১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মুমিন জীবনে আখলাকে হাসানা

-

আখলাক শব্দটি বহুবচন। একবচনে খুলুক, যার অর্থ স্বভাব, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র, অভ্যাস, বৈশিষ্ট্য, শিষ্টাচার প্রভৃতি। আভিধানিক অর্থ ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, স্বভাব, জন্মগত স্বভাব প্রভৃতি’ (আল মুনজিদ ফিল লুগাহ ওয়াল আ‘লাম, ১ম খণ্ড, বৈরুত : দারুল মাশরিক, ১৯৭৩ ইং, পৃ: ৯৪)।
হাসানা শব্দের অর্থ সুন্দর, উৎকৃষ্ট, ভালো প্রভৃতি। সুতরাং আল-আখলাকুল হাসানা অর্থ হলো সুন্দর স্বভাব, উৎকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব, ভালো অভ্যাস, উত্তম চরিত্র প্রভৃতি। পরিভাষায়, কথায়-কাজে নিরহঙ্কার ও উত্তম আচরণ ফুটে ওঠার নাম আখলাকে হাসানা।
আল্লামা জুরজানী আখলাকে হাসানার একটি যথার্থ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তার ‘কিতাবুত তা‘রীফাত’ নামক গ্রন্থে। তিনি বলেন, ‘খুলুক বা চরিত্র হচ্ছে আত্মার বদ্ধমূল এমন একটি অবস্থা, যা থেকে কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অনায়াসে যাবতীয় কার্যকলাপ প্রকাশ পায়। আত্মার ওই অবস্থা থেকে যদি বিবেক-বুদ্ধি ও শরিয়াতের আলোকে প্রশংসনীয় কার্যকলাপ প্রকাশ হয় তবে তাকে আখলাকে হাসানা নামে অভিহিত করা হয় অর্থাৎ কোনো মানুষের কাছ থেকে যদি স্বভাবগতভাবে প্রশংসনীয় আচার-আচরণ প্রকাশ পায় তবে তাকে আখলাকে হাসানা বলা হয়।
অক্সফোর্ড ডিক্সনারিতে বলা হয়েছে, ‘চরিত্র হচ্ছে কোনো মানুষের মধ্যে এমন কতগুলো স্বতন্ত্র গুণাবলীর সমাবেশ, যা মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে। এগুলো এমন কিছু গুণ, যা মানুষকে সংকল্পবদ্ধ হতে ও কঠিন কাজ সম্পাদনে সাহায্য করে।
হাসান বছরী (রহ:) বলেন, ‘সচ্চরিত্র হলো হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, দানশীলতা এবং কাউকে কষ্ট না দেয়া’ (আবূ বকর আল জাযাইরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ: ১১৫)।

আখলাক বা চরিত্র দুই প্রকার। যেমন ১. আখলাকে হাসানা বা সচ্চরিত্র ২. আখলাকে সায়্যিয়াহ বা মন্দ চরিত্র (দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৬ ইং, পৃ: ৭১৫)। শরিয়ত যেসব স্বভাব-কর্মের জন্য মানুষকে প্রশংসিত ও উৎসাহিত করে তাকে আখলাকে হাসানা বলে। আর যেসব স্বভাব-কর্মের জন্য নিন্দিত ও তিরস্কৃত করেছে তাকে আখলাকে সায়্যিয়াহ বলে। আল্লামা জুরজানী বলেন, অন্তর থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও শরিয়তের আলোকে যেসব প্রশংসনীয় আচরণ প্রকাশ পায় তার নাম সচ্চরিত্র। আর যদি স্বভাবগতভাবে মন্দ কর্মসমূহ প্রকাশ পায় তার নাম মন্দ চরিত্র (আল-আখলাকুল ফাজেলা, পৃ: ৩১)
মানুষের দু-এক দিনের আচরণ তার