১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যেন আখিরাতের সফর

-


পবিত্র কাবা মুমিনের হৃদয় স্পন্দন। আবেগ ও অনুভূতির সর্বোচ্চ স্থান। তাই প্রতিটি মুমিন কাবার আঙিনায় হাজির হওয়ার বাসনা পোষণ করেন। বুকভরা ভালোবাসা আর আবেগঘন কণ্ঠে প্রিয় নবী সা:-এর রওজায় সালাম জানানোর সুযোগ সব মুমিনেরই লালিত স্বপ্ন। সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানো আর আরাফায় হাজিরা দেয়া বহুকালের মনের কামনা-বাসনা। পবিত্র ভূমির ধূলি গায়ে মাখতে সবার মন চায়।
ইসলামের মূল পাঁচটি খুঁটির একটি হলো হজ। হজ অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের নির্দিষ্ট তারিখে পবিত্র কাবাঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ি, আরাফার মাঠ-মিনা-মুজদালিফায় অবস্থানসহ নির্ধারিত নিয়মে আনুষঙ্গিক ইবাদতসমূহ পালন করাকে হজ বলে।
হজ আল্লাহর ইশক ও মহব্বত প্রকাশের এক অনুপম বিধান। হজে রয়েছে নিখাদ আল্লাহ প্রেম। এই ইবাদতে এক দিকে যেমন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধন ফুটে ওঠে, অপর দিকে আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিচ্ছবিও ফুটে ওঠে। হজ হলো অভিশপ্ত প্রথার বিরুদ্ধে বিশ্বজনীন এক ঈমানি জাগরণ। এখানে এসে এক হয়ে যায় শত কোটি মুসলিম। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ভাষা-বর্ণের ব্যবধান। বিলীন হয়ে যায় ভৌগোলিক সীমারেখার বিভেদ-প্রাচীর। স্বজাতীয় পোশাক ছেড়ে ধারণ করে ইহরামের শুভ্র একক ইসলামী পোশাক। লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। এখানে নেই ধনী-গরিব, মনিব-গোলামের কোনো প্রভেদ। নেই শাসকের প্রভুত্বসুলভ অহঙ্কার। নেই শাসিতের হীনম্মন্যতা। ভাষা-বর্ণ ছাপিয়ে সর্বত্র ভেসে ওঠে সর্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মনোরম এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।

এ যেন আখিরাতের এক সফর
হজের সফরে ফুটে ওঠে আখিরাত সফরের বিশেষ নিদর্শনাবলি। কেননা, মানুষ যখন হজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, তখন আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর, বন্ধুবান্ধব ত্যাগ করে সে যেন পরকালের সফরে বের হয়। মৃত্যুর সময় যেমন বাড়িঘর, ব্যবসাবাণিজ্য ত্যাগ করতে হয়, অনুরূপভাবে হজের সময়ও এ জাতীয় সবকিছু বর্জন করতে হয়। যানবাহনে আরোহণ, হাজীকে খাটিয়ায় সওয়ার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইহরামের দুই টুকরা শ্বেতশুভ্র কাপড় হাজীদের মনে কাফনের কাপড়ের কথা জাগরূক করে দেয়। ইহরামের পর লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক বলা কিয়ামতের দিন আহ্বানকারীর ডাকে সাড়া দেয়ার সমতুল্য। সাফা-মারওয়া সায়ি, হাশরের ময়দানে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করার মতো। আরাফার ময়দানে লাখ লাখ মানুষের অবস্থান, হাশরের ময়দানের জড়ো হওয়ার নমুনা বলে দেয়। সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয় এ ময়দানে। এক কথায় হজের প্রতিটি আমল থেকেই আখিরাতের কথা ভেসে ওঠে হাজীমনে। হজের সূচনাতেই হজযাত্রী নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ নেন। বংশ-গৌরব, সম্পদের গৌরব ও পদমর্যাদার গৌরবসহ সব পার্থিব আকর্ষণ ভুলে গিয়ে হজযাত্রী পরিধান করেন শুভ্র সাদা কাফনের কাপড়। ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষই যে সমান এবং শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি যে একমাত্র খোদাভীরুতা হজযাত্রীদের সবার পোশাক তারই বার্তা বহন করে। এটিই হলো হজের প্রধানতম তাৎপর্য ও রহস্য।

উত্তম আমল হজ
হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, কোন আমল শ্রেষ্ঠ? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূলকে বিশ্বাস করা’। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তার রাসূল সা:-কে বিশ্বাস করা’। অতঃপর জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা’। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কী? তিনি বললেন, ‘কবুল হজ’। (বুখারি-৯১৫১)
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহ, এ দুয়ের মধ্যে যা কিছু (পাপ) ঘটছে, তার জন্য কাফফারা। আর মাবরুর হজের বিনিময় জান্নাত ভিন্ন কিছু নয়।’ (বুখারি-১৭৭৩)
আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে এবং তাতে অশ্লীল কথা বলেনি, অশ্লীল কাজ করেনি; সে হজ থেকে ফিরবে সে দিনের মতো, যে দিন তার মা তাকে প্রসব করেছে।’ (বুখারি-১৫২১)
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিতÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘নিয়মিত হজ ও ওমরাহ করো। কেননা, এগুলো দারিদ্র্য ও গুনাহ দূর করে, যেভাবে হাঁপর লোহা এবং সোনা-রুপার ময়লা দূর করে। কবুল করা হজের সওয়াব জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।’ (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস-৩৮১৪)
হজরত আবু উমামা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যাকে শক্ত অভাব অথবা অত্যাচারী শাসক গুরুতর রোগ বাধা দেয়নি, অথচ সে হজ না করে মারা যায়, মরুক সে যদি চায় ইহুদি আর যদি চায় খ্রিষ্টান হয়ে।’ (সুনানে দারেমি)
হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণিত এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘হজ ও ওমরাহকারীরা হচ্ছে আল্লাহর মেহমান। অতএব তারা যদি তাঁর কাছে দোয়া করে তিনি তা কবুল করেন এবং যদি তারা তাঁর কাছে ক্ষমা চান তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

হজ না করার পরিণাম
যদি সামর্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও হজ না করে, প্রভুর প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দেয় তাহলে তার জন্য রয়েছে ভীতিপ্রদ সতর্কবাণী। হজ করা থেকে বিরত থাকা ব্যক্তি আল্লাহর জিম্মাদারিতে থাকে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্বয়ং বিশ্বনবী সা:। হাদিসে এসেছে, হজরত আলী রা: বর্ণনা করেনÑ রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার (খরচ বহনের) মতো সম্বল (ধনসম্পদ) ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হজ না করে তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক তাতে (আল্লাহর) কোনো ভাবনা নেই।’ (তিরমিজি) সুতরাং সামর্থ্যবান ও হজের শর্ত পূরণকারী সব নারী-পুরুষের উচিত, হজ করার সামর্থ্য হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা।
সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য
হজের অন্যতম প্রধান একটি দিক হলোÑ ইসলামের সামাজিকতা ও আন্তর্জাতিকতা। হজ আধ্যাত্মিক ইবাদতের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক ইবাদত। মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হজের অন্যতম লক্ষ্য। হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা পরস্পরের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যা সম্পর্কে জানার পাশাপাশি একে অপরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে এবং কাফির ও মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। হজ উপলক্ষে সমবেত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানরা স্বৈরতান্ত্রিক তাগুতি শক্তির বিপদ সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। আর এ জন্যই বারাআত বা কাফির-মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা হজের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, যা সূরা তাওবাহতে স্পষ্টভাবেই বলে দেয়া হয়েছে।
হজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলোÑ আল্লাহর নির্দেশ ও আইনকে সবকিছুর উপরে প্রাধান্য দেয়া এবং ইসলামের স্বার্থে চরম আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকা। প্রতি বছর হজ আমাদেরকে সে জন্য প্রস্তুতি নেয়ার, প্রশিক্ষণ নেয়ার এবং যোগ্যতা অর্জনের ডাক দিয়ে যায়।
লেখক : শিক্ষক , মাদরাসা আশরাফুল মাদারিস, তেজগাঁও, ঢাকা

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement