২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সৈয়দ আলী আহসান জন্মশতবর্ষ

তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কিছু স্মৃতি

-

বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যে যে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হলো ১৯৭১ সালে, তার অনন্য কণ্ঠস্বর তথা ব্যতিক্রমী প্রবক্তা হলেন সৈয়দ আলী আহসান। ঢাকায় বাংলা একাডেমি পরিচালনার গৌরবময় অধ্যায়ের অবসানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিনের দায়িত্ব শেষ করে তিনি তখন বাংলা বিভাগের প্রফেসর ও প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্ব অবধি তাঁর অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা যেমন যথাসময়ে যথোপযুক্ত স্বীকৃতি লাভ করেছে, তেমনি অস্বীকৃতির অপপ্রয়াস কিংবা তথ্যবিকৃতির দুর্ভোগও তাঁকে পোহাতে হয়েছে বারবার। অতি সফল মহৎ জীবনের এ এক অতি সরলীকৃত বিড়ম্বনা বটে।
সৈয়দ আলী আহসান তাঁর একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত হওয়ার কাহিনী মোটামুটি বিস্তৃতভাবে, প্রমাণিত দলিলপত্র এবং সর্বোপরি গভীর দার্শনিকতার উপাদানসহ লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটির নাম ‘যখন সময় এল’ (১৯৯২)। সেই মহাগ্রন্থ পাঠ এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই আলোচনায় আমরা সংক্ষেপে তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বর হওয়ার বিচিত্র অথচ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলি তুলে ধরতে প্রয়াস পাবো। প্রথমে আমরা জানত তাঁর অভিপ্রায়ের কথা; তিনি লিখেছেন :
আমার কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল শুভ এবং কল্যাণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আমি সব সময় ভেবেছি, বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমার নিজস্ব সত্তার বিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। আমার ভাষা ও ধ্বনি বিনিময়, আমার বিবিধ ইচ্ছা ও সঙ্কল্প এবং আনন্দের সব কিছুকে আবিষ্কার করতে হলে আমার নিজস্ব এবং স্বাধীন ভূ-কেন্দ্রের প্রয়োজন। আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের অর্থ ছিল আমার নিজস্ব সত্তাকে আবিষ্কার করার ইচ্ছা। আমি এই ইচ্ছাকে রূপ দেয়ার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে যে সক্ষম হয়েছিলাম, এখানেই আমার গর্ব এবং অহঙ্কার। (পৃ. ৭)
কিন্তু কিভাবে কার্যকর করলেন তাঁর অভিপ্রায়? শুধু কথা আর কথা দিয়ে। কিন্তু সে দিন সে কথার শব্দসম্ভার, উচ্চারণÑ সব ছিল অনুপম, প্রায় তুলনারহিত। তিনি নিজেই বলেছেন :
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে আমি অনবরত কথা বলেছি, বক্তৃতা করেছি। শব্দই ছিল আমার অস্ত্র। এ অস্ত্রের তুলনা হয় না। চিত্তের সব ইচ্ছা ও বিশ্বাসের সারাৎসার শব্দে সমর্পণ করে আমি আমার দেশের স্বাধীনতাকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলাম। (ঐ)
বাংলা নববর্ষের দিনে দেশত্যাগ করে তআকে সপরিবারে যেতে হয়েছে আগরতলায়। দেশী-বিদেশী বহু ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে কর্মব্যস্ত দিন অতিবাহিত হলেও আমন্ত্রিত অতিথিরূপে তিনি সেখানে বক্তৃতা করেছিলেন দু’টি কি তিনটি অনুষ্ঠানে। সেগুলো প্রশংসিতও হয়েছিল, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হতো ভয়ানক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। তবে অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি লিখলেন, ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ’ কবিতাটি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রথম ভাবগম্ভীর অনবদ্য রচনা। আমরা ক’জন পারিবারিক সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বরে কবিতাটি শুনলাম। কবিতাপাঠের পর তাঁকে প্রথম সংগ্রাম বিজয়ী যোদ্ধার মতো উৎফুল্ল দেখা গেল।
