২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সৈয়দ আলী আহসান জন্মশতবর্ষ

তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কিছু স্মৃতি

-

গত সংখ্যার পর

তাঁর পরবর্তী অসাধারণ বক্তৃতার সময় আমি সেখানে ছিলাম না, সেটি হলো বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনে, যা অনুষ্ঠিত হলো কলকাতায় ২৯ আগস্ট। সে অনুষ্ঠানে সভাপতি এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন যথাক্রমে অশোককুমার সরকার এবং অম্লান দত্ত। প্রধান অতিথিরূপে সৈয়দ আলী আহসান সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন।
কলকাতায় অনেক বৈঠকে ও অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপন ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাষণ প্রদানের সুযোগ হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতীতে সেবার ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্র তিরোধান দিবসে তাঁকে প্রধান অতিথিরূপে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানকার সুপ্রবীণ অধ্যাপক ও প্রাজ্ঞ পুরুষ প্রবোধচন্দ্র সেনের উদ্যোগে এটি সম্ভবপর হয়। শোনা যায়, বাংলাদেশের কোনো বুদ্ধিজীবী সময় ও অর্থ ব্যয় করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে এটি যেন না ঘটে, তা বলতে গিয়েছিল। কিন্তু তা যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং তিনি রবীন্দ্র প্রসঙ্গে এক চমৎকার ভাষণ উপস্থাপন করে আসেন। সেখানে তিনি সস্ত্রীক রতন কুঠির এক নম্বর কক্ষে অবস্থান করেছিলেন কয়েক দিন। এর সাত বছর পর আমিও সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে গিয়ে একই কক্ষে থাকি এবং প্রবোধ সেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করি।
কলকাতার বাইরে মুক্তিযুদ্ধের এই অনন্য প্রবক্তা তিনবার বক্তৃতার উদ্দেশে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। প্রথমবার তিনি যান ব্যাঙ্গালোর। সেখানকার ‘গান্ধী স্মারকনিধি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। ২৩ জুলাই বেলা ৩টায় তিনি বিমানে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছান এবং সাড়ে ৫টায় ন্যাশনাল কলেজের অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশের ওপর একটি বক্তৃতা দেন। পরদিন সকাল ১০টায় গান্ধী ভবনে একটি প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। সেখানে প্রদত্ত তাঁর বক্তব্য ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় একটি মহিলা কলেজে এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কানাডা সাহিত্য পরিষদে বক্তৃতা করেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় কংগ্রেস এবং ১১টায় ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড কালচার ভবনে তিনি বক্তৃতা করেন। শেষের বক্তৃতাটি ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এবং তাতে ব্যাঙ্গালোরের বিশিষ্ট নাগরিকরা উপস্থিত ছিলেন। বিকেল ৪টায় ‘বিজা এস্টেট’ নামক স্থানে একটি বক্তৃতা করেন। এখানে শ্রোতা সংখ্যা ছিল কম এবং শ্রোতাদের অনেকেই হলেন মুসলমান। ২৬ তারিখেও তিনি দু’টি বক্তৃতা করেনÑ একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এবং অন্যটি গান্ধী সাহিত্য সংঘে। ২৭ তারিখ তিনি মহীশুরে যান এবং ইতিহাস-প্রধান জায়গাগুলো দেখেন। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যোগদান করেন।
এরপর সৈয়দ সাহেব ১ আগস্ট কলকাতায় ইন্দো-সোভিয়েট কালচারাল সোসাইটির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যোগদান করেন।
এর একদিন পর গোলপার্কে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পটভূমি বিষয়ে একটি বক্তৃতা দেন। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক ড. অমলেন্দু বসু। সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সৈয়দ সাহেব দিল্লিতে বাংলাদেশ বিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তা জয়প্রকাশ নারায়ণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রচুর তথ্য রয়েছে, কিন্তু তাঁর নিজের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তেমন কিছু প্রকাশ করেননি। পরে তিনি ইনস্টিটিউট ফর ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বিষয়ে বক্তৃতা করেন।
সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি বোম্বে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং সেখানে বিশিষ্ট বন্ধুজন সান্নিধ্যে তাঁর সময় কাটে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর এই সফর কিছুটা রহস্যজনক। সম্ভবত বড় কোনো বক্তৃতা অনুষ্ঠান হয়নি। অর্থ সংগ্রহই ছিল সমিতির লক্ষ্য। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বক্তৃতার জন্যও তিনি আমন্ত্রণ পান। কিন্তু নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তাঁর যাওয়া হয়নি।
কলকাতায় অন্য অনেক কাজকর্মের মধ্যে প্রধান হলো বাংলাদেশ আর্কাইভসের প্রতিষ্ঠা। সৈয়দ আলী আহসান পরিচালকরূপে এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধ শেষ হলে এর সব কাগজপত্র ঢাকাস্থ আর্কাইভে জমা দেয়া হয়।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আকস্মিক মৃত্যুতে এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে তিনি প্যারিসে প্রয়াত পুরনো বন্ধুর স্মৃতিচারণ করে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতা প্রদান করেন। সেখানে বর্তমান লেখকও বক্তৃতা করেন। উল্লেখ্য, ওয়ালীউল্লাহ সাহেবের সঙ্গে আমার প্রায় এক দশকের সম্পর্ক। তা ছাড়া আকাশবাণীর সংবাদে আমার নাম প্রচারিত হলে দেশে আত্মীয়-স্বজনরা জানতে পারেন যে, আমি আরব দেশে মুক্তিযুদ্ধের মিশন শেষ করে কলকাতায় ফিরেছি।
আরেকটি ক্ষেত্রে সৈয়দ আলী আহসানের মেধা ও প্রতিভার অকৃত্রিম ও উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছিল। সেটা হলো বেতার ভাষণ। আকাশবাণীতে তিনি বাংলা ও ইংরেজি কবিতা ও কথিকা পাঠ করেছেন একাধিকবার। কিন্তু নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। অনুষ্ঠানটির নাম ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুজিবনগর থেকে অনুষ্ঠানমালা প্রচারের বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তারা তাঁর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করত। অনুষ্ঠান প্রচারের সময় দু’বার আমি তার সঙ্গে ছিলাম স্টুডিওর অভ্যন্তরে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে সবিস্ময়ে লক্ষ করেছি, লিখিত কোনো টেক্সট বা নোট না দেখে ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে তিনি পরপর পাঁচ মিনিটের অনুষ্ঠানের কয়েকটি কথিকা রেকর্ড করে যাচ্ছেন।
উপর্যুক্ত বিবরণ বা বক্তব্যগুলোর দু’টি ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। দু’টি ব্যাখ্যাই অনেকের কাছে অজানা। প্রথমত, সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন আবাল্য বাগ্মী। ধামরাইতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কিংবা ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলে অধ্যয়নকালেই তিনি উদীয়মান বক্তারূপে সুচিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। ধামরাইতে তাঁকে কাঁধে করে বক্তৃতা করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হতো আশপাশের গ্রামে। অজগ্র বই পড়ে দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করে বিবিধ ভাষায় সুললিত ধ্বনি শব্দসম্ভার আহরণ করে তার সুচিন্তিত প্রয়োগে তিনি ক্রমাগত সিদ্ধিলাভ করেন।
দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি হলো তাঁর অঙ্কজ্ঞানের বিষয়। সাহিত্যের ছাত্রদের কাছে যা সাধারণত বিভীষিকা-স্বরূপ, সৈয়দ আলী আহসানের কাছে তা ছিল মজার খেলা। অনেক সাধারণ সমস্যা তিনি অঙ্কের মাধ্যমে সমাধান খুঁজতেন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন অঙ্কের এই মেধাবী ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বিভাগে ভর্তির সুপারিশ করেছিলেন সৈয়দ সাহেবের পিতা সৈয়দ আলী হামেদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্র হলেন ইংরেজিতে, ঘটনাচক্রে শিক্ষক হলেন বাংলা বিভাগে। যা হোক, অঙ্কশাস্ত্রের সংহতি ও নিশ্চিত রূপ তাঁর সাহিত্য ভাবনার সাঙ্গীভূত হয়ে পড়ে বলে আমার ধারণা।
মুক্তিযুদ্ধের অনন্য কণ্ঠস্বররূপে সে সময়কার নাজুক পরিস্থিতিতে তার প্রত্যয়ী ভঙ্গির কারণে অনেকেই তাঁর কথা শুনতে ভালোবাসতেন। হ


আরো সংবাদ



premium cement
আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান

সকল