১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৩২ নম্বর বাড়ির পথে

-

১৪ আগস্ট, ১৯৭৫।
ব্রিটিশ সাংবাদিক জর্জ মরিসন দ্রুতপদে বিমানে উঠে পড়েন। যাবেন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের পাকবাহিনীর নৃশংসতার কথা তিনি রেডিওতে শুনেছেন। যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্যও দেখেছেন টিভিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েই দেশটিতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তার কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন জটিলতার কারণে ওই সময়ে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সদ্য এ স্বাধীন দেশের প্রধান নেতা এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথাও তিনি শুনেছেন অনেক। তার সুদৃঢ় নেতৃত্ব, অসাধারণ বাগ্মিতা ও বিচক্ষণতার কথা শুনে তাঁকে দেখার সাধ জাগে মরিসনের। সিদ্ধান্ত নেনÑ শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেবেন তিনি। আর এ উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশে যাত্রা।
জর্জ মরিসন যখন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেন, তখন রাত ৯টা বাজে। বিমানবন্দর থেকে এসে তিনি ধানমন্ডির একটি হোটেলে উঠে পড়েন। ডিনার সেরে রুমে এসে চেয়ার-টেবিলে বসেন। সাজাতে থাকেন সাক্ষাৎকারের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন। সকালেই তিনি ৩২ নম্বর বাড়ির পথে যাত্রা করবেন।
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মরিসনের ঘুম ভেঙে যায়। চার দিক থেকে কানে আসতে থাকে আজানের ধ্বনি। একের পর এক আজানের ধ্বনি শুনে তিনি বিস্মিত হন, হন কিছুটা অভিভূত। এমন ধ্বনি তো তার দেশে কখনো শোনেননি। শুনলেও কদাচিৎ; যা তার হৃদয়ে দাগ কাটেনি কখনো। মরিসন শুনেছেন বাঙালি মুসলিমরা খুব ধর্মপ্রাণ। মানুষ হিসেবেও এরা সহজ-সরল, মহৎ। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় মুহুর্মুহ গুলির শব্দ কানে আসে তার। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলছে আশপাশে কোথাও।
মরিসন দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়েন। দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকেন ওপরে। আস্তে আস্তে ছাদে চলে যান তিনি। গুলির দু-একটা শব্দ এখনো কানে আসছে। মরিসন বোঝার চেষ্টা করেন কোথা থেকে শব্দগুলো আসছে। কিন্তু তিনি ছাদ থেকে কিছুই দেখতে পান না। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্ত হয়ে আসে চার পাশ। একবারে নীরব-নিস্তব্ধ। ইতোমধ্যে পুবাকাশে ভোরের সূর্য দেখা দিয়েছে। কিন্তু পথে কোনো লোকজন চোখে পড়ছে না। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রুমে চলে আসেন মরিসন।
জর্জ মরিসন নাশতা সেরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বের হন ৩২ নম্বর বাড়ির পথে। কী আশ্চর্য! রাস্তা একদম ফাঁকা। হরতাল নাকি? বড় কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। কয়েক মিনিট অপেক্ষার পর একটি রিকশার দেখা পান। ওতে উঠে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিকশা ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। রিকশাওয়ালা মরিসনকে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত ওখান থেকে চলে যায়।
জর্জ মরিসন বাড়ির ভেতরে ঢুকবেন, কিন্তু ভেতর থেকে গেট বন্ধ। গেটে কোনো দারোয়ান নেই। গেটের সামনে সেনাবাহিনীর অনেকগুলো ট্যাংক। বাড়ির ভেতর সেনাবাহিনীর দু’জন সিপাইকে টহল দিতে দেখা যাচ্ছে। মরিসনকে দেখেই একজন এগিয়ে আসে। মরিসনের মনে সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে; সেই সাথে কৌতূহলও জেগে ওঠে। নিশ্চয়ই কোনো অঘটন ঘটেছে। এগিয়ে আসা সিপাইকে পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকার কথা বলে মরিসন। কিন্তু সে অপারগতা প্রকাশ করে। এমন সময় অন্য সিপাইও মরিসনের কাছে এসে দাঁড়ায়। মরিসন দু’জনকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা খুলে বলেন। পরে আসা সিপাইটি হঠাৎ বলে ফেলে, ‘উনি তো একটু আগে নিহত হয়েছেন।’ এটুকু বলেই সিপাইটি ওখান থেকে দ্রুত কেটে পড়ে। মরিসনকে চলে যেতে অনুরোধ করে অপর সিপাইটি। এমন সময় সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি এসে গেটের সামনে দাঁড়ায়। সিপাই সেলুট দিয়ে বড় গেটটি খুলে দেয়। গাড়িটি ভেতরে ঢুকে পড়ে। গাড়ির ভেতরে উচ্চপদস্থ কয়েকজন সেনাকর্মকর্তাকে দেখা যায়।
জর্জ মরিসন বিষণœ মনে হোটেলের দিকে ফিরতে থাকেন। তিনি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারেন না। কী অদ্ভুত এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য! তিনি আগেই শুনেছিলেনÑ বাঙালিরা ধর্মপ্রাণ, সহজ-সরল। ভোরের আজানের ধ্বনির শব্দে এর প্রমাণও পেয়েছেন। কিন্তু এখানে এসে তার সে ধারণা পাল্টে গেল। এদের মতো বেইমান-বিশ^াসঘাতকও আছেÑ যারা নিজ দেশের জাতীয় নেতাকেও হত্যা করতে পারে! হ


আরো সংবাদ



premium cement