১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

স্মৃতির আয়নায় রাজিয়া মজিদ

-

সেকালে বিখ্যাত কিন্তু একালে বিস্মৃত লেখকদের খোঁজ আজ ক’জনেইবা রাখে! কিন্তু এককালে পাঠকদের মনে তাঁরা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করতেন। তাঁদের ছিল দুর্বার মেধা। নিজেকে ছড়িয়েছেন দিগি¦দিক। ছড়িয়েছেন কত অসংখ্য আপাত অসম্বন্ধ চিন্তায়, তথ্যে ও অভিজ্ঞতায়। এঁরা সর্বকালের আধুনিক মানুষ। এঁরা আমাদের সহযাত্রী ও অভিযাত্রী। বয়স নয়, তাঁদের লেখার ভেতর দিয়ে আজো আমরা সমমনষ্ক হয়ে উঠি। এঁদেরই একজন রাজিয়া মজিদ, যাঁর সান্নিধ্যে একদা আমি ধন্য হতাম। এই সেদিন অর্থাৎ গত ২২ জুন তিনি পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
পেশাগতভাবে রাজিয়া মজিদ আজীবন একজন কৃতী শিক্ষিকা। জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯৩০, জামালপুর জেলার শ্যামপুর গ্রামে।
ডিএফপিতে আমি যখন সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম, অনেক লেখক-লেখিকা আসা-যাওয়া করতেন। কারো কারো সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করতাম। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাজিয়া মজিদ ছিলেন তাঁদেরই একজন। তখন তিনি অশীতিপর বৃদ্ধা। নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাগত।
রাজিয়া মজিদ তখন শেরেবাংলা নগর উচ্চমাধ্যমিক গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। লেখালেখির সুবাদেই তাঁর সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি প্রায়ই আমাকে তাঁর স্কুলসংলগ্ন বাসায় ডেকে পাঠাতেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ তবু নিজ হাতে পরিবেশন করে খাওয়াতেন। তাঁর সেই স্নেহময়ী রূপ কখনো ভুলবার নয়। একসময় স্কুল কোয়ার্টার ছেড়ে চলে যেতে হয় বনানীতে নিজ বাসায়। সেখান থেকে ৮ অক্টোবর, ১৯৮৮ সালে আমাকে লেখা তাঁর একটি চিঠিÑ
প্রীতিভাজনেষু,
আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। গত ২৯.৯.৮৮ তারিখে বনানী চলে এসেছি। এখানকার কাজ শেষ করতে ২-৩ মাস লাগবে। খালেদ বলে একটি ছেলে আমার জীবনী নিয়ে গেছে। আশা করি পেয়েছেন। ছাপা আরম্ভ হলে আমার জন্য অবশ্যই দু’কপি করে পত্রিকা রাখবেন।
সবে ২য় পর্ব আরম্ভ করেছি। তবে ছোট করেই লিখব। কারণ এ সব ঝামেলার মধ্যে শান্তিমত লেখা যায় না। নিভা আমার সঙ্গেই আছে। এখান থেকে ফোন করা সম্ভব নয়। কারণ কেউ কারোর সঙ্গে মেশে না। তাই চিঠি দিলাম। ঠিকানা রইলো। যোগাযোগ করবেন। সময়মত বেড়াতে আসবেন। আপনার সম্পর্কেও লেখার ইচ্ছে আছে। আরো কিছু জানতে হবে। ইতি রাজিয়া মজিদ, বাড়ি নং-৩০, রোড নং-২০, ব্লক-কে, বনানী, ঢাকা।
স্মৃতি যেন অতীতের ফেলে রাখা আয়না, মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলা যায় না।
রাজিয়া মজিদ বাংলা কথাসাহিত্যের একজন উল্লেখযোগ্য শিল্পী। প্রায় ছয় দশক কালধরে তিনি নিরলসভাবে সাহিত্যচর্চা করেছেন। বিশেষত বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নারীদের অবদান যেখানে নগণ্য, সেখানে বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবদান অবশ্যই প্রশংসনীয়। যে কাল ও সময়ের উপকূলে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর সাহিত্যচর্চা চালাবার প্রয়াস পেয়েছেন, সেই সময়কার নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বিবর্তনের ধারা-চিত্র তাঁর সাহিত্যে বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। রাজিয়া মজিদের সমগ্র সাহিত্যকর্ম তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা,লব্ধজ্ঞান, বাস্তববোধ ও উপলব্ধির রসে জারিত।
কথাসাহিত্যিক রাজিয়া মজিদের ব্যাপ্তি শুধু উপন্যাস ও ছোটগল্পকে ঘিরে নয়। তিনি ইতিহাস, সমাজ ও সাধারণ নরনারীর প্রেম ও জীবনবৈচিত্র্য নিয়ে একাধারে উপন্যাস, ছোটগল্প, জীবনী, আলেখ্য ও ভ্রমণকাহিনী ইত্যাদি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন। রাজিয়া মজিদের বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ ‘ভালবাসার সেই মেয়েটি’ ২০০৮ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘দি গার্ল ইন লাভ’ অনূদিত হয়। অনুবাদ করেন প্রখ্যাত সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন।
রাজিয়া মজিদের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, আলেখ্য, জীবনী ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রচনা করেন। ‘আলেখ্য’ রাজিয়া মজিদের সেরা গল্প বলে বিবেচিত। বহু পত্রপত্রিকায় তিনি লিখেছেন। সচিত্র বাংলাদেশে আমি তাঁর বহু গল্প, ভ্রমণকাহিনী ও স্মৃতিকথা ছাপিয়ে ধন্য হয়েছি।
কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাজিয়া মজিদ ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের স্বর্ণপদক, ১৯৮৯ সালে একুশে পদক, ২০০৬ সালে কবি জসীমউদ্দীন স্বর্ণপদক লাভ করেন।


আরো সংবাদ



premium cement