১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ক্ষমতার অপব্যবহার আনে ধ্বংস

-


ক্ষমতার প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা। তিনি যাকে চান ক্ষমতার সামান্য দান করেন। কিন্তু মানুষের ক্ষমতা অস্থায়ী একটি বিষয়। এটি কারো মধ্যে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে না। আজ আপনি বিশাল ক্ষমতার অধিকারী, কাল ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘বলো, হে আল্লাহ! বিশ্ব-জাহানের মালিক! তুমি যাকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা দান করো এবং যার থেকে চাও রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনিয়ে নাও। যাকে চাও মর্যাদা ও ইজ্জত দান করো এবং যাকে চাও লাঞ্ছিত ও হেয় করো। কল্যাণ তোমার হাতেই নিহিত। নিঃসন্দেহে তুমি সবকিছুর ওপর শক্তিশালী।’ (সূরা আলে ইমরান-২৬) ক্ষমতা স্থায়ীভাবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার মধ্যে অবস্থান করে। আল্লাহর গুণবাচক নামগুলো হলো- তিনি ‘কাদির’ সর্বশক্তিমান। ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিমান।’ (সূরা ফাতির-১) তিনি ‘আজিজ’ মহাপরাক্রমশালী, ‘তিনি মহাপরাক্রমশালী ও অতিশয় বিজ্ঞ।’ (সূরা হাদিদ-১) তিনি ‘জব্বার’ মহাশক্তিধর, ‘আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ কঠোর শাস্তি দাতা।’ (সূরা হাশর-৭) তিনি ‘আজিম’ মহান, ‘মূলত তিনিই এক মহান ও শ্রেষ্ঠ সত্তা।’ (সূরা বাকারাহ-২৫৫) তিনি ‘কাবির’ অতীব মহান, ‘তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো।’ (সূরা মুদ্দাসসির-৩) তিনি ‘কাবিয়্যু’ মহা শক্তিধর, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহাশক্তি ও পরাক্রমশালী।’ (সূরা মুজাদালাহ-২১) তিনি ‘মাতিন’ দৃঢ় শক্তির অধিকারী, ‘আল্লাহ নিজেই রিজিকদাতা এবং অত্যন্ত শক্তিধর ও পরাক্রমশালী।’ (সূরা জারিয়াত-৫৮) তিনি ‘মুকতাদির’ মহাক্ষমতাবান, ‘অবশেষে আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম। যেভাবে কোনো মহাপরাক্রমশালী পাকড়াও করে।’ (সূরা কামার-৪২) ‘আর হে নবী! দুনিয়ার জীবনের তাৎপর্য তাদেরকে উপমার মাধ্যমে বুঝাও যে, আজ আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, ফলে ভূপৃষ্ঠের উদ্ভিদ খুব ঘন হয়ে গেল আবার কালো এ উদ্ভিদগুলোই শুকনো ভুসিতে পরিণত হলো, যাকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী।’ (সূরা আল কাহাফ-৪৫)

মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতে সবাইকে কিছু ক্ষমতা দান করেন। এই ক্ষমতা কিছু লোকের জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে আবির্ভূত হয়, আবার কিছু লোকের জন্য ধ্বংসের কারণ হয়। যারা ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহার করে, ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে ক্ষমতা প্রয়োগ করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে, অধীনস্থ মানবতার প্রতি সুবিচার ও ন্যায্য আচরণ করে সর্বোপরি মানবতার কল্যাণে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তাদের জন্য ক্ষমতা আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে দেখা দেয়। দুনিয়া ও আখিরাতে এদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে সীমাহীন মর্যাদা ও সম্মান। কিয়ামতের ভয়াবহ দিনে যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না, সেই দিন সাত ব্যক্তি আরশের ছায়াতলে স্থান পাবেন, হাদিসের ভাষায় তাদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হলেন ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক’। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কোনো জালিমকে আল্লাহ তায়ালা কখনো পছন্দ করেন না। আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে এ ধরনের জালিমকে না পছন্দের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকার হলো, যারা একটু ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অহঙ্কার শুরু করে, মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার করে, যেখানে সেখানে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে, ক্ষমতার দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্ষমতার একটি বলয় তৈরি করে। এই বলয়ের প্রভাবে সুখে-দুঃখে মানুষ তাদের অবস্থার কথা ব্যক্ত করতে পারে না। চার দিকে জুলুম আর জুলুম চলতে থাকে। তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘ন্যায়পরায়ণ শাসক তথা ক্ষমতার যথার্থ ব্যবহারকারী কিয়ামতের দিন আল্লাহর সর্বাধিক প্রিয় এবং সর্বাধিক নৈকট্যপ্রাপ্ত হবেন। আর অত্যাচারী শাসক আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত ও সর্বাধিক শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। অধিকন্তু সে আল্লাহর দরবার থেকেও বহু দূরে অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি-১৩৭৯)

সুতরাং কেউ শাসনক্ষমতা বা অন্য কোনো দায়িত্ব পেলে অহঙ্কার বা বড়াই না করে পূর্ণ আমানতদারিতার সাথে ক্ষমতার প্রয়োগ করতে হবে। কেউ যাতে জুলুমের শিকার না হয় সে দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। যার যা প্রাপ্য তাকে তা বুঝিয়ে দিতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে কারো অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে পরকালে আল্লাহর দরবারে জবাবদিহি করতে হবে। ক্ষমতার সুযোগ গ্রহণ করে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে স্বার্থ হাসিল করা ক্ষমতার সুস্পষ্ট অপব্যবহার। ক্ষমতা বা পদ-পদবি ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে জনগণ ও রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়া অন্যায় ও জুলুম। বুখারির এক দীর্ঘ হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: এ ধরনের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির অন্যায় উপার্জন সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘সে তার পিতা বা মাতার ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে উপহার দেয়া হয় কি না?’ মহান আল্লাহ তায়ালা অনেককে কিছু না কিছু ক্ষমতা দান করে থাকেন। যারা বুদ্ধিমান তারা এই ক্ষমতাকে মানবতার কল্যাণের নিমিত্তেই ব্যয় ও ব্যবহার করেন। আর যারা নির্বোধ কেবল তারাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করা সুস্পষ্ট জুলুম। ক্ষমতা আর শক্তি চিরকাল থাকে না। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকা এবং সময় থাকতে নিজেদেরকে শুধরে নেয়া। সময়ের আবর্তে পৃথিবীর কত দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরাচার ও লৌহমানবকে দেখেছি, শুনেছি, তাদের ইতিহাস পড়েছি, তারা আজ কোথায়? পৃথিবীর ইতিহাস তাদের সাথে কী আচরণ করছে তাও দৈনন্দিন আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- “কত জনপদ আমি ধ্বংস করে দিয়েছি। তাদের ওপর আমার আজাব অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাতের বেলা অথবা দিনের বেলা যখন তারা বিশ্রামরত ছিল। আর যখন আমার আজাব তাদের ওপর আপতিত হয়েছিল তখন তাদের মুখে এ ছাড়া আর কোনো কথাই ছিল না যে, ‘সত্যিই আমরা জালেম ছিলাম’।” (সূরা আল আরাফ : ৪-৫) আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘পূর্ববর্তী ইবরাহিমের জাতি এবং আদ, সামুদ ও নূহের জাতি এবং মাদইয়ানবাসী ও বিধ্বস্ত নগরের ইতিহাস কি তারা জানে না? তাদের কাছে নবীরা সুস্পষ্ট নির্দেশমালা নিয়ে এসেছিলেন। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুম করেননি; বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পক্ষান্তরে ঈমানদার নারী-পুরুষরা পরস্পরের মিত্র ও সহযোগী। তারা ভালো কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে।’ (সূরা তাওবাহ : ৭০-৭১)

হজরত আবু মুসা আশআরি রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা জালিমকে দীর্ঘ সময় দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। তারপর তিনি এ আয়াত পাঠ করেন- তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তাঁর পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপ্রতিরোধ্য।’ (সূরা হুদ-১০২) (বুখারি-৪৬৮৬, সূরা হুদ-১০২...আ: প্র: ৪৩২৫, ইফা: ৪৩২৬ মুসলিম, তিরমিজি) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কেউ যদি তার কোনো ভাইয়ের সম্মানহানি কিংবা কোনো জিনিসের ক্ষতি করে থাকে, তবে আজই তার কাছ থেকে তা বৈধ করে নেয়া উচিত এবং সেই ভয়াবহ দিন আসার আগেই এটি করা উচিত, যে দিন টাকাকড়ি দিয়ে কোনো প্রতিকার করা যাবে না; বরং তার কাছে কোনো নেক আমল থাকলে তার জুলুমের পরিমাণ হিসেবে মজলুমকে সেই নেক আমল দিয়ে দেয়া হবে এবং অসৎ কাজ না থাকলেও ওই মজলুমের অসৎ কাজ তার ওপর বর্তাবে।’ (বুখারি-২৪৪৯, তিরমিজি-২২৮৭)

হজরত আবু জার গিফারি রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে কুদসিতে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে আমার বান্দারা! আমি নিজের ওপর জুলুম হারাম করে নিয়েছি এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যেও তা হারাম করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পরের ওপর জুলুম করো না।’ (মুসলিম-৬৩৩৮)
কথিত আছে, ‘ক্ষমতা হারানোর পর রাজা খালিদ বিন বারমাক ও তার ছেলে কারাবন্দী হলে তার ছেলে বলল- আব্বা! এত সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকার পর এখন আমরা কারাগারে? খালিদ বললেন- হ্যাঁ, বাবা! প্রজাদের ওপর জুলুম চালিয়ে আমরা যে রজনীতে তৃপ্তির সাথে নিদ্রা গিয়েছিলাম, আল্লাহ তখন জাগ্রত ছিলেন এবং মজলুমদের দোয়া কবুল করেছিলেন। জুলুমের পরিণতির ভয়াবহতা সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে আরো অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সা: নিত্যদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এ দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জুলুম ও মজলুম উভয় থেকে আশ্রয় দাও।’
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement