১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিপদে পড়ে মৃত্যু কামনা করা

-

বিপদ-আপদ, দুঃখ-বেদনা ও সুখ-সমৃদ্ধি মিলে মিশেই মানুষের জীবন। প্রথমত, সুখ ও দুঃখমিশ্রিত জীবন মানুষকে তার জীবনের মূল্যায়ণ করতে শেখায়। শুধু দুঃখ আর বেদনা দিয়ে যেমন জীবন হয় না, তেমনি শুধু সুখ-সমৃদ্ধি দিয়েও জীবন হয় না।
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন মৃত্যু কামনা না করে। কারণ সে যদি সৎ হয় তবে (বেঁচে থাকলে) হয়তো সে নেককাজ বৃদ্ধি করবে। আর যদি পাপী হয়, তাহলে হয়তো সে তাওবা করবে।’ (বুখারি-৭২৩৫)
আনাস রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ বিপদের কারণে মৃত্যু কামনা করবে না। আর যদি কেউ এমন অবস্থায় পড়ে যে, তাকে মৃত্যু কামনা করতেই হয়, তবে সে দোয়া করবে : হে আল্লাহ! যতদিন বেঁচে থাকা আমার জন্য কল্যাণকর হয়, ততদিন আমাকে জীবিত রাখো, আর যখন আমার জন্য মৃত্যুই কল্যাণকর হয় তখন আমার মৃত্যু দাও।’ (বুখারি-৬৩৫১, ৫৬৭১, মুসলিম-২৬৮০, আহমাদ-১১৯৭৯)

মৃত্যু তো একদিন আসবেই। আপনি ইচ্ছা করলেই শত শত বছর এখানে অবস্থান করতে পারবেন না। তারপরও মানুষ মাঝে মধ্যে বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে অধৈর্যের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে নিজের জীবনের ধ্বংস কামনা করতে থাকে অথবা নিজের হাতে জীবনকে ধ্বংস করে দেয়, যা ইসলামে আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। এটি আল্লাহর অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘প্রত্যেক জাতির জন্য অবকাশের একটি সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। তারপর যখন কোনো জাতির সময় পূর্ণ হয়ে যাবে তখন এক মুহূর্তকালের জন্যও তাকে বিলম্বিত বা ত্বরান্বিত করা হবে না।’ (সূরা আরাফ-৩৪) এই দুনিয়া হলো- নেক আমলের মাধ্যমে সাওয়াব উপার্জনের জায়গা। নেক আমল করার জায়গা। ওপারের দীর্ঘ জীবনে সুখে থাকার জন্য বেশি বেশি পুঁজি সংগ্রহের জায়গা। এই দুনিয়ার পরে অর্থাৎ মৃত্যুর সাথে সাথে এই অর্জন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুরু হবে জবাবদিহিতার পালা। কবর, পুলসিরাত ও হাশরের মাঠে আল্লাহর আদালতে প্রতিটি বিষয়ের জবাব দিতে হবে। সুতরাং চলে যাওয়ার জন্য এত ব্যস্ততা কেন?
সত্যিকার অর্থে হতাশা বা নিরাশা থেকে এ ধরনের মনোভাব সৃষ্টি হয়। হতাশ বা নিরাশ হওয়াও ইসলাম সমর্থন করে না। কারণ হতাশা শয়তানের বৈশিষ্ট্য। হজরত ইবরাহিম আ:-এর কাছে কয়েকজন ফেরেশতা সুসংবাদ নিয়ে এসেছিলেন, তখন তারা ইবরাহিম আ:-এর কথার জবাবে বলেছিলেন, আমরা তোমাকে সত্য সংবাদ দিচ্ছি, তুমি হতাশ হয়ো না। ইবরাহিম বললেন, পথভ্রষ্ট লোকেরাই তো তাদের রবের রহমত থেকে নিরাশ হয়।’ (সূরা হিজর : ৫৫-৫৬) হতাশার কারণে মানুষ নিজের জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠে। ফলে অধৈর্য হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করতে থাকে। সুতরাং যখনই হতাশা সৃষ্টি হবে তখনই আপনার রবের জিকির বা স্মরণ বাড়িয়ে দিন।

সময়ের আবর্তনে মানুষের জীবন কখনো সুখ, কখনো বা দুঃখ-বেদনা ও জয়-পরাজয় স্পর্শ করে থাকে। মানুষ যখন সময় নামক সুখের অংশে প্রবেশ করে তখন সুখ আর সুখের অবগাহনে বিমোহিত হয়। পক্ষান্তরে যখন সে দুঃখের অংশে প্রবেশ করে তখন দুঃখ-বেদনায় জীবন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। মহান আল্লাহই সময়ের আবর্তন ঘটান। তিনি বলেন- ‘যদি কোনো আঘাত (আহত-নিহত, হতাশা, নৈরাশ্য, দুঃখ-বেদনা এককথায় পরাজয়) তোমাদের স্পর্শ করে থাকে, এ রকম আঘাত (পরাজয়) তো কাফিরদেরও স্পর্শ করেছে। এ দিনগুলো আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। কারণ এভাবে আল্লাহ তায়ালা জানতে চান কারা ঈমানদার আর তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসেবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না।’ (সূরা আলে ইমরান-১৪০)
আল্লাহ তায়ালা বলেন-‘ প্রকৃত কথা এই যে, সঙ্কীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও রয়েছে। আসলে সঙ্কীর্ণতার সাথে আছে প্রশস্ততা।’ (সূরা আলাম নাশরাহ : ৫-৬) কথাটি দু’বার বলা হয়েছে। যদিও রাসূলুল্লাহ সা:-কে পুরোপুরি সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আয়াতটি নাজিল হয়েছে, তথাপি এটি সব মুমিনের জন্য প্রযোজ্য। দুঃখ-বেদনা, আপদ-বিপদ বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না; বরং এরপর শিগগির ভালো অবস্থা শুরু হয়। আল্লাহ আমাদের শুভাকাক্সক্ষী। তিনি আমাদের ভালো চান। তিনি আমাদের এমন কাজ করতে নিষেধ করছেন যার মধ্যে আমাদের নিজেদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। মৃত্যুর কাজটি আল্লাহর অধিকার। অতএব, কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেয় সে মূলত আল্লাহর অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান আর তাঁর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ (সূরা ইউনুস-৫৬) তাই নিজে নিজে জীবন হরণ করা আল্লাহ পছন্দ করেন না। এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে নির্দেশ দান করেছেন এবং পরিণামের ভয়াবহতা, কঠোর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কথাও বলেছেন।

আল্লাহই বিপদ দেন আর তিনিই মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আমরা সবাই তাঁর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে আছি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে নবী! ধৈর্য ও দৃঢ়তার সাথে আপন প্রভুর নির্দেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর থাকো। তুমি আমার চোখে চোখেই আছো। তুমি যখন উঠবে তখন তোমার রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করো।’ (সূরা তুর-৪৮) মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষসহ তাঁর পুরো সৃষ্টিকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেননি। তিনি সবাইকে রক্ষণাবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ বিশ্ব-জগতের নিছক স্রষ্টাই নন; বরং এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপকও তিনি।
সুতরাং ইসলামী শরিয়তে বিপদে পড়ে নিজের মৃত্যু কামনা করা বৈধ নয়। কেননা, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি জানে না, হয়তো তার সঙ্কটের পরপরই স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে। তার জন্য উচিত এ বিষয়ে কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন জিকির ও দোয়া পাঠ করা, বিশেষত সালাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! সবর ও সালাতের দ্বারা সাহায্য গ্রহণ করো, আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছেন।’ (সূরা বাকারা-১৫৩)
লেখক : প্রবন্ধকার ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement