১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজ-পরবর্তী আমল

-

পবিত্র নগরী মক্কায় আসা এবং হজের হুকুম আহকাম সম্পাদন ভ্রমণ ইত্যাদি কার্যক্রমের মধ্যেই হজের উদ্দেশ্য শেষ হয়ে যায় না বরং হজ-পরবর্তী সময়েও রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ জীবনযাপন ও আমলি জিন্দেগি।

আল্লাহ তায়ালা একনিষ্ঠ একত্ববাদের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য অন্যতম সহায়ক হলো হজ। সুতরাং হজ-পরবর্তী জীবন হবে তাওহিদনির্ভর। হজ-পরবর্তী এমন কোনো কাজই করা যাবে না যেখানে তাঁর সঙ্গে অংশীদারত্বের ন্যূনতম সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মহান হজের দিনে মানুষের প্রতি (বিশেষ) বার্তা হলো, আল্লাহর সঙ্গে শিরককারীদের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গেও নেই।’ (সূরা তাওবা : ৩) হজের পর গোনাহমুক্ত জীবনযাপনই হলো হজ কবুল হওয়ার লক্ষণ।

হজের পর হজ পালনকারীদের উচিত আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের প্রতি যথাযথ গুরুত্বারোপ করা। মনীষীরা বলেছেন, হজ-পরবর্তী জীবনে হজ পালনকারী তার ভালো কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। পাপের কাজ থেকে দূরে থাকে। হজ-পরবর্তী সময়ে সমাজে ভালো কাজের অংশগ্রহণ বাড়ানো। অন্যায় প্রতিহত করতে বিশ্বনবীর পন্থায় অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যাওয়া। নিজে যেমন অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকবে তেমনি অন্যকেও অন্যায় থেকে হিফাজত করতে সচেষ্ট থাকা।

হজ-পরবর্তী করণীয় ও দিকনির্দেশনা দিয়ে মহান আল্লাহ আয়াত নাজিল করেন। এ আয়াতে মহান আল্লাহ তাদের উদ্দেশে কী বলেন?
হজ পালনকারীদের উদ্দেশে তাদের বাকি জীবনের করণীয় সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমে ঘোষণা করেন।
‘অতঃপর যখন তোমরা (হজের) যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে নেবে, তখন (মিনায়) এমনভাবে আল্লাহর স্মরণ (জিকির) করবে, যেমন (জাহেলি যুগে) তোমরা তোমাদের পিতৃ পুরুষগণকে স্মরণ করতে অথবা তার চেয়েও বেশি গভীরভাবে (স্মরণ করবে)। এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে (সওয়াব) দান করো।’ মূলত তাদের জন্য পরকালে (কল্যাণের) কোনো অংশ নেই।’ (সূরা বাকারা : ২০০)

পক্ষান্তরে তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং পরকালেও কল্যাণ দান করো। আর আমাদেরকে দোজখের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা বাকারা : ২০১)
ইসলামপূর্ব যুগে আরবের লোকেরা হজ সম্পাদন করেই মিনায় মেলার আয়োজন করত। তাই আল্লাহ তায়ালা জাহেলি যুগের সে রীতির পরিবর্তন করে মানুষকে নির্দেশ দেন যে, হজের পর মেলা নয় বরং আল্লাহর স্মরণই সর্বোত্তম। আর তা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত রাখা আবশ্যক।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে হজের উদ্দেশ্যে যাওয়া লোকদেরকে তাদের নিজ নিজ দেশে ফিরে কী করতে হবে তা বর্ণনা করেছেন প্রিয়নবী সা:। হাদিসে এসেছে-

১. হজরত কাব বিন মালেক রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন। (বুখারি)
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত হজের দীর্ঘ সফর শেষে যখন কোনো মানুষ নিজ বাড়িতে ফিরবে তার উচিত নিজ মহল্লার মসজিদে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা; অতঃপর ঘরে ফেরা। এ নামাজ আদায় করা প্রিয়নবীর অনুসরণীয় সুন্নত আমল।
মসজিদ থেকে দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিজ ঘরে প্রবেশের পরও শুকরিয়াতান দুই রাকাত নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব। হাদিসে এসেছে-

২. রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন তুমি ঘর থেকে বের হবে, তখন দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এ নামাজ তোমাকে ঘরের বাইরের বিপদাপদ থেকে হেফাজত করবে। আর যখন ঘরে ফিরবে, তখনো দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। এ নামাজ তোমাকে ঘরের অভ্যন্তরীণ বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করবে।’ (মুসনাদে বাজ্জার)

নিরাপদে হজ পালন করে দেশে ফিরে আসার পর শুকরিয়াস্বরূপ গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেয়াও বৈধ। হাদিসে এসেছে-

৩. হজরত জাবের বিন আবদুল্লাহ রা: বর্ণনা করেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা: যখন মদিনায় আসেন, তখন একটি পশু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবায়ে কেরাম তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারি)

হজ-পরবর্তী সময়ে বেশি বেশি এ জিকির করা-
রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখেরাতি হাসানাতাও ওয়া ক্বিনা আজাবান নার।’
অর্থ : ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান করো এবং পরকালেও কল্যাণ দান করো। আর আমাদেরকে দোজখের যন্ত্রণাদায়ক আগুন থেকে রক্ষা করো।’

হজ কবুল হওয়ার নিদর্শন

যাদের হজ কবুল হয়, তাদের জীবনের মোড় ও কর্মের অভিযাত্রা ঘুরে যায়। ভবিষ্যতে গুনাহ থেকে বিরত থাকার আগ্রহ বাড়ে। আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি মানুষ যতœবান হয়। হজ করার পর যার জীবনে কাক্সিক্ষত পরিবর্তন আসেনি, তার হজ কবুল হওয়ার বিষয়টি সন্দেহমুক্ত নয়। (আপকে মাসায়েল, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা : ২৫)

হজযাত্রীদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা
যারা হজ করে আসছেন, তাদের অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানো, তাদের সাথে সাক্ষাৎ, মুসাফাহ ও কোলাকুলি করা এবং তাদের দিয়ে দোয়া করানো মুস্তাহাব। কিন্তু ফুলের মালা দেয়া, তাদের সম্মানার্থে স্লোগান ইত্যাদি দেয়া সীমা লঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। (আপকে মাসায়েল আরো ইনকি হল, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা: ১৬২)

জমজমের পানি পান করানো
হজে গেলে হজযাত্রীরা জমজমের পানি সংগ্রহ করেন। বাড়িতে আসার সময় নিয়ে আসেন। এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। জমজমের পানি নিয়ে এসে লোকদের পান করানো মুস্তাহাব। অসুস্থ রোগীদের গায়ে ব্যবহার করাও বৈধ। (মুয়াল্লিমুল হুজ্জাজ, পৃষ্ঠা : ৩০৩)

হজরত আয়েশা রা: জমজমের পানি সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘রাসূল সা: জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে যেতেন।’ (তিরমিজি : ১১৫)
পরিশেষে বলতে চাই, হজ-পরবর্তী জীবন সে তো হবে ভিন্ন জীবন যা পূর্ববর্তী জীবনের ক্লেদাক্ততার কোনো কিছুর সাথে সম্পর্কিত থাকবে না। আর হজে মাবরুর নসিব হলে হজ পালনকারী ব্যক্তি সদ্য প্রসূত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়। তাই হজ পালনকারী ব্যক্তি হজ-পরবর্তী জীবনে নিজেকে নিষ্পাপ কুলুষমুক্ত রাখতে দুনিয়ার সব কাজেই আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করা একান্ত জরুরি। হজসহ ইসলামের সব ধরনের ইবাদাত ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে তার হুকুম পালন করা জরুরি। নামাজ পড়ে বিধায় নামাজি; হজ করেছেন বিধায় হাজি ইত্যাদি ব্যবহার থেকে বিরত থাকাও জরুরি।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement