিরে আসে। তখন ওর বড়দা আর নেই। আঙুলের ফাঁকে জল কখন পড়ে গেল, বলতে পারে না। কিছুক্ষণ মাটিতে বসে থাকে। মন্টু তখন এক গন্তব্যহীন পথহারা বালক। আপন বলতে আর কেউ তার চোখের সামনে নেই। সে এখন কী করবে, কোথায় যাবে? তার গন্তব্য জানা নেই।
মন্টু বাবুর সব হারানোর গল্প শোনে হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমিও কাঁদছি। মন্টুচন্দ্র অনেকক্ষণ চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি এখন বালক নেই, বয়স ষাটের কাছাকাছি। তার কাছেই সব শোনে বাকরুদ্ধ তাকিয়ে রই।
তিনি আবার বলতে লাগলেন :
পরে শুনলাম নারী শিশুরা নাকি পাশের মহাজন বাড়িতে জিম্মায় আছেন। মহাজন বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। একটু এগিয়েই দেখলাম পাশের এক চারা জমিতে পরিচিত দু’জন মুসলমান আব্দুর রশিদ ও রওশন আলীর লাশ পড়ে আছে। এ নিয়ে নয়জনের লাশ দেখলাম।
গন্তব্যহীন এ দিকে ওদিকে ঘুরে বেলা একটু গড়াল। মনোরঞ্জন, গোপাল কাকাও কোথায় গেল জানি না। বিকেলে চলে আসি পশ্চিম দিকে নূর মিয়ার বাড়িতে। এখানেই খেয়ে রাত কাটাই। পরদিন সকালে কাউকে না বলেই ভারতের উদ্দেশে একাই রওনা দিই। রাস্তায় পরিচিত একজনকে পেয়ে হেঁটে বেলছড়ায় এক আত্মীয় বাড়িতে চলে যাই।
বিকেলে আবার দেশে ফিরে আসি একাই। এলোমেলো ঘুরে ঘুরে জানতে পারলাম, মা কাকীরা মহাজন বাড়িতে জিম্মায় আছেন। রাত পর্যন্ত মা, কাকীদের সাথেই থাকি। রাত ১০ টার দিকে হানাদারদল মহাজন বাড়িতে আসে। হানাদাররা যাওয়ার সময় মা ও দুই কাকী মাকে নিয়ে গেলো। আমরা কান্নাকাটি করছিলাম। সে কান্না নরপশুদের স্পর্শ করেনি। তারা যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলেন সবার দিকে; ভয়ে সবাই বাকরুদ্ধ, চোখ ছলছল।
পরদিন আমি আবারো বেলছড়াতে চলে যাই। সেখান থেকে পদ্মবিল এলাকার আর এক আত্মীয় বাড়িতে কিছু দিন কাটাই। একমাস পর গৌড়াঙ্গটিলার শরণার্থী শিবিরে সবাই চলে যাই। সেখানে বেঁচে থাকা অনেককেই পেয়ে যাই। শরণার্থী জীবনের কথা আর নাইবা বলি।
দেশ স্বাধীন হলো, সবাই ফিরে আসে, ফিরে এলেন নরপশুদের হাতে বন্দী মা কাকীরাও; ফিরেননি কেবল, যাদের রক্তে সেদিন পালবাড়ির মাটি লাল হয়েছিল। শ্মশানপুরী- ধোপা বাড়ি, পালবাড়ি আবারো কোনোভাবে দাঁড়ায়।
স্বাধীনতার বহু বছর পর নরপশুদের নির্যাতনের শিকার তিন নারীর দু’জন বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রীয় খেতাব পেলেন, আমার মা সব হারিয়েও বীরাঙ্গনার সম্মান ছাড়াই একদিন পরপারে গেলেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement