২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা

বঙ্গবন্ধুর মানসসংস্কৃতি

-

একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও মানস চেনা যায় নানাভাবে। তবে ব্যক্তির সম্পূর্ণ মানসসংস্কৃতি জানা যায় সে ব্যক্তির কাজকর্ম, লেখালেখি ও বক্তৃতার ভেতর দিয়ে। অর্থাৎ লেখালেখি, বক্তৃতা ও কাজকর্মের মাধ্যমে ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটতে পারে; গড়ে উঠতে পারে তার শত্রু-মিত্রও। সেজন্য কোনো মানুষকে বা মানুষের মনকে চেনার জন্য অনুসন্ধান করতে হয় সেই মানুষের কাজকর্ম, জনসম্মুখে দেয়া বক্তৃতা ও লেখে রাখা বইপুস্তকের। বঙ্গবন্ধুকে এই তিন উপায়েই চেনা যায়। যেমন বাংলাদেশকে ঘিরে সুপরিসরে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রয়েছে ৭ মার্চের বক্তৃতার মতো বিশ্বখ্যাত কাব্যিক বক্তৃতা এবং রয়েছে তাঁর লেখা ‘কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, নয়াচীন ভ্রমণ, নামে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো। সব মিলে আলোচনা করলে বঙ্গবন্ধুর মানসসংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যাবে সহজে। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিকসত্তার পরিচয় পেয়েছিল ১৯৩৭ সাল থেকেই কিন্তু বঙ্গবন্ধুর লেখকসত্তার সাথে পরিচিত হতে পেরেছে ‘কারাগারের রোজনামচা, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, নয়াচীন ভ্রমণ, নামে গ্রন্থগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। এই গ্রন্থগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিল হিসেবেও পরিচিতি পেতে শুরু করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মানবমুক্তির অমীয়তাৎপর্য বিরাজ করে রাজনীতির মধ্যে। সে রাজনীতি একজাতি হোক আর আন্তর্জাতিক হোক। কিন্তু রাজনীতি সে কথা মাঝে মধ্যে ভুলে যায় কিছু কিছু রাজনীতিকের কারণে। তখন প্রয়োজন পড়ে এমন কোনো রাজনীতিকের যে তার মানবীয় গুণ দিয়ে মানবমুক্তিকে রাজনীতি থেকে রাজনীতি দিয়েই টেনে বের করে আনতে পারে। রাজনীতির উদ্দেশ্যও থাকে সে লক্ষে পৌঁছে ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করা। অথচ রাজনীতি এই লড়াইয়ে হেরে যেতে চায় বারবার। এর অন্যতম কারণ হলো রাজনীতিকরা এই লড়াইটা যখন চালিয়ে নিতে চায় তখন সেটা আপামর না হয়ে শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে শুধুমাত্র নিজের পরিবারের ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। সে কারণেই হয়তো রাজনীতিতে এত সংঘর্ষ চোখে পড়ে। সাংঘর্ষিক এই রাজনীতির অরাজকতায় মানুষের প্রতি মানুষের যে জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন এবং মানুষে মানুষে যে অবিশ্বাস; প্রজাদের ওপর রাষ্ট্রের যে শোসন ও সন্ত্রাস তা উৎখাত করতে চাইলেও রাজনীতির আশ্রয়েই তা করতে হয়। মানবমুক্তির এই মূলমন্ত্র আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু কিশোর বয়স থেকেই। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য থেকে দেশের মানুষকে মুক্তি দিতে বড় বড় শহরে গিয়ে রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকতে হয় না। এই মহৎ কাজটি টুঙ্গিপাড়ার মতো নিভৃত পল্লীগ্রাম থেকেও শুরু করা যেতে পারে। শহরে থেকে রাজনীতি করতে পারলে হয়তো রাতারাতি মন্ত্রী হতে পারা যায় কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য সত্যিকারের রাজনীতি করতে গেলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই সেটা করা যায়। বঙ্গবন্ধু তা কিশোর বয়সেই বুঝেছিলেন। দেখা গেছে মানবমুক্তি, ভাত ও ভোটের রাজনীতি করতে পারলে মন্ত্রীর দায়িত্ব সয়ংক্রিয়ভাবেই নিজের কাঁধেই এসে যায়; বঙ্গবন্ধুই তার দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিত্বের পেছনে ছোটেননি, তিনি ছুটে ছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার সংরক্ষণ করার পেছনে। বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে গোপালগঞ্জে। সেখানে দাদা-চাচাদের মুখে জামিদার ও নীলকরদের অত্যাচারের গল্প শুনে তিনি শঙ্কিত হতেন। এসব গল্পের সারবস্তু ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ ও ভূস্বামী গোষ্ঠীর করা যাবতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে সোচ্চার হতে শিখিয়েছে। এই শিক্ষা বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতি অনুরাগী করে তুলেছে। সেজন্যে যৌবনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশবিরোধী সব আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। লক্ষ করা গেছে, বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই সংগঠন প্রিয় ছিলেন। দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ নামে তিনি একটি সংগঠনে সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লেখেনÑ ‘মাস্টার সাহেব গোপালগঞ্জে একটা ‘মুসলিম সেবা সমিতি’ গঠন করেন, যার দ্বারা গরিব ছেলেমেয়েদের সাহায্য করতেন। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠাতেন সব মুসলমান বাড়ি থেকে। প্রত্যেক রোবরার আমরা থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে চাল উঠিয়ে আনতাম এবং চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার ও অন্যান্য খরচ দিতেন।’ পরার্থে থলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরার মানসিকতা সবার থাকে না। বঙ্গবন্ধুর ছিল। এই মানবচেতনা এখন সমাজে চোখে পড়বে না। যদিও পড়ে সেটি পরার্থে না হয়ে নিজার্থেই হয়ে ওঠে বেশি। সেজন্য কলাগাছ, কচুরিপানা ও বালিশকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু গোপালগঞ্জের মিশন স্কুলের ছাত্র ছিলেন। সেখানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সংবর্ধনা দেয়ার পর থেকে বঙ্গবন্ধু জাতীয় রাজনীতিকদের নজরে আসেন। ১৯৩৮ সাল। শেরে বাংলা তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এবং সোহরাওয়ার্দী শ্রমমন্ত্রী। তাঁরা দুজনেই গোপালগঞ্জে আসবেন। বিরাট আয়োজন করা হয়েছে। এক্সিবিশন হবে। দুই নেতা একসাথে গোপালগঞ্জে আসবেন; মুসলমানদের মধ্যে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হলো। বঙ্গবন্ধু তখন মিশন স্কুলের সিনিয়র ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ওপর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করার ভার পড়ল। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হলো। শেরে বাংলা মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন, এই অজুহাতে হিন্দু ছাত্ররা কংগ্রেসের নির্দেশে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে সটকে পড়ল এবং আয়োজন ভণ্ডুল করার ষড়যন্ত্র হলো। শেষপর্যন্ত হক সাহেব ও শহীদ সাহেব এলেন এবং সভা হলো। এক্সিবিশন উদ্বোধন হলো। হক সাহেব পাবলিক স্কুল দেখতে গেলেন আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব গেলেন মিশন স্কুল পরিদর্শনে। বঙ্গবন্ধু মিশন স্কুলে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সংবর্ধনা দিলেন। এখানেই বঙ্গবন্ধুর সাথে সোহরাওয়ার্দীর পরিচয় ঘটে। সোহরাওয়ার্দী সাহেব জানতে পারেন, গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের কোনো কমিটি নেই। মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করা হলে খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব হলেন সভাপতি আর বঙ্গবন্ধু হলেন সাধারণ সম্পাদক। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি একটা গঠন করা হলো। বঙ্গবন্ধু সেটিরও সেক্রেটারি হলেন। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বলেছেন ‘আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি। বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ আজাদ যা লেখে তাই সত্য বলে মনে হয় (অআপৃ.১৫)’। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৪০ সালে বঙ্গবন্ধু ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন’ এবং অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগে’র কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এই সময়েই তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের মহকুমা শাখার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করতে পারলেন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের শিকার হতে চলেছে। পূর্বপাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্যের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালের শুরুতে মুসলিম লীগ থেকে বের হয়ে যান এবং ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। এরপর তিনি পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন এবং ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনীতিই হয়ে ওঠল বঙ্গবন্ধুর ধ্যান-জ্ঞান, আরাধ্য। সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৫৫ বছর রাজনৈতিক জীবনের আট বছর চার মাস জেল খেটেছেন। নিজের স্বার্থে এই জুলুম সহ্য করা অসম্ভব। এটি সম্ভব হতে পারে তখনই যখন নিজেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সঁপে দেয়া যায়। বঙ্গবন্ধু নিজেকে সঁপে ছিলেন গণমানুষের ভিড়ে। গণমানুষের স্বপ্নই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সেজন্য সর্বস্তরের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান থেকে ১৯৬৯ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন।
বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে যেমন চেনা যায় তেমনি তার বক্তৃতাতেও তিনি পরিষ্কার হয়ে ওঠেন সবার কাছে। মানুষের ব্যক্তিত্ব মানুষের বক্তব্য। বা ব্যক্তিত্বই বক্তব্য । একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার বক্তব্যে। বক্তব্য যেমন ব্যক্তিত্বও তেমন। ব্যক্তিত্ব সুন্দর মানুষের বক্তব্যও মূল্যবান হয়। অসার বক্তব্য বক্তাকে গুরুত্বহীন করে। সে জন্য চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে হয়। অনেকেই গুরু-গম্ভীর, রাশভারী, কমকথা বলা ব্যক্তিকে ব্যক্তিত্ববান মানুষ মনে করে। গম্ভীর, রাশভারী, কম কথা বলা ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য নয়। গম্ভীর, রাশভারী, কম কথা বলা ব্যক্তি যদি কথায় কথায় মিথ্যা বলে; ওজনে কম দেয়; কথা দিয়ে কথা না রাখে; পক্ষপাতিত্ব করে তাহলে তাকে ব্যক্তিত্ববান বলা যায় না। ব্যক্তিত্বের সাথে সুচেতনাগুলো জড়িত। কেননা বক্তব্যের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে মানুষের ব্যক্তিত্ব; মনুষ্যত্ব। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে সঠিকভাবে চিনতে হলে তার বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করতে হয়। বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে বক্তার অন্তর্নিহিত দর্শন, মনোভাব, চিন্তা-চেতনা। বক্তা নিজের, পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ যেভাবে দেখতে চায় সেটা সে প্রকাশ করে বক্তৃতার মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুকেও চেনা যায় তাঁর বক্তৃতায়। তাঁর বলিষ্ঠ উচ্চারণ ছিল রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে। কাব্যিক ভঙ্গিমায় তিনি মানুষের মনের কথা বলেছেন, অধিকারের কথা বলেছেন ভোট ও ভাতের কথা বলেছেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি নিজেকে পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন জনগণের সামনে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। এরপর দেশ স্বাধীন হলে তিনি এ দেশের শিক্ষিত পেশাজীবী মানুষদের উদ্দেশে বললেন, আপনারা পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, পুলিশ, উকিল ছিলেন সেকথা ভুলে যান। আপনাদের আচরণ বদলাতে হবে। জনগণকে আর দাস ভাববেন না। আপনারা জনগণের খাদেম এই কথা চিন্তা করে কাজ করবেন। জনগণকে হয়রানি করবেন না। তিনি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, শিক্ষক, বিচারক অফিসারদের লক্ষ করে বলেন, আপনাদের লেখাপড়া শিখাইছে কেডা? এ দেশের জনগণের টাকায় আপনারা লেখাপড়া শিখেছেন। চাকরি করছেন এই জন্য নয়, যে আপনারা শুধু নিজেদের স্ত্রী ছেলেমেয়েদের দেখবেন। এ দেশের জনগণকেও দেখার দায়িত্ব আপনাদের রয়েছে, একথা ভুলে যাবেন না। তিনি অন্য একটা ভাষণে বলেছেন, এ দেশের বড়লোকদের, ভুঁড়িওয়ালাদের আর ভুঁড়ি বাড়াতে দেয়া যাবে না। বড়লোকদের তার সম্পদের পাহাড় বানাতে দেয়া হবে না আবার কাউকে অভুক্তও রাখা হবে না। যারা সরকারি জায়গা দখল করে নিজেদের চার/পাঁচটা করে বাংলো বানিয়েছে তাদের জমি কেড়ে নিয়ে ভূমিহীনদের দিয়ে দেয়া হবে। যারা বাস্তুভিটা হারিয়েছে তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে মানবদরদি ছিলেন, তাঁর মন যে মানুষের দুঃখে কষ্টে কাঁদত বক্তৃতার এই কথাগুলোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই মানবচেতনাকে স্পষ্ট করে বোঝা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর চেতনায় ছিল জনগণ আর এখনকার নেতাদের চেতনায় থাকে ক্ষমতা বা চেয়ারের বন্ধন। বঙ্গবন্ধু বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েও দায়িত্ব নিতে পারেনি তারপরও কখনোই বলেন নি যে, কে ভোট দিলো না দিলো সেটি দেখার অবকাশ তার নেই। বঙ্গবন্ধুর সেই দেশেরই নেতারা এখন কে ভোট দিলো কে দিলো না তার খবর রাখতে চান না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে চেনানোর অন্যতম একটি উপায় হচ্ছে তার লেখালেখি। ইতোমধ্যে তার লেখা কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। একটি মানুষের হাজারও অভিজ্ঞতায় তৈরি হয় একটি বই। একটি বই মানে একটি জগত, নানান বিষয় আর অফুরন্ত জিজ্ঞাসা। একটি বই জ্ঞানের আধার, অভিজ্ঞতার সংকলন। একটি বই বিচিত্র বিষয় আর তার সীমা-পরিসীমা। অর্থাৎ অসীমকে একটি পরিসীমার মধ্যে ধরে ফেলার চেষ্টার নামও বই। সেজন্যে বইয়ের বিচিত্র বিষয়। বিজ্ঞানের বই, রাজনীতির বই, ইতিহাসের বই, দর্শনের বই, সাহিত্যের বই। সব বই থেকে সাহিত্যের বই একটুু আলাদা। অন্যান্য বইয়ে সাহিত্য দেখা যায় না কিন্তু সাহিত্যের বইয়ের পাতা ভরে থাকে সাহিত্য; সেইসাথে বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি সবই সাহিত্য বইয়ে মিলে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ সেরকমই একটি সাহিত্য বই বলে মনে হতে পারে, যে বইয়ের মধ্যে রাজনীতি আছে, সমাজবাস্তবতা আছে, আতœজিজ্ঞাসা আছে, আত্মোপলব্ধি আছে, শোষণ, জুলুম নির্যাতনের চিত্র আছে, চোর-ছ্যেচ্চোর, পুলিশ-দারোগারও চরিত্র রয়েছে এবং এ বিষয়গুলো সাহিত্যরসের সাথে পরিবেশিত হয়েছে। এ বইটি থেকে পূর্বপাকিস্তানের সমাজ, রাজনীতি, পুলিশ- দারোগা, চোর-ডাকাত ও সাধারণ মানুষের বঞ্চনা ও হতাশার চরিত্র অবলোকন করা সহজ হতে পারে।
বিচিত্র এক অভিজ্ঞতার সম্ভার ‘কারাগারের রোজনামচা’। (রোজনামচা’ অর্থ হচ্ছে যেখানে প্রতিদিনের বিবরণ লেখা হয় বা থাকে। অর্থাৎ ‘দিনলিপি’।) বইটির রচয়িতা শেখ মুজিবুর রহমান। এ বইটি বাংলা একাডেমি, ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে। বইটির প্রচ্ছদ ও গ্রন্থনকশা করেছেন তারিক সুজাত। এই বইটির বিশেষত্ব হলো এটি বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগার জীবনে বসে লেখা ডায়রির পাতা।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্তু জেলখানার ভেতরে সচক্ষে দেখা ঘটনাবলি, স্বজ্ঞানে উপলব্ধি করা জীবন জিজ্ঞাসা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েদিদের সাথে বিনিময় করা অভিজ্ঞতার ঝুলি বইটির উপজীব্য বিষয় হলেও এ বইতে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ গঠনসহ নানা বিষয়ের প্রতিচ্ছায়া। তবে এ বইটির প্রধান আবেদন হিসেবে মনে হতে পারে জেলখানার ভেতরে অবস্থান করা কয়েদিদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনাচরণ এবং জেলখানার বাইরে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক ঘটনার উত্তেজনা ।
শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ছাত্রজীবন থেকে একজন রাজনীতিক। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ মার্চ তিনি টুঙ্গিপাড়াতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম শেখ লুৎফর রহমান। মাতা সায়েরা খাতুন। শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল রাজনীতি নির্ভর সংগ্রামী জীবন। তিনি সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে শাসকগোষ্ঠী তাকে পছন্দ করতে না পেরে বারবার জেলে পুরেছেন। সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে যে জেলজুলুম সেই সাধারণ মানুষকে তিনি পেয়েছিলেন জেলখানার ভেতরে। সে জন্য তিনি জেলখানায় বসে কয়েদিদের সাথে মন খুলে কথা বলেছেন, গল্প করেছেন, ভালো-মন্দ নিয়ে মতামত আদান-প্রদান করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ করেছেন ‘জেলের ভেতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে’ অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন সেল রয়েছে। কয়েদিদের ধরন অনুযায়ী সেসব জেল বা এক এক সেলে এক এক কয়েদিদের রাখা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাজবন্দী। সে কারণে তার অবস্থান ছিল ডিভিশন সেলে। আলাদা সেলে অবস্থান হওয়ার পরও তিনি সাধারণ কয়েদিদের সাথে সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করতে চেষ্টা করেছেন। কয়েদিদের মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে তিনি দেখেছেন যে, কতখানি দোষে আর কতখানি বিনা দোষে তারা জেলের ঘানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। খুব কাছ থেকে খুব নিবিড়ভাবে তিনি জেলখানার প্রতিটি কোণায় কোণায় চোখ রেখেছেন; প্রতিটি নিয়ম, সেই নিয়মের প্রতি কার কী অনুভূতি, কী অপরাধ, কী শাস্তি, কী বিচার প্রভৃতি তিনি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভবিষ্যতের একজন রাষ্ট্রনায়ক কয়েদিদের সাথে অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেছেন, এটি সাধারণ বিষয় নয়। সমাজকে, সমাজের মানুষকে, অপরাধকে ,অপরাধীকে, খুনিকে, ধর্ষককে, চোরকে, ডাকাতকে একেবারে শিওরের কাছ থেকে দেখার ভাগ্য ক’জন রাষ্ট্রনায়কের হয়ে থাকে? শেখ মুজিবুর রহমানের সে অভিজ্ঞতা দীর্ঘ জেলজীবনে হয়েছিল। এসব অভিজ্ঞার সমন্বিত রূপই হচ্ছে ‘কারাগারের রোজনামচা’; যা জেলখানার দর্পণ। ১৯৫০ সালের কথা। ‘কারাগারে রোজনামচা’র একটি স্মরণীয় ঘটনা। জেলখানায় শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবের সাথে এক কয়েদির পরিচয় হয়; নাম তার লুদু ওরফে লুৎফর রহমান। ঢাকা শহরের লুৎফর রহমান লেনে তার বাড়ি। ৫৪ সালে লুদুকে জেলে দেখে যান শেখ মুজিবুর রহমান। ৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হলে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে জেলে এসে দেখেন লুদু তখনো জেলে আছেন। লুদু ছিলেন বি ক্লাস কয়েদি। দীর্ঘ দিন জেলখাটার ফলে সে জেলের আইনকানুন, নিয়মনীতি অন্যান্য কয়েদির থেকে বেশি জানত এবং সেটা নিয়ে সে নিজেকে জাহির করত। একদিন শেখ মুজিবুর রহমান বই পড়ছিলেন, হঠাৎ তার কানে ভেসে এলা ‘লুদু ভাল হও, আর চুরি করো না’; মাথা ঘুরিয়ে শেখ সাহেব দেখেন, দু’জন কয়েদি পরস্পর কথা বলছেন। তাদের মধ্যে লুদু একজন। অন্য একদিন লুদুকে ডেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব বললেন, ‘লুদু তোমার জীবনের ঘটনাবলি আমাকে বলবা’ লুদু বলল, হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুঃখের জীবন। প্রায় ২০ বছর আমার জেলখানাতে চলছে। ১৩ বছর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি, কেন যে করেছিলাম আজো জানি না। জীবনটা দুঃখেই গেল। চোর পকেটমারদের জীবনে শান্তি হয় না। বলতে বলতে লুদু চোখের পানি ফেলেছিল। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘লুদু বলতে লাগলেন আর আমি ঘটনাগুলো লিখতে শুরু করলাম। একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছিÑ এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা ও অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর ডাকাত পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর ডাকাত করে সৃষ্টি করেন না। জন্মগ্রহণের সময় সব মানুষের দিল একভাবেই গড়া থাকে। বড় লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে।’ শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এক একটি ব্যবস্থা মানুষকে গরিব-ধনী বানায়। চোর-ডাকাত বানায়। লুদু চোরের জীবন কাহিনী লম্বা। বারবার চুরি করেছেন, অনেকবার ধরা পড়েছেন। সবশেষ কোথায় চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন সেটা জানা যায় না। তবে ১৯৫৩ সালে লুদু চোর আবার গ্রেফতার হয়। ‘এই বার ওর ৯ বৎসর জেল হয়, তিনটা মামলা মিলে। ঠিকমতো জেল খাটলে ছয় বছর পরেই সে বের হতে পারত কিন্তু তার স্বভাব মোটেই পরিবর্তন হয় নাই।’
