১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কাজী কাদের নওয়াজের সাহিত্যকর্ম ও স্বতন্ত্রধারা

-

বিগত শতকের ত্রিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে এসে ইউরোপীয় ভাবধারায় সাহিত্য সাধনার চেষ্টায় কল্লোল যুগের সূচনা হয়েছিল। ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ উভয় ধারার মাঝে নিজেকে স্বতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও স্বতন্ত্রধারায় ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তবুও আলাদা একজন।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ একাধারে শিক্ষক, কবি, বহুভাষা-পারদর্শী পণ্ডিত, ঔপন্যাসিক ও অতি সাহসী একজন মাতৃভাষা প্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারীও ছিলেন। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের সময়ে উর্দু হরফে বাংলা লিখতে হবে, এমন ঘোষণার প্রতিবাদে এক সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত অনেকের মধ্যে তিনিই প্রতিবাদী ভাষায় বক্তৃতা করেন। বহুভাষী কবিতা তাদের স্ব স্ব ভাষায় আবৃত্তি করে বাংলায় বুঝিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রত্যেকের কাছে মাতৃভাষাই দামি।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ, শিশু-কিশোরকাব্য ও নীতিকাব্যেই অমরত্ব যাঁর। এই এক অনন্যধারায় তিনি আজও তুলনাহীন। তাঁর কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও নিঃসর্গপ্রেম সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্রজীবনে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকার প্রকাশিত তাঁর ‘মা’ কবিতায় মাতৃভক্তির যে স্বরূপ দেদীপ্যমান, তা তুলনীয় নয়। প্রথম দুটো লাইন আজো বাংলার ঘরে ঘরে কাপড়ে রঙিন সুতোয় লিখে বাঁধাই করা অবস্থায় শোভিত দেখা যায়, শিশুশিক্ষার পাঠে দেখা যায়। কথাগুলো হলো:
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই,/ইহার চেয়ে নাম যে মধূর তিন ভুবনে নাই।/সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক, মাথার পরে আজি,/অন্তরে ‘মা’ থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজী।” তিনি তাঁর ‘হারানো টুপি’ কবিতায় লিখেছেন : “টুপি আমার হারিয়ে গেছে/হারিয়ে গেছে ভাইরে/বিহনে তার এ জীবনে/কতই ব্যথা পাইরে ;” কবিতাটি প্রকাশের পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল।
ব্যাপক সাড়াজাগানো একটি কবিতা, ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় তিনি মুঘল হেরেমের বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তুলে উপস্থাপন করেছেন শিক্ষকের সম্মান বা মর্যাদার কথা। কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে : ‘বাদশা আলমগীর/কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির।/...উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে,/কুর্নিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে-/‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির/ সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’’
উল্লিখিত কবিতাগুলো জানা নেই, এমন কোনো পড়ুয়া বাংলাদেশী এখনো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাঁর বিখ্যাত হয়ে ওঠার জন্য, পাঠক মনে আসন স্থায়ী করার জন্য এগুলোই যথেষ্ট।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আল্লাহ নওয়াজ, মাতার নাম ফাতেমাতুন্নেছা। পৈতৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোর্ট গ্রামে। তিনি ১৯১৮ সালে বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পাস করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বিটি পাস করেন।
শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদ কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৩৩ সালে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর পদে ও পরে কিছুদিন কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ১৯৪৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের এক হিন্দু জমিদার বাড়ি বিনিময় করে চলে আসেন। প্রথম নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ও সবশেষ, তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। প্রাসাদতুল্য এই দ্বিতল বাড়িতে আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
‘মরাল’, ‘নীল কুমুদী’, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘উতলা সন্ধ্যা’, ‘দস্যু লাল মোহন’, ‘দাদুর বৈঠক’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি।
তৎকালীন সময়ে বহু পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘মাহে নও’, ‘মাসিক নবারুণ’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতি’, ‘প্রবাসী’, ‘সপ্তডিঙ্গা’, ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘পাক জমহুরিয়াত’, ‘শিশু সওগাত’, ‘গণদাবী’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক ছাড়াও ১৯৬৩ সালে শিশু সাহিত্যে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’, ১৯৬৬ সালে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি এ মহৎ কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান আদর্শে উজ্জীবিত এই কবি তাঁর কবিতায় সত্য-সুন্দর আর সুনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, পথ দেখিয়েছেন। তিনি তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে অনভিপ্রেত বাহুল্য ও দুর্বোধ্যতা মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুকে অধিক তাৎপর্য দিয়েছে। সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচিত তাঁর কাহিনীধর্মী এবং নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অধিক। তবে সংখ্যা বিচারে নয়; নীতিকথা ও শিশুশিক্ষার বিষয়বস্তুর পাঠক-প্রিয়তার নিরিখে অল্প কিছু লেখাই তাঁকে সাহিত্যে অমরত্বের আসন তৈরি করে দিয়েছে। হ


আরো সংবাদ



premium cement
তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিএনপি : কাদের রৌমারীতে বড়াইবাড়ী সীমান্তযুদ্ধ দিবস পালিত

সকল