এরপর এলো কলকাতা পর্ব। দ্বিতীয় দিনে তিনি আশ্রয় লাভ করলেন ব্যারিস্টার সালামের অ্যাপার্টমেন্টে। একটি নাতিবৃহৎ কক্ষে পাশাপাশি চারটি বিছানা ব্যারিস্টার মওদুদ, সাদেক খান, সুবিদ আলী (এমপিএ) ও তাঁর। সমাদর সত্ত্বেও তাঁর মুখ কালো। সম্ভবত সে জন্য আমরা দু’জন যখন বাংলাদেশ মিশনে হোসেন আলী সকাশে যাচ্ছি, তখন করিডোরে দেখা হলো সহপাঠী জহির রায়হানের সঙ্গে। আমাকে একান্তে ডেকে জহির বলল : ‘দ্যাখো, স্যারের যেন কোনো অসুবিধা না হয়। প্রয়োজনে আমাকে খবর দেবে।’ এই বলে টেলিফোন নম্বরসহ একটি ঠিকানা সে আমাকে দিল। পরিবার-পরিজন আগরতলায়, ‘অর্থনৈতিক দুর্বহতা’ সার্বিক অনিশ্চয়তা নিশ্চয়ই তাঁকে ভয়ঙ্কর মানসিক চাপে রেখেছিল। এর মধ্যে দেশ পত্রিকার অফিসে সাগরময় ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, আকাশবাণী কেন্দ্রে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন, হিন্দুস্থান পার্কে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যোধপুর পার্কে অন্নদাশঙ্কর রায়, পার্ক সার্কাসে আবু সয়ীদ আইয়ুব ও জাস্টিস এস এ মাসুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁকে অনেকটা সজীব ও বাকমুখর করে তুলল। কিন্তু মনমানসিকতা যথার্থভাবে চাঙ্গা হলো বম্বে থেকে এ বি শাহ এলে। শাহ এসেছিলেন প্যারিস থেকে আন্তর্জাতিক পিইএন প্রেসিডেন্ট প্রখ্যাত ফরাসি কবি পিয়ের এমানুয়েল, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের শেফার্ড প্রমুখের নির্দেশে।
কলকাতায় অনেকেই আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আমাদের জন্য একটা কিছু হচ্ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি। অর্থাৎ অনেকের জন্যই হয়নি। অর্থনৈতিক সাহায্যের বহু আশ্বাস পাওয়া গেলেও উপযুক্ত সাহায্য কখনো আসেনি। কেউ কেউ ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিকল্প ব্যবস্থাধীনে কিছুটা সুবিধা হয়তো পেয়েছে। তবে সৈয়দ আলী আহসানের ব্যক্তিগত প্রয়াসটি সমষ্টিগতভাবে খুবই ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে তাঁর ও আমার বিশ্বাস।
‘যখন সময় এল’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়নি অনেক ঘটনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো রবীন্দ্রসদনে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের সম্মিলিত বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির বিশেষ অনুষ্ঠানে সৈয়দ আলী আহসানের প্রধান অতিথি হওয়া। আমি আসন অলঙ্কৃত করা লিখছি না, কারণ মঞ্চে কোনো আসনই ছিল না। আমরা একসঙ্গে গিয়ে প্রথম সারিতে বসেছিলাম। পাশেই ছিলেন শওকত ওসমান, জহির রায়হান, ড. রমা চট্টোপাধ্যায়সহ চেনা-অচেনা অনেকে। সম্ভবত সেটি একটি বিচিত্রানুষ্ঠান ছিল আয়োজক ও মোটা টাকা চাঁদা দানকারীদের জন্য। অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন চিত্রনায়িকা কবরী ও অভিনেতা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। একপর্যায়ে সৈয়দ আলী আহসান সাহেবকে ডেকে নিয়ে অন্ধকার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করতে দেখা গেল। প্রথম দিকে মনে হলো ওপার বাংলার লোক-চেহারা, পোশাক প্রভৃতিতে অপরিচিত এই ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কী শুনবে এই মানসিকতা নিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু তিন-চার মিনিটের মধ্যে বিশাল সভাগৃহ সচকিত হয়ে গেল : এ কী অনন্য কণ্ঠস্বর! এ কী সুললিত ভাষণ, অশ্রুতপূর্ব বক্তব্য! বহুক্ষণ একেবারে পিনপতন নিস্তব্ধতা। তার পর কিছু বয়স্ক লোকের বিশেষ করে মহিলার ধ্রুপদী সঙ্গীতের সঙ্গে উচ্চারিত প্রশংসাসূচক ‘আহ’, ‘উহু’ ধ্বনি শোনা গেল। আধঘণ্টার মতো বক্তৃতা শেষে সে কী করতালি!
কথা না বাড়িয়ে এখানে বলা যেতে পারে যে, তাঁর বা অন্য কারোর এত সুন্দর বক্তৃতা আমি নিজেই কখনো শুনেছি কি না সন্দেহ। যা হোক, পরদিন দেখলাম তিনি অসম্ভব আনন্দিত, তৃপ্ত ও প্রত্যয়দীপ্ত। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি, যদিও সমস্যা ছিল অফুরান, কিন্তু আমার অন্তত মনে হলো যে, তিনি যেন কলকাতা জয় করলেন।
বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়


আরো সংবাদ



premium cement