০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

গ্রাফিতি : প্রবহমান সংস্করণ

গ্রাফিতি : প্রবহমান সংস্করণ -

প্রথমেই বলে রাখি গাত্রচিত্রকেই বলা হয় গ্রাফিতি। অর্থাৎ চিত্রের উৎপত্তিই ঘটেছে গ্রাফিতি থেকে। গ্রাফিতি হলো অঁাঁকা-আঁকি বা লেখালেখি। বাংলাদেশে আগস্ট বিপ্লবে প্রতিবাদ ও প্রত্যাশার অন্যতম ভাষা ছিল গ্রাফিতি। ছাত্র-জনতা রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ফ্যাসিস্ট শাসনকে তুলে ধরতে এবং ফ্যাসিস্ট এমপি-মন্ত্রী ও আমলাদের চরিত্র পরবর্তী প্রজন্মকে অবগত করাতে দেয়ালে দেয়ালে যে চিত্র অঙ্কন করেছে তা-ই গ্রাফিতি। গ্রাফিতি শব্দটি ইতালীয় শব্দ ‘গ্রাফিয়াটো’ (স্ক্রাচড্) আঁচড় কাটা অর্থে এসেছে। গ্রাফিতি অর্থ আঁকা বা অঙ্কন করা, লেখাকেও বোঝায়। উৎপত্তির দিক থেকে গ্রাফিতিতে গ্রিক ‘গ্রাফেইন’ শব্দেরও হদিস পাওয়া যায়, যার অর্থ ‘লেখা’। প্রাচীন রোম ও পম্পেই নগরীর কবরস্থানের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। বাইসনও গ্রাফিতি। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চল, জর্দানের পূর্ব অঞ্চল এবং সৌদি আরবের উত্তারাঞ্চলে শিলা ও পাথরের উপরে বেশ কিছু লেখার সন্ধান পাওয়া গেছে, যা স্যাফাইটিক ভাষায়; অনুমান করা হয়, এই স্যাফাইটিক ভাষার বিকাশ গ্রাফিতি থেকে। স্যাফাইটিক খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে হতে পারে। তবে গ্রাফিতির বয়স আরো বেশি। যেমন- পেট্রোগ্লিফ এবং জিওগ্লিফ। ধারণা করা হয়- এগুলোর বয়স ৪০ হাজার থেকে ১০ হাজার বছরের ভেতর। চৌভেট গুহার চিত্রগুলো আনুমানিক ৩৫ হাজার বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল; কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার গুহা আরো প্রাচীন। কে বা কেন কী উদ্দেশ্যে এসব চিত্র অঙ্কণ করেছিল এখন আর তা স্পষ্ট করে জানা যায় না। যতটুকু জানা যায় তা হলো, প্রাচীন শিল্পীরা টিওবের মাধ্যমে পেইন্ট দিয়ে স্টেনসিল গ্রাফিতি করেছিল। প্রাচীন রোমে যেসব গ্রাফিতি পাওয়া গেছে তার বেশির ভাগ গ্রাফিতি যৌন অভিজ্ঞতা নিয়ে অঙ্কিত। সে সময়ে গ্রাফিতির অন্য বিষয়ও লক্ষ করা গেছে। যেমন- ‘সেটর স্কয়ার’। এটি শব্দ জব্দ ধাঁধা বা ওয়ার্ড-গেম। মধ্যযুগে এসে শ্রীলঙ্কার ‘সিগিরিয়া’র আয়না দেয়ালে এক হাজার ৮০০-এরও বেশি গ্রাফিতি পাওয়া যায়। এগুলো ১৮ শতকে অঙ্কন করা হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। এখানে চিত্রিত বেশির ভাগ গ্রাফিতিই অর্ধনগ্ন নারীর ফ্রেস্কো।
বলা যায়, আধুনিক গ্রাফিতি ‘হিপ হপ’ সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। ‘হিপ হপ’ গ্রাফিতি শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে নিউ ইয়র্ক সিটি ও ফিলাডেলফিয়াতে। এসব গ্রাফিতি বা ট্যাগগুলো ছিল স্টাইলিস্ট। এগুলো শুরু হয়েছিল ‘তা কি’ ও কর্নব্রেডের মতো শিল্পীদের দিয়ে। অন্য শিল্পীরাও আঁকেন। তারা সাবওয়ে ট্রেনের পাশের ট্রেনগুলোতে ‘থ্রো-আপ’ ও ‘টুকরো’ও আঁকতে থাকে। এরপর ইউরোপ আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে গ্রাফিতি এশিয়া এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্টেনসিল গ্রাফিতির শিল্পীরা যেমন ‘ব্লেক-লে-র্যা ট’ আমেরিকার গ্রাফিতির আগে পশ্চিম ইউরোপে বিশেষ করে প্যারিসে খ্যাত ছিলেন। আশির দশকে এসে আমেরিকান গ্রাফিতি এবং হিপ হপ গ্রাফিতি ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
গ্রাফিতি নানান বিষয়কে ধারণ করে সামনে এগিয়েছে। যেমন, মানব অভিব্যক্তির প্রায় সব স্তরেই গ্রাফিতির সরব উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এমনকি বাথরুমের দেয়ালেও গ্রাফিতি হয়েছে। মানুষ যতকিছু ভাবে সেসব ভাবনার বিষয় গ্রাফিতির মাধমে প্রকাশ করেন শিল্পীরা। যৌনাচার, বাণিজ্য, ধর্ম, রাজনীতি, অবিচার-অত্যাচার, শাসন-শোষণ, গালি-গালাজ, উৎপাদন-বিপণন, কৃষি, গবাদি পশু; প্রকৃতি, আসমান-জমিনসহ সব বিষয়েই গ্রাফিতি হয়ে থাকে। প্রতিক্রিয়াশীল গ্রাফিতির বিষয় হিসেবে খ্যাত হয়েছে স্বৈরতন্ত্র, নিপীড়ন ও বৈষম্য।
গ্রাফিতিকে চিত্র বলা যায় কি না তা নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও চিত্রই যে গ্রাফিতি তাতে একমত আছেন গবেষকরা। তারা গ্রফিতিকে চিত্র বলার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন। চিত্র বলতে সাধারণত রঙ-তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে আঁকা কোনো একটি দৃশ্যের অনুকৃতিকে বুঝে থাকি। কিন্তু এই ধারণার মধ্যে চিত্র এখন আর আবদ্ধ নয়। চিত্রের ক্যানভাস এখন আরো প্রসারিত, বিস্তৃত। চিত্রের এই বিস্তৃত ক্যানভাস সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাশো বলেছেন- ‘গত দু’তিন শ’ বছর ধরে আমরা ছবি বলতে বুঝি একটুকরো চট বা ক্যানভাস বা কাঠের পাটা বা কাগজ; তাতে কিছু রঙ আর তার চারধার ঘিরে একটা ফ্রেম যা আশপাশের সব জিনিস থেকে রঙিন বস্তুটিকে আলাদা করে রাখবে। ছবির এই সংজ্ঞা বদলাতে না পারলে ভবিষ্যতে আমরা এগোতে পারব না এবং অতীত থেকেও শিখতে পারব না’। পিকাসোর এই ধারণা গাত্রচিত্রকে চিত্র হিসেবে সমর্থন করে। একসময় মিসরের কবরচিত্রকে, গ্রিক ভাসকে, পম্বিয়াই, ইট্রুস্কান এবং মাটির পাত্রের গায়ে আঁকা ছবিকে ছবি হিসেবেই স্বীকার করা হতো না। সেই ধারণা এখন পাল্টে গেছে। এখন যেখানেই মানুষ রেখা, রঙ, তুলি বা কলম দিয়ে কিছু একটা এঁকেছে সেখানেই ছবির উৎস খুঁজতে হয়েছে। কেননা চিত্রকলা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহারের জিনিস, মোটেই শৌখিন কিছু নয়। সে জন্য চিত্রকলার আদি নিদর্শন খুঁজতে গেলে গাত্রচিত্রকেই তুলে ধরতে হয়। কারণ গুহাবাসী মানুষ তাদের প্রয়োজনে গুহার দেয়ালে বা গায়ে যে ছবি এঁকেছিল সেগুলোই পৃথিবীর আদি চিত্রকলার নিদর্শন। সেগুলোই গ্রাফিতি। সেই আদি গুহাবাসীর দেয়ালচিত্র বা গাত্রচিত্রের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে শুধু গুহায় নয় এ চিত্র উঠে এসেছে নানান মাধ্যমে। মধ্যযুগের পর থেকেই গ্রাফিতি চিত্রশিল্প। আধুনিক সময়ে গ্রাফিতি শিল্পকলারই অনুষঙ্গ। সে জন্য শিল্পফর্ম হিসেবে গ্রাফিতি প্রদর্শিত হয়েছিল ২০০৬ সালের এক প্রদশনীতে, প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রুকলিন মিউজিয়ামে। অস্ট্রেলিয়াসহ সমগ্র বিশ্বেই গ্রাফিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে এবং গ্রাফিতি শিল্পের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
মোটামুটি মধ্যযুগ থেকেই গ্রাফিতি বিপ্লবের চেতনাকে উসকে দিয়েছে এবং প্রতিবাদের ভাষাকে শৈল্পিকরূপ দিয়েছে। চীনে মাও সেতুং ১৯২০ সালের দিকে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বেগবান ও জনগণকে জাগ্রত করতে পাবলিক প্লেসের দেয়ালে বিপ্লবী স্লোগান ও চিত্রকর্ম তুলে ধরেছিলেন। হংকং-এ ‘তাজাং তসু চোই’ বহুদিন যাবৎ গ্রাফিতির মাধ্যমে সেই অঞ্চলের স্বাধীনতা দাবি করে আসছিলেন। তাইওয়ানে নিদির্ষ্ট এরিয়া ব্যতীত গ্রাফিতি অঙ্কন করা হলে গ্রাফিটিস্টদের জরিমানা গুনতে হতো। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০১১ সালে ‘জি-২০’ শীর্ষ সম্মেলনের পোস্টারে একটি ইঁদুরের গায়ে স্প্রে পেইন্ট করার কারণে সিউল কর্তৃপক্ষ গ্রাফিটিস্ট ‘পার্ক জং সু’কে জরিমানা দিতে বাধ্য করেছিল। মিস্টার সু’য়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল, তিনি এই স্প্রে পেইন্ট করার মধ্য দিয়ে আয়োজক কমিটির সুনাম নষ্ট করতে অবমাননাকর বক্তব্য প্রচার করছেন। সার্ব অধ্যুষিত বলকান, বেলগ্রেড, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়ায় প্রচুর গ্রাফিতি হয়েছে। এসব গ্রাফিতি সার্বসেনা এবং গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের চিত্র ও চরিত্র, যা যুগোস্লাভিয়ার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের শনাক্ত করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল এবং গ্রাফিতিগুলোর দ্বারা নির্মম সত্য হিসেবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বসনিয়াক মুসলিমদের বিরুদ্ধে সার্ব কর্তৃক জাতিগত গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ প্রদর্শন করা হয়েছিল। গ্রাফিতি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ফ্যাসিস্টদের বিপক্ষে দ্রোহ, ক্রোধ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ সৃষ্টি করা। গ্রাফিতির এই চরিত্রটিই বিশ্বদরবারে প্রশংসিত হয়েছে বেশি। বাংলাদেশে ৫ আগস্টের পর ফ্যাসিস্ট চরিত্রকে উন্মোচন করতে এবং ফ্যাসিস্ট সরকার কর্তৃক আক্রান্ত ক্ষতবিক্ষত স্থান, দফতর ও চিহ্নগুলো জনসাধাণের সামনে প্রকাশ করতে দেয়ালে দেয়ালে অঙ্কন করা হয়েছে গ্রাফিতি। এর সাথে সাথে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশকে কিভাবে পেতে চায় তারও প্রত্যাশা তুলে ধরা হয়েছে এসব গ্রাফিতির ভেতর দিয়ে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেয়াল ভরে গেছে গ্রাফিতিতে। বাংলাদেশ গ্রাফিতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে ‘সংস্কার’ শব্দ বেশ প্রভাব বিস্তার করেছে। আগামী বাংলাদেশের একটি সামগ্রিক দৃশ্য ৫ আগস্টের পর চিত্রিত গ্রাফিতিযুক্ত বাংলাদেশের দেয়ালে ফুটে উঠেছে।


আরো সংবাদ



premium cement