১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিল্প-সৌন্দর্যের আনন্দ

-

আমরা যে শিল্প সমালোচনার কথা বলি কিংবা শিল্পের ভালোমন্দ বিচারের কথা বলি সেই সমালোচনা এবং বিচার কার্যের ফলে অনেক দর্শক সমালোচক এবং বিচারকের গভীর অন্তর্দৃষ্টির বিবেচনা কিংবা অন্তর্দৃষ্টির আলোকে দেখতে ও বুঝতে চেষ্টা করেন। রহস্য উদঘাটনে সচেষ্ট হন শিল্পসৌন্দর্যের। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ও বুঝতে চেষ্টা করেন শিল্পের অন্তর্ভুক্ত বিষয়াবলিকে। বিষয়াবলির উপস্থাপন কৌশলকে। অথচ সমালোচক ও বিচারকের সিদ্ধান্ত দেয়ার আগে অসংখ্য দর্শক একই শিল্পের সামনে দিয়ে বহুবার হেঁটে যাওয়া সত্ত্বেও গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। যারা দেখেননি তারাই গুরুত্বসহকারে দেখতে শুরু করেন যখন বিচারক ও সমালোচক শিল্পকর্মের বিষয়ের গুরুত্ব দেখান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘর বা শিল্প সংগ্রহশালার বিষয় বিবেচনা করলেও একই কথা বলা যায়। সেসব জাদুঘর বা শিল্প সংগ্রহশালায় রক্ষিত শিল্পের সামনে দিয়ে মিছিলের মতো দর্শক হেঁটে যান। কেউ গুরুত্ব দিয়ে কোনো শিল্পকর্ম দেখেন না বা শিল্পের সৌন্দর্য বিষয়ে ভাবেন না। বিশ্বের বিখ্যাত ‘লুভর’ মিউজিয়ামের কথা অনেকেই জানেন। এই মিউজিয়াম বা চিত্রশালায় যত শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে সেগুলো দেখতে কয়েক দিন বা কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। অনেক দর্শক এসব শিল্পকর্ম দেখেন। অগণিত দর্শক মিছিল করে শিল্পকর্মের সামনে দিয়ে চোখ বুলিয়ে হেঁটে যান। কোথাও কোনো ব্যতিক্রম তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত ‘মোনালিসা’ চিত্রের সামনে লক্ষ কর যায় ব্যতিক্রমী ঘটনা। বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি মোনালিসা নামক এ চিত্রের সামনে দেখা যায় জটলা। সবাই চান কিছুটা সময় নিয়ে মোনালিসার সৌন্দর্য উপভোগ করতে কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার পরেও যতটা পারা যায় সময় নিয়ে দেখেন। মোনালিসার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। কথা বলেন। একে অন্যের সাথে মতবিনিময় করেন। এত সব করেন কারণ সমালোচক বা বিচারকরা মোনালিসাকে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের খেতাব দিয়েছেন। দিয়েছেন বিশ্বখ্যাতি। অথচ সেই একই স্থানে আরো অসংখ্য চিত্র ঝুলছে দেয়ালে, সেগুলো সম্পর্কে কারো কেনো আগ্রহ লক্ষ করা যায় না। এরূপ ঘটনা ঘটে দর্শকদের অজ্ঞতার কারণে। কেননা এসব চিত্রশালা বা জাদুঘরে বিশ্বখ্যাত বহু শিল্পীর শিল্পকর্ম সংগৃহীত রয়েছে। কিন্তু মোনালিসার মতো ব্যাপক আলোচিত না হওয়ায় দর্শকরা ততটা অবহিত নন যতটা মোনালিসা সম্পর্কে অবহিত। এ কারণে শিল্পী রাফায়েল, বটিচেল্লি কিংবা টার্নারের মতো বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের শিল্পকর্মের সামনে দিয়ে হেঁটে যান কোনো গুরুত্ব না দিয়েই। বটিচেল্লি অঙ্কিত ভুবনমোহিনী, ‘ভিনাসের জন্ম’ নামক চিত্রের কথা অনেকেই জানেন। তবে সাধারণ দর্শক ততটা জানেন না। চিত্রের বিষয় হচ্ছে সাগর বা সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়ে ভিনাস একটি বৃহৎ ঝিনুকের ভেলায় ভেসে ভেসে সমুদ্রপাড়ের ভূমির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। শূন্যে বায়ুদেবতা পুষ্পবৃষ্টি অনুকূল ধারা প্রবাহের সাহায্যে ভিনাসকে এগিয়ে দিচ্ছেন। সমুদ্র তীরে দেবলোকের গায়িকারা সোনা-রুপার জরির নকশা করা মূল্যবান রেশমি পোশাক পরে অপেক্ষা করছে। স্বর্গীয় মুখশ্রীর অধিকারী ভিনাস তুলনাবিহীন। স্বর্গীয় মুখশ্রীর অধিকারী ভিনাসের শরীরের এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দোলায়িত ছন্দ শিল্পী বটিচেল্লির সৌন্দর্য সৃষ্টির অপূর্ব নিদর্শন। বটিচেল্লি তার এ চিত্রে ব্যবহৃত নরনারীর দেহকে অতি মনোরম আকর্ষণীয় ছন্দময়ী করার জন্য কিংবা শরীরের বিভিন্ন অংশে দোলায়িত স্বভাব আনয়নের জন্য শিল্প-স্বাধীনতা প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ তিনি ইচ্ছামতো শরীরের সুন্দর গড়ন দিয়েছেন। যেমন ভিনাসের গলা বা গ্রীবাকে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ করেছেন। ভিনাসের আলুলায়িত সোনালি বর্ণের কেশরাশির উপস্থাপন কৌশল, নিরাবরণ অথচ অবিকৃত দেহবল্লরীর গঠন সর্বত্রই শিল্পীর স্বাধীন সৌন্দর্য সৃষ্টির প্রকাশ ঘটেছে। ঘটেছে কম্পোজিশনগত তীব্র অনুভূতির ব্যঞ্জনা। এহেন অপূর্ব সুন্দর চিত্র ফ্লোরেন্সের উফিৎজির চিত্রশালায় দিনের পর দিন দর্শকরা দেখছেন এবং চলে যাচ্ছেন। কিছুটা হলেও আনন্দ লাভ করছেন, কিন্তু এই মহৎ চিত্রের গুরুত্ব ও মহত্ব বিষয়ে দর্শকদের অজ্ঞতা থেকেই যাচ্ছে। ব্যতিক্রম ঘটছে মোনালিসার ক্ষেত্রে। কারণ মোনালিসা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে এবং আলোচিত শিল্পে পরিণত হয়েছে। এই পরিচিতি পাওয়া এবং আলোচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমালোচক এবং বিচারকদের ভূমিকাই প্রধান। সমালোচক ও বিচারকদের দৃষ্টিতে মোনালিসা জীবন অনুভূতিতে সত্য ও প্রাণস্পন্দনময়ী। মোনালিসার দৃষ্টি জীবন্ত। তার দৃষ্টি ও হাসিতে বিদ্রƒপ এবং বিষাদের মিশেল বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করে। মোনালিসার হাসি রহস্যপূর্ণ। মোনালিসার প্রতিকৃতিতে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ সৃষ্টির পেছনে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অত্যধিক কল্পনা ও বিজ্ঞানমনষ্কতা কাজ করেছেন বলে তারা মনে করেছেন। মনে করেছেন শিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবে মোনালিসার প্রতিকৃতির কোনো কোনো অংশ অসম্পূর্ণ রেখেছেন। যাতে ওই অসম্পূর্ণ অংশগুলোকে নিয়ে দর্শকরা স্বাধীনভাবে তাদের মতো করে ভাবতে পারেন। যেমন মোনালিসার মুখের কোণ এবং চোখের কোল এই দু’টি অংশকে অস্পষ্ট রেখেছেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। এই অস্পষ্টতার কারণে মোনালিসার হাসি এবং দৃষ্টি সুস্পষ্ট কিংবা নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেয় না। ফলে দর্শক মোনালিসার হাসি এবং দৃষ্টি নিয়ে নানাভাবে ভাবতে পারেন। এজন্য বলা হয়েছে যে, মোনালিসার অমোঘ আকর্ষণে আমরা যতবার তার কাছে যাই ততবার তাকে নতুন আবিষ্কার করি (পাশ্চাত্য চিত্রশিল্পের কাহিনী, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়)। উল্লিখিত বিষয়গুলো জানার কারণে অনেক দর্শক মোনালিসা সম্পর্কে বিজ্ঞপণ্ডিতের মতোই কথা বলেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে না এবং এর কারণ যে অজ্ঞতা সে কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
শিল্প এবং শিল্পের সৌন্দর্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি না পেলে সমাজের বৃহৎ অংশ এ বিষয়ে অজ্ঞই থেকে যাবে। তবে এর দায় শুধু দর্শকদেরই নয়। দায় শিল্পের সাথে জড়িত সব মহলের। যারা বিচারক তারা কিভাবে শিল্প বিচার করেন, যারা সমালোচক তারা কিভাবে কোন কোন পদ্ধতিতে সমালোচনা করেন সেসব বিষয়ে সাধারণ উৎসাহী মানুষকে সচেতন করা গেলে এ সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হতে পারত। কিন্তু আমাদের মতো পিছিয়ে থাকা দেশে এটি সম্ভব নয়। অনেক উন্নত দেশে এ বিষয়ে সুযোগ সুবিধা থাকলেও মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া ব্যাপকসংখ্যক মানুষ উৎসাহ দেখায় না। ভারত শিল্প সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ দেশ হলেও সৌন্দর্য কাকে বলে এবং এর