লুদু চোরের দীর্ঘ সময় চুরি করার পেছনে সাহস জুগিয়েছে পুলিশ। প্রথমবার ৯ মাস জেল খেটে লুদুর দারুণ অভিজ্ঞতা হলো, সে ভাবল জেল তো কিছুই না। এখানে আসলে আরামই পাওয়া যায়। ৯ মাস জেল খেটে যখন সে বের হলো তখন তাকে এক বছর নজরে রাখার জন্য পুলিশের ওপর হুকুম হলো। প্রতি রাত ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্তু পুলিশ তাকে ডেকে দেখত যে, সে ঘরে আছে কি না। পুলিশ রাতে তাকে পাহারা দিলো আর লুদু দিনের বেলায় পকেট কাটতে শুরু করল। একদিন পুলিশ লুদুকে থানায় ডেকে নিয়ে বলল, তুই কী করিস সব খবরই রাখি। এবার ধরতে পারলে তিন বছরের জেল হবে সাথে বেতের বাড়িও থাকবে; বলে পুলিশ হুমকি দিয়ে বলল, তুই কেন আমার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করিস না’ দারোগা সাহেবের এ কথায় লুদু বুঝতে পারল পুলিশকে টাকা-পয়সা দিতে পারলে পকেট কাটায় সমস্যা থাকবে না। একদিন পকেট কেটে বেশ কিছু টাকা জমিয়ে লুদু ভাবল, যাই দেখি দারোগা সাহেব কী করেন; লুদু বাজার থেকে বড় একটা মাছ, কিছু পটোল, কিছু আলু আর দশটা টাকা হাতে নিয়ে দারোগা সাহেবের বাসায় দেখা করতে গেলেন। দেখলেন দারোগা সাহেব বেজাই খুশি হয়েছেন, টাকা দশটা পকেটে রেখে দিতে দিতে বললেন, বোধহয় ভালো দান মেরেছ? তা মাত্র দশ টাকা কেন? দরদাম ঠিক করে দারোগা বললেন, হাবিলদার আর সিপাহিদের দেয়ার জন্য সপ্তাহে আরো দশ টাকা দিবি, কাজ চালাইয়া যা, তোকে আর রাতে ডাকা হবে না। সিপাহি ও হাবিলদারকেও বলে দেয়া হলো লুদুকে যেন আর রাতে ডাকাডাকি করে বিরক্ত না করা হয়। বেশ কিছু দিন লুদু রাতে চুরি ও দিনে পকেট মারার কাজ চালাতে লাগল। এর মধ্যে লুদু একদিন পকেট মারতে গেল রেলওয়ে স্টেশনে। রেলওয়ে যে জিআরপি পুলিশের আন্ডারে আর এদেরও যে হাত করতে হয় লুদুর সেটা জানা ছিল না। পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে জিআরপি পুলিশের হাতে গেল লুদু। একজন জিআরপি রেগে গিয়ে বলল, বেটা নতুন বুঝি, খোঁজখবর রাখে না। ঝুটঝামেলা মিটিয়ে লুদু জিআরপিদেরকেও হাত করে নিল। এরপর বছর দুই চলল পকেট কাটা আর রাতে চুরি করা। এর পর লুদু বাসে পকেট মারতে গিয়ে একজনের পকেটে কেবল হাত দিবে সেই সময় দেখে অন্য একজন লোক একটু দূরে দাঁড়িয়ে লুদুর দিকে তাকিয়ে আছে। লুদু হাত সরিয়ে নিতে চাইলে লোকটি ইশারায় ইঙ্গিত করল পকেট মারতে কোনো সমস্যা নেই। কাজ সমাপ্ত করো। কাজ সেরে যখন লুদু বাস থেকে নামল তখন সেই লোকটিও দু’জন লোককে সাথে করে নেমে পড়ল এবং লুদুকে ঘিরে ধরে বলল তারা সিআইডি, লুদু তাদেরকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে টাকা ভাগাভাগি করলেন আর কথা ঠিক হলো এভাবে বাসে গাড়িতে পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়লে লুদুকে সিআইডি ছেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবে। এভাবে পুলিশ, থানা, দারোগা, জিআরপি, সিআইডি সবাইকে হাত করে বেপরোয়াভাবে চুরি ও পকেট মারার কাজ করতে লাগল লুদু চোর। শেষ চুরিতে লুদুর রক্ষা হলো না। কেননা সে সূত্রাপুর থানাটা হাত করতে পারেনি। লুদু জেলহাজতেও টাকা পয়সা দিয়ে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। লুদু চোরের জীবন ইতিহাস তুলে এনে শেখ মুজিবুর রহমান বোঝানোর চেষ্টা করেছেন কতটা দুর্নীতিপরায়ণ ছিল সে সময়ের পুলিশ প্রশাসন, জেলার ও রাজনীতি। স্বল্প পরিসরে ‘কারাগারের রোজনামচা’র সমাজ বাস্তবতা তুলে আনা কষ্টকর। তবে লুদু চোরকে বিশ্লেষণ করলেও ‘কারাগারের রোজনামচা’র আত্মজিজ্ঞাসা পরিষ্কার রূপে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে বের হয়েছেন, তার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু পুলিশের সেই চরিত্র আজো বদলে যেতে পারেনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement