০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`
মু ক্ত গ দ্য

আত্ম-উপলব্ধি

-

নিজের পছন্দ, নিজের মতামতকে আঁকড়ে বাঁচতে অভ্যস্ত মানুষরা সদা নিজের সমর্থনে বদ্ধপরিকর থাকে। সামনের জনের ভুল, দোষটা বা ভুলটা তার, ভুলটা আমার নয়, আমি দোষ করিনি- এমন একটা গোঁ ধরে থাকা মানুষের সাথে চলতে গেলে নিজের মতামত বা স্বকীয় চিন্তা ও রুচিকে নতজানু করে নমঃ নমঃ মানসিকতায় ঢেলে নিতে হয়। তা না হলে এরা বড় হাঙ্গামা করে।
চারদিকে তাকালে দেখা যায়, নিজেকে উত্তম, প্রকৃষ্ট ও নির্ভুল বলে বিশ্বাস ও প্রমাণ করার একটা মানসিকতায় গোঁ ধরে থাকা মানুষের ছড়াছড়ি। কিন্তু এমন চিন্তায় আটকে না থেকে বরং সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানসিকতা পোষণ করা মানুষের সংখ্যা অনেক কম। অথচ এর আধিক্য উপস্থিতিই একটা সভ্য সমাজ জীবনে থাকা উচিত। অন্যের দিকে আঙুল তোলা খুব সহজ। নিজেকে বিচারক ভেবে নিয়ে অন্যের পিঠে দোষের বস্তাটা তুলে দেয়াও এমন মানুষদের কাছে তেমন কঠিন নয়। কিন্তু দোষ চিহ্নিত করা আঙুলটা নিজের দিকে তাক করার কথাটা দুঃস্বপ্নের মতো অপছন্দের হয় এদের কাছে।
ইসলাম মানুষকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষা দেয়। দেয় একচোখা দৃষ্টির তর্জনী না তুলে মোসাফা করার শিক্ষা। শিক্ষা অর্জন হলেও তার প্রয়োগ কী আর মানুষ করে! হাত তুলে তো অনেকেই। কল্যাণের হাত শুধুমাত্র নিজের জন্য। কিছু হাত ওঠে বিপরীত হাতওয়ালার দিকেই। আবার অন্যভাবেও যদি ওঠে তাহলেও তা মুষ্টিবদ্ধ। অথবা ঝঞ্ঝার গতিতে চলে চোয়াল। তাদের নিচের হাত আগানো হলেও উপরের হাতের বেলায় ঠিকই গুটিয়ে রাখতে দ্বিধা হয় না মোটেও। তাই হাত মেলাতে বা বাড়াতে সবাই পারে না। যেখানে হাত মেলানোর বা বাড়ানোর মানসিকতা সবার থাকে না, সেখানে স্বার্থ চরিতার্থে ব্যাঘাতে অসহিষ্ণু হওয়াটাই স্বাভাবিক। আজকাল তাই উদার বা ত্যাগী মানসিকতার বিষয় অমাবস্যা রাতে চাঁদ দেখার মতো ব্যাপার। বিদ্বেষ বৈষম্যের রুক্ষ বাতাসে হৃদ্যতা অলীক বস্তুর মতো অদৃশ্য। চারপাশের দর্পণে এমনই অভিন্ন ছবি অহরহ। অথচ চর্চা হওয়ার কথা ছিল সজীব আলোর আন্তরিক ভালোবাসার। যেমনটা ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় পাশে থাকার, সাম্যের, সহমর্মিতার।
নিজের আর নিজের ভালোবাসার প্রিয়জনদের বাইরের সবাই মন্দ- এমন মানসিকতা লালন করা অসংখ্য মানুষের ভিড়ে দু-একজন ভিন্ন মানুষ যারা থাকে, তারা খুবই নিষ্ঠুরভাবে পিষ্ট হয়। পিষ্টকারীরা বা দোদুল্যমান ভাবুক মনের বুদ্ধিমানেরা এই পিষ্ট করার অন্তর্নিহিত ব্যাপারটা কেউই টেরই পায় না। জীবনের পরতে পরতে শুধু ঠকে যাওয়া, অসংখ্য স্বপ্ন ভঙ্গ, সকল প্রাপ্য না পাওয়ার বিপরীতে কোনও অভিযোগ অনুযোগ না করে থাকাটা বাতাসের গতি উলটে দেয়ার মতোই অস্বাভাবিক। তবুও ‘মানুষের ব্যাকুল কাক্সিক্ষত মন খুব বেশিই আত্মকেন্দ্রিক’ -এমন মেনে যদি নিজেকে উচ্চ মার্গীয় করে তোলা যায়, যদি অকথ্য ভাষায় নিজেকে কিছু একটা প্রবোধ দিয়ে নীরবে দূরে সরে যাওয়া যায়; অনাকাক্সিক্ষত ধাক্কা খাওয়ার পরেও যদি- ‘অসুবিধা নেই বা ঠিক আছে’, বলা যায় : মুখে হাসি আনা ভেজা চোখে সৌহার্দ্যরে মূল্যায়ন না হলেও, অপবাদ ও অপমানের প্রত্যুত্তরে অনেক বলার থাকলেও, যদি কিছুই না বলে নিজেকে নীরবে সংবরণ করা য়ায়; সুভার্থী সুজনদের কুশল বিনিময়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি’ বলা যায়; তাহলে তা সত্যিই আকাশ ছোঁয়ার মতো বিষয়। সেটা এক আসমান সম সুউচ্চতা-রুহানিয়াত সংযোগ। তা মহান রবের আরশের ছায়ায় পৌঁছার পর্যায়ে আলোকিত প্রশান্তির। এই পার্থিব জীবনে বসেই এটা সত্যিই একটা মর্যাদাময় উন্নীত ধাপ অর্জন। জীবনের কঠিন দুর্গম বন্ধুর পথ পেরিয়ে তবেই এমন উচ্চ মনজিলে কদম রাখার অবস্থান তৈরি হতে পারে। সবাই ওখান অবধি পৌঁছাতে পারে না। খুবই কমসংখ্যক যারা পৌঁছান তারা জানেন, তার সফরকালীন দুরুদুরু বুকে সহিষ্ণুতার সাথে থাকা তার মহান রবের পক্ষ থেকে এক অমূল্য মহা অনুগ্রহের গোপন করুণা। মানুষের থেকে আশা কমিয়ে একান্ত নিজের রবের দিকে নিজেকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারলে তবেই চূড়ান্তটা হতে পারে সত্যিকারের সাফল্যের, প্রশান্তির। এখানকার চিরন্তন প্রস্থান আর ওখানে চূড়ান্ত গন্তব্যটা যে অবধারিত।


আরো সংবাদ



premium cement