২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নক্ষত্র বাগান

-

জীবনে প্রথম বই প্রকাশের আনন্দ আমি একজন রিকশাওয়ালার সাথে শেয়ার করে ছিলাম। সে আমার কাছ থেকে ভাড়া নেবে না। একজন লেখক তাঁর রিকশায় উঠেছে, তাঁর কাছে এই আনন্দ টাকার চেয়েও দামি। আনন্দে তাঁর চোখ ভিজে উঠেছে। আমি অবাক তাকিয়ে আছি...।
এই ছোট্ট ঘটনা সেদিন বাড়িতে এসে বললাম সবাইকে। কুলসুম ফাতিমা বোন দুজন আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাবোধ জানাল দূর থেকে রিকশাওয়ালার প্রতি। বাবার ভরপুর সুগার। বই প্রকাশের আনন্দে সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালেন, নিজেও খেলেন। দুপুরে মা খিচুড়ি রাঁধলেন আর হাঁসের গোশত ভুনা করলেন। বন্ধুদের বই প্রকাশের সংবাদ দিলাম ফোনে। খবর শুনে ওরা চাইনিজে খাবার দাবি করল। আমি আপত্তি করলাম না। বন্ধুদের আবদার পূরণ করে দিলাম। রাত দেড়টায় শোবার আয়োজন করছি এমন সময় রাবিয়া ফোন করে বললÑ এখনই আসতে হবে। না হলে সারাজীবনের জন্য জুহিফাকে হারাবেন। আমি কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। রাবিয়া লাইন কেটে দিয়েছে। এত রাতে বাড়ি থেকে বের হবার অসুবিধে অনেক। জুহিফাকে হারাবার ভয়ও কম নয়। কুলসুমকে ডেকে একটা জরুরি কাজের কথা বলে বের হলাম। জুহিফাদের বাসার সামনে এসে দেখি তিন-চারটে মেয়ে গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক। এদের একজনকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি। জুহিফার বান্ধবী রাবিয়া। সে আমাকে দেখা মাত্রই এগিয়ে এসে বলল, ঘটনা জানেন কিছু?
আমি বললাম, কী ঘটনা? কী হয়েছে?
জুহিফার ফুপাত ভাই আমেরিকা থেকে এসেছে। কাজী ডেকে এনে বসিয়ে রেখেছে। কিন্তু কিছুতেই জুহিফাকে রাজি করানো যাচ্ছে না।
এখন হচ্ছে কী বাড়ির ভেতরে?
ভেতরের পরিবেশ এখন চুপচাপ। কী হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। জুহিফা ফোন করে আমাদের সবাইকে গেটের কাছে আসতে বলল।
আমি ভেতরে গিয়ে দেখব একবার?
মাথা খারাপ? আপনাকে দেখলেই ওর বাবা খুন করবে।
খুনই তো করবে, মেয়ের সাথে আমার বিয়ে তো করাবে না!
সুমন ভাই পাগলামো করবেন না। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। জুহিফার ফোন না পাওয়া পর্যন্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন।
গেটের কাছাকাছি আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আজ থেকে চার বছর আগে এরকম এক চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার ভেতর দিয়েই আমার আর জুহিফার সম্পর্ক হয় লাইব্রেরি ঘরে। রাবিয়াকে চিনি আমাদের সম্পর্কের আরো পরে। মেয়েটি রাজশাহী থেকে এসেছে পড়তে।
আমি বললাম, আর কতক্ষণ নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকা যায়? ভেতরে যদি কিছু হয়ে যায়? জুহিফার ফোনও তো বন্ধ।
আমার ইঙ্গিত রাবিয়া টের পেল। বলল, জুহিফার উপর ভরসা রাখুন। এরকম কিছুই হবে না। নিশ্চিত থাকুন।
রাত তিনটা বেজে কুড়ি মিনিট। আমাদের আর অপেক্ষা করতে হলো না। জুহিফার ফোন খুলেছে। এবং সে পরিষ্কার গলায় বলল, আমার বর ওয়াশরুমে ঢুকেছে। বের হবে এখনই। কাল কথা বলব।
