১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

হজ উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক

-

শুরু হয়েছে হজ মৌসুম। হজ উপলক্ষে সৌদি আরবে সমবেত হবেন ২৫ লক্ষাধিক মুসলমান। মুসলিম উম্মাহর সবচেয়ে বড় জমায়েত এটি। বাংলাদেশে হজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ মে বেলা ১১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে হিজরি ১৪৪৫ সালের হজ কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

এ বছর ৯ মে বৃহস্পতিবার থেকে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রথম হজ ফ্লাইট বিজি-৩৩০১ বিমানটি ৪১৯ জন যাত্রী নিয়ে সকাল ৭টা ২০ মিনিটে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এ বছর মোট ৮৫ হাজার ২৫৭ জন বাংলাদেশী হজ পালন করতে পারবেন। তাদের মধ্যে চার হাজার ৫৬২ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং বাকি ৮০ হাজার ৬৯৫ জন ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করবেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে ইতোমধ্যে চার হাজার ৩১৪ জন হজযাত্রী নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন এবং ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে ৭৮ হাজার ৮৯৫ জন হজযাত্রী নিবন্ধিত হয়েছেন। ৯ মে থেকে শুরু করে ১০ জুন পর্যন্ত জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১১৭টি হজপূর্ব ফ্লাইটে করে ৪৫ হাজার ৫২৫ জন এবং মে মাস থেকে ১২ জুনের মধ্যে সৌদি আরবে ফ্লাইনাস এয়ারলাইন্স ৪৩টি হজপূর্ব ফ্লাইটে করে বাকি হজযাত্রীদের হজ পালন করতে সৌদি আরবে নিয়ে যাবে।

এর মধ্যে ঢাকা থেকে জেদ্দাতে ৮২টি, চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দাতে ১৭টি, সিলেট থেকে জেদ্দাতে পাঁচটি, ঢাকা থেকে মদিনাতে ৯টি, চট্টগ্রাম থেকে মদিনাতে দু’টি এবং সিলেট থেকে মদিনাতে একটি। বাংলাদেশ বিমান ২০ জুন সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশী হজযাত্রীদের নিয়ে ফিরতি ফ্লাইট শুরু করবে এবং সৌদি আরবের বিমান সংস্থা ফ্লাইনাস ২১ জুন থেকে হজের ফিরতি ফ্ল¬াইট চালু করবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ১৬ জুন পালিত হতে পারে পবিত্র হজ। প্রতি বছর এক মাস আগে থেকে শুরু হয় হজ ফ্লাইট।

হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও মৌলিক ইবাদত। জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলিম নর-নারীর ওপর হজ পালন করা ফরজ। আত্মিক উন্নতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও বিশ্বভাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব সর্বাধিক। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য-সংহতি গড়তেও হজের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব মুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেনাও লাভ করা যায় হজের বিশ্ব মহাসম্মিলন থেকে। হজ শুধু ইবাদতই নয়; বরং আত্মিক পরিশুদ্ধতার এক অনস্বীকার্য পদ্ধতি।

হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ : ‘ইচ্ছা’ বা ‘সংকল্প’ একটি যাত্রায় অংশ নেয়া, নিয়ত করা, দর্শন করা, এরাদা করা, গমন করা, ইচ্ছা করা, প্রতিজ্ঞা করাসহ যেকোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। শরিয়তের পরিভাষায় নির্দিষ্ট দিনে নিয়তসহ ইহরামরত অবস্থায় আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করা। আবার কেউ বলেন, জিলহজের ৯ তারিখ ইহরাম বেঁধে আরাফাতের মাঠে অবস্থানসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত কয়েকটি আমল যথাযথভাবে আদায় করে কাবাগৃহ তাওয়াফ করাকে হজ বলে। হজ মুসলমানদের জন্য একটি বুনয়াদি ইবাদত। এটি ইসলাম ধর্মের স্তম্ভগুলোর একটি। যেমন- হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত আছে- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, পাঁচটি জিনিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। এগুলো হলো-

১. আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ সা: তার বান্দাহ ও রাসূল এ কথার সাক্ষ্য দেয়া। ২. নামাজ কায়েম করা। ৩. জাকাত দেয়া। ৪. হজ করা। ৫. রমজান মাসের রোজা রাখা।

হজের ইতিহাস অনুসারে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইবরাহিম আ: সর্বপ্রথম হজের প্রবর্তন করেন। হজ প্রবর্তনের আগে হজরত ইবরাহিম আ: আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইল আ:-কে সাথে নিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন কাবাঘর। সর্বপ্রথম কাবাঘর হজরত আদম আ: ফেরেশতাদের সহায়তায় নির্মাণ করেন। হজরত ইবরাহিম জিবরাইল আ:-এর সাহায্যে একই ভিতে অর্থাৎ হজরত আদম আ: কর্তৃক নির্মিত কাবার স্থানে এর পুনর্নির্মাণ করেন। নির্মাণকাজ শেষ হলে ইবরাহিম আ:-এর প্রতি নির্দেশ এলো হজ পালনের। আল্লাহ তায়ালা হজরত জিবরাইল আ: মারফত তাঁকে হজের সব আহকাম সম্পর্কে অবহিত করেন। ইবরাহিম আ: তাঁর পুত্র ইসমাইল আ:-কে নিয়ে কাবাঘর সাতবার তাওয়াফ করেন, চুম্বন করেন হাজরে আসওয়াদ এবং একে একে সম্পন্ন করেন হজের সব আহকাম। এরপর আল্লাহর নির্দেশ এলো হজের দাওয়াত বিশ্ববাসীকে পৌঁছে দেয়ার।

হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- ‘যখন হজরত ইবরাহিম আ:-কে হজ ফরজ হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরজ করলেন, এটা তো জনমানবহীন প্রান্তর। এখানে ঘোষণা শোনার মতো কেউ নেই। যেখানে জনবসতি আছে সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌঁছবে?’ আল্লাহ বললেন- ‘তোমার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা দেয়া। সারা বিশ্বে পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।’ এ কথা শুনে হজরত ইবরাহিম আ: মাকামে ইবরাহিমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন। আল্লাহ তা উচ্চ করে দেন। কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করে ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ণিত আছে, ‘ইবরাহিম আ:-এর সেই আহ্বান জড়জগতের সীমা অতিক্রম করে রূহানি জগতে পৌঁছে এবং লাব্বাইক বলে যেসব রূহ সেই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল আল্লাহ চান তো কিয়ামত পর্যন্ত তারাই পর্যায়ক্রমে আরাফাতের প্রান্তরে সমবেত হবে!’ এভাবে মক্কা পরিণত হলো হজ পালনের ক্ষেত্রস্থল হিসেবে।

এ হজ দ্বারা স্থাপিত হলো বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর মহামিলনের সুন্দরতম এক দৃশ্য। হজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘এতে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে লোক এর ভেতরে প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যারা অস্বীকার করবে (তাদের স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৯৭) আবার একই বাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ভাষায়। সাহাবি আবু সাঈদ রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা: আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি হজ ফরজ করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ করো।’ (মুসলিম) প্রিয় নবী সা: হজের ফজিলত সম্পর্কে আরো বলেছেন, ‘বিশুদ্ধ ও মকবুল একটি হজ পৃথিবী ও পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু অপেক্ষা উত্তম। বেহেশত ছাড়া আর কোনো কিছুই এর প্রতিদান হতে পারে না।’ আরেক বর্ণনায় জানা যায়, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হজ করবে, হজ পালনকালে স্ত্রীমিলন কিংবা সে সম্পর্কে আলোচনা এবং কোনো প্রকার গুনাহের কাজেও লিপ্ত না হয়, সে (হজ শেষে) সদ্যোজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ অবস্থায় ঘরে প্রত্যাবর্তন করবে।’

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement