১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বুলান্দ জাভীরের কবিতার অন্তর্জাল

-

বাংলা কবিতায় আশির দশক এক ভিন্ন মাত্রার দশক হিসেবে চিত্রিত। এ দশকের কবিরা এক নির্জলা পরিবেশে কাব্যচর্চায় এগিয়ে গেলেও স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের গতি প্রকৃতি বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র মুক্তির সোপানে দাঁড়াতেও সক্ষম হয় বিজয়ের বেশে। বিজয়ী এ দশকেরই অন্যতম প্রধান সারির কবি বুলান্দ জাভীর। প্রবন্ধ, অনুবাদেও তার শিল্পবোধ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
আশির দশকের সুপ্রতিষ্ঠিত কবি বুলান্দ জাভীর পেশাগত জীবনে একজন দক্ষ ব্যাংকার হিসেবেও এক সুপরিচিত, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।
কর্মজীবনে একজন সফল মানুষ হিসেবে যেমন তিনি এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম, একইভাবে সাহিত্যের সবুজ প্রান্তরেও তিনি একজন নন্দিত সৃষ্টিশীল কবি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনকারী নান্দনিক
কবিতাই বুলান্দ জাভীরের ধ্যান জ্ঞান। তার কবিতা কখনো পরাবাস্তবতার ঘেরাটোপে থাকে আবৃত। কখনো বা যাদু বাস্তবতার ঐন্দ্রজালিক মায়াময়তার উষ্ণীষ চাপিয়ে যায় হেঁটে কবিতার প্রাঙ্গণ থেকে প্রাঙ্গণে। দীর্ঘ প্রায় সাড়ে তিন যুগেরও বেশি সময়ব্যাপী কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে বুলান্দ জাভীর পাঠকের কাছে এক সমাদৃত কবি হিসেবে গৃহিত ও পঠিত হয়ে আসছেন।
এ পর্যন্ত তার প্রায় এক ডজন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আশির দশকের শুরু থেকে অদ্যাবধি প্রকাশিত তার কবিতাকে কয়েকটি দাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। যেমন তরুণ বয়সে স্বভাবতঃই প্রেমের কবিতা রচনার প্রতিই ছিল তার আসক্তি। যা নিরূপণ করা যায় প্রথম দিককার কবিতায়। এর পর ধীরে ধীরে বুলান্দ জাভীর তার কবিতার রাডারটা ঘুরিয়ে দেন প্রকৃতির দিকে। এভাবেই ধাপে ধাপে বাঁক নিতে থাকে বুলান্দের কবিতা। প্রেমকে উপজীব্য করে জীবনবোধের নানা অনুষঙ্গ বুলান্দের কবিতার ব্যালকনিতে মার্বেলের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকে। একইভাবে লোকজ জীবনের নানা অনুষঙ্গ যেমন তার কবিতায় স্থান করে নেয়। তেমনি নাগরিক কনসেপ্টও বুলান্দ জাভীরের কবিতার পেভমেন্টে শিলকোট জ্বলা এ্যাশফল্টের নীল মনিরতেœর মতো ঝিলিক দিয়ে যেতে থাকে। দূরের ঝাপ্সা আর মেঘলা মায়াবি রেললাইন ধরে এগোতে থাকে তার কবিতার শব্দ পঙ্ক্তি জাগা ‘ভালোবাসার লাজুক ট্রেন’। আশির দশকের প্রধানতম কবিদের একজন হয়ে উঠতে উঠতে কবি বুলান্দ জাভীরের কবিতার স্বরটাও ক্রমাগত স্বকীয়তা তৈরি করতে করতে এসে নোঙর গাড়ে আশির দশকেরই রৌদ্রোজ্জ্বল সিপোর্টে।
তিনি আজ একজন পরিণত, প্রতিষ্ঠিত কবি হিসেবে সুবিদিত হয়ে উঠেছেন নিজেরই সৃষ্টির সুবাদে। তার কবিতা যেমন দেশাত্মবোধ, প্রেম, প্রকৃতিকে ধারণ করে বিরচিত হয়েছে। একইভাবে বুলান্দ জাভীরের কবিতায় আন্তর্জাতিকতা বোধের অন্তরীক্ষও উন্মুক্ত হয়েছে ডানা মেলে। যেন বিহঙ্গের মতো তা উড়ে যাওয়ার জন্য ভোরের শিশির ভেজা রানওয়েতে সারাক্ষণই থাকে প্রস্তুত।
আর জ্যোৎস্নার লাউঞ্জে বসে তার কবিতার কার্নেসন ডোবা বিকেলগুলো এয়ারহোস্টেজের স্লিভলেস বাহুর রেশমি দিগন্তে যায় ভেসে। কখনো হেসে গড়িয়ে পড়ে তার কবিতা ঐশ্বর্য্যময় লাল পুল্ওভার পরা কর্পোরেট কোম্পানির সিল্কি গোলাপের মতো। পাখিদের নীল পনিটেলে, মেঘ শিরিষের নির্জন গহিন থেকে গহিনে থাকে ডুবে। চন্দ্রোজ্জ্বল সন্ধ্যার জাফরানি রেলিঙের কনুইয়ের ভাঁজে থাকে জেগে বুলান্দের কবিতার ধোপদুরস্ত ঝাউফুল ফোটা ছায়া। আর ওই আটপৌরে ছায়ার ককপিটে তুমুল বর্ষণজ্বলা দিন টেরিলিন বোনা দুপুরের মতো থাকে পাশ ফিরে বসে। হ্যাঁ, কবি বুলান্দ জাভীর আমাদের আশির দশকের এক অন্যতম, অনন্য রূপকল্পের কবি। তার কবিতার ছবিটা কখনো চিত্রকল্পের ক্যানভাসের মর্মকে যায় হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে। কখনো আবার ফিরে ফিরে আসে বুকের বৃষ্টির মতো। আর ওই বৃষ্টির রূপোঝুরি ফুলকায় যেন অবিশ্রাম বেজে চলেছে ক্ল্যাসিকেল এক বাদলা ঝরা ক্রিসেন্থিমাম।


আরো সংবাদ



premium cement