গত মাসে জুহিফা আমাকে বলেছিল, কাজী অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করি চলো।
আমি বলে ছিলাম, তোমার বাবা মেনে নেবেন আমাদের বিয়ে?
বাবার মেনে নেয়া না নেয়ায় কী আসে যায়! তুমি তো বাবাকে বিয়ে করছো না, বিয়ে করবে আমাকে।
দুইটা মাস সময় দাও। যেকোনো একটা জব ঠিক করেই তোমাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসব।
জুহিফা আনন্দে রাজি হয়ে গেল, ঠিক আছে দুই মাস।
আমি বললাম, যদি দুই মাস শেষ হওয়ার আগেই তোমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে?
জুহিফা মলিন মুখে বলল, নিজেকে হত্যা করতে ভয় পাই। না হলে এরকম সিচুয়েশনে নিজেকে মেরে ফেলব।
আমি ঠাট্টার সুরে বললাম, থাক, মারামারির দরকার নেই। নিজেই নিজেকে মারার চাইতে অন্যকে বিয়ে করে বেঁচে থাকবেÑ এটা ভাবতেও আমার আনন্দ, বেঁচে তো আছো!
হ্যাঁ জুহিফা বেঁচে আছে। বিয়ের তেরো বছর পরও জুহিফা বেঁচে আছে। বেঁচে থাক। ভালোবাসারা চিরকালই বেঁচে থাক।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার আট বছরের মেয়ে রাইসা আমাকে ডেকে তুলল। বইমেলায় যাবে। এই মেলাতে আমার শিশুতোষ একটা বই এসেছে। মেয়ের অভিযোগÑ তুমি কিসব পচা পচা গল্প লেখো আমি কিচ্ছু বুঝি না। এমন গল্প লেখো পড়লে বুঝতে পারি। মেয়ের কোমল প্রার্থনায় শিশুদের নিয়ে লেখার একটা তীব্র আগ্রহ মনের ভেতর টের পেলাম। বইটি প্রকাশের দিন তার হাতে একটি তুলে দিতেই সে মহা খুশি।
আমি বললাম, তোমার আম্মুকে বলো আজ বিকেলে আমরা বইমেলায় যাবো।
রাবিয়া এসে বলল, বিকেলে আমি মেলায়-টেলায় যেতে পারব না। মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো। কুলসুমের স্বামী গাড়ি পাঠাবে। চাইলে তুমিও যেতে পারো।
কি হয়েছে মায়ের?
রাবিয়া বিরক্ত মুখে বলল, নিজের মায়ের খবর রাখো না। বাথরুমে পিছলে পড়ে গেছেন। পা ফুলে গেছে। হাঁটতে পারছেন না।
রাবিয়া চলে গেল।
বিয়ের আগে ভেবেছিলাম রাবিয়াকে বিয়ে করে জুহিফাকে হারানোর দুঃখ ভুলে থাকতে পারব। কোমল মানসিকতার ভদ্র এবং মায়া গোছের মেয়ে রাবিয়া। কিন্তু কে জানত, স্বামীর দুঃখ ভোলানোর চেয়ে শাশুড়ির দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়ার জন্যই রাবিয়া আসবে এই বাড়ির বউ হয়ে!
মায়ের ঘরে এসে দেখি রাবিয়ার কথাই ঠিক। মা বিছানায় পা সামনে তুলে বসে আছেন। ফুলে যাওয়া জায়গায় কী এক ক্রিম লাগিয়ে রাবিয়া ম্যাসাজ দিচ্ছে। আর মা উঁহ্ আহ্ যন্ত্রণা প্রকাশ করছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে মা?
মা বললেন, বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে হাঁড় ভেঙেছে। খুব ব্যথা।
ফাতিমার স্বামী গাইনো বিভাগের ডাক্তার। হাড় স্পেশালিস্ট- এমন একজনের ভালো পরামর্শ সে দিতে পারবে। দুপুরের আগেই তার সঙ্গে আলাপ করে সব ঠিক করে ফেললাম। বিকেলে কুলসুমের স্বামী গাড়ি পাঠাবে। কুলসুমও আসবে। মায়ের সঙ্গে কুলসুম আর রাবিয়া যাবে। আমরা বাবা-মেয়ে সন্ধ্যার অল্প পরে বের হলাম বইমেলায়। রাত দশটা পর্যন্ত থাকলাম, খেলাম। মেয়ে আমার এই বই-সেই বই কিনতে কিনতে সতেরোটি বই কিনে নিলো।
শাহবাগ এসে রিকশা নিলাম একটা। রিকশায় উঠেই মেয়ে জেদ করল ফুচকা খাবে। মেয়ের কোমল প্রার্থনার কাছে আমি সবসময়ই পরাজিত। আনন্দে রিকশা থেকে নেমে পড়ল সে। ভাড়া করা রিকশা। রিকশাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে রেখে খেতে মন চাইল না। প্রথমে সে জানাল খাবে না। এক প্রকার জোর করে তাকে সাথে নিয়ে ফুচকা খেলাম। রিকশায় উঠে মেয়ে বলল, বাবা, তোমার বইয়ের মলাট সুন্দর হয় নি। এই বইটা দেখ কী সুন্দর!
মেয়ে আমাকে একটা বইয়ের সুন্দর প্রচ্ছদ দেখাল। আমি বললাম, বাসায় গিয়ে দেখব মা। এখন শক্ত করে ধরে বসো।
রিকশাওয়ালা পেছনে ফিরে হাসিমুখে বলল, ভয় পাইয়েন না। দোয়া পড়ে নিয়েছি। সোবহানাল্লাযি ছাখ্খারা লানা হাযা অমা কুন্না লাহু মুক্বরিনী-ন, অ-ইন্না ইলা রব্বিনা লামুন ক্বলিবুন- এই দোয়া পড়ে নিলে দুর্ঘটনা হয় না।
রিকশা চলছে ঝড়ের গতিতে। আমি বললাম, ভাই একটু আস্তে চালান। সে এবারেও পেছন ফিরে তাকাল। বলল, আপনার মেয়ের বয়সী আমার দুজন যমজ মেয়ে ছিল। গত বছর আমাদের গ্রামের পুকুরে ডুবে দুজনেই মারা যায়।
আমি রিকশাওয়ালাকে সমবেদনা জানালাম। সে আবার বলতে লাগল, আমার মেয়ে দুটির জন্য দোয়া করবেন ভাই। আমি রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে তাদের জন্য দোয়া করি।
বাড়ির কাছে এসে রিকশা থামালাম। ভাড়া দিতে গিয়ে দেখি রিকসাওয়ালা আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। চোখ মুছে সে বলল, ভাড়া লাগবে না ভাই।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ভাড়া নেবেন না কেন? ভাড়া নেন।
সে বলল, আপনার মেয়েকে দেখে আমার মেয়েদের কথা মনে পড়ল। আমার কাছে মনে হইল নিজের মেয়েকে রিকশায় উঠিয়ে ছিলাম, নামিয়ে দিয়ে গেলাম।
রিকশাওয়ালার আবেগ আমাকে আহত করল।
ঘরে এসে শুনি মায়ের বাম পায়ের রগ ছিঁড়ে গেছে। রাবিয়া বলল, ডাক্তার এক্সরে করতে বলল। আপাতত ব্যথা কমানোর ওষুধ দিয়েছেন। আর পায়ে প্লাস্টার রাখতে হবে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত। আমরা সবাই খেয়ে নিয়েছি। তোমার আর রাইসার খাবার দিচ্ছি, মুখ-হাত ধুয়ে আসো।
আমি বললাম, খাব না। খুব ঘুম পাচ্ছে।
মাঝরাতে বুকে শীতল স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙল। আমার বুকে মাথা রেখে রাবিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কি হয়েছে রাবিয়া? কাঁদছো কেন?
রাবিয়া কিছু বলল না। কান্নার কারণ জানতে চাওয়াতে মনে হলো তার চোখ আরও ভিজে উঠল। আমার খোলা বুক সেই জলের শীতল স্পর্শ নিচ্ছে। আমার চিবুকে তার মাথা লেগে আছে। তার চুলের গন্ধ পাচ্ছি। কী অদ্ভূত মায়াময় মিষ্টি গন্ধ! তাকে দু হাতে বুকে জড়িয়ে নিলাম। একসময় সে বলে উঠল, ‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’ কাচের জানালার ওপাশে একটা কোমল মধ্য রাত, নক্ষত্র বাগান, পরিস্ফুটিত জোছনা, বুকের ওপর রাবিয়া। ভালোবাসা বুকে থাক। সেই রিকশাওয়ালার ভালোবাসা বেঁচে থাক, এই রিকশাওয়ালার ভালোবাসা বেঁচে থাক, জুহিফার ভালোবাসা বেঁচে থাক। ভালোবাসারা ভালো থাক। হ

 

 


আরো সংবাদ



premium cement