স্বরূপ-ই-বা কী সে সম্পর্কে কোনো আলোচনাই হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন আচার্য সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত তার সৌন্দর্যতত্ত্ব নামক গ্রন্থের শুরুতেই। কিন্তু তার পরও যারা এ বিষয়ে আগ্রহী তাদের কেউ কেউ নিজ উদ্যোগ এ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করেন। যারা জানেন বোঝেন তারা এটা জানেন যে, যিনি সৌন্দর্য বিচার করেন তার বিচারপদ্ধতি বৈজ্ঞানিকের রীতি অনুসরণ করে। যে শিল্পকর্মকে অভিজ্ঞজনরা সুন্দর বলেন, সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন, সেগুলোকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত কারণসমূহ উল্লেখপূর্বক যথাযথ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই সৌন্দর্যবিষয়ক পণ্ডিতদের কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অনেকে নানা ধরনের মত প্রকাশও করে থাকেন একই সৌন্দর্য বিষয়ে। সৌন্দর্যের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই শ্রেয় নাকি শিল্পী সৃষ্ট সৌন্দর্য শ্রেয় এ বিষয়েও বিতর্ক রয়েছে। যেমন শিল্পতাত্ত্বিক অ্যাডিশন, বার্ক, কান্ট ও লঙ্গিনাস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাত্ত্বিক হেগেল ও ক্রোচেসহ অনেকেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে শিল্পের মর্যাদা দিতে চাননি। তারা শিল্পীর সৃষ্টি সৌন্দর্যকে দিয়েছেন গুরুত্ব। তারা মনে করেছেন যে, শিল্পী সৃষ্ট শিল্পের মধ্যেই প্রকৃত সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটে। পাহাড়, পর্বত, নদী-নালা, খাল-বিল, বৃক্ষরাজি সজ্জিত প্রকৃতি প্রকৃত অর্থে শিল্পসৌন্দর্যের মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য নয়। যদিও প্রকৃতির অপূর্ব সুন্দর পাহাড় দর্শনে আনন্দ উপভোগ করে থাকেন। সুউচ্চ পাহাড়ের চারপাশে মেঘের আনাগোনা, মেঘে পাহাড়ে মিতালী, গভীর মমতায় পাহাড়ের সাথে মেঘের জড়িয়ে থাকা, কিংবা খণ্ড খণ্ড শুভ্র মেঘের পাহাড়ঘেঁষে ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য এবং মেঘে ঢাকা পাহাড়ের অস্পষ্টতার দৃশ্য কার না ভালো লাগে। অথচ এহেন ভালো লাগা মনোমুগ্ধকর পাহাড়ের সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেননি এসব শিল্পতাত্ত্বিক। চীন, জাপান ও কোরিয়াকে পাহাড়ের দেশ বলেই গণ্য করা হয়। এসব দেশের শিল্পীসমাজ অত্যন্ত যতেœর সাথে পাহাড়কে গুরুত্ব দিয়ে পাহাড়ের বিচিত্রধর্মী চিত্র এঁকেছেন। এসব চিত্রের সৌন্দর্য দর্শনে দর্শক সমালোচক মুগ্ধ হয়েছেন। প্রশংসা করেছেন চিত্রের। গুরুত্ব দিয়েছেন পাহাড়ের সৌন্দর্যদের। অথচ গুরুত্ব দেননি বাস্তব পাহাড়ের সৌন্দর্যকে। সঙ্গতকারণেই হয়তো গুরুত্ব দেননি। কারণ শিল্পতাত্ত্বিক ওস্কারওয়াইল্ড বলেছেন যে, No great artist ever sees things as they really are. If he did, he would cease to be an artist (Melvin reder, A Modern Book of Esthetics, fifth edition, holt, Rinehart and winston, New York, Chicago, Sanfrancisco, Dallas, Montrial, Toronto, London, Sydney, 1903, P. 30)। লক্ষণীয় যে প্রকৃতিতে দেখা প্রকৃত বিষয় নয়, কিংবা প্রকৃত দেখা বিষয়বস্তু অবলম্বনে আঁকা চিত্রও নয়, শিল্পসৌন্দর্য হবে অন্য কিছু। যা দেখা বিষয়বস্তু থেকে ভিন্ন। এ কথাই ওস্কারওয়াইল্ড তার বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন। শিল্প বিষয়ে এ ধরনের অভিমত প্রায় সব তাত্ত্বিকের।
আমরা যে সুন্দরের কথা বলি সেই সুন্দরের দু’টি দিক রয়েছে। একটি বাহ্যিক আর অন্যটি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক। বাহ্যিকভাবে সুন্দর কোনো কিছু দেখে অনেকেই বলে থাকেনÑ আহ কী সুন্দর! হ

 


আরো সংবাদ



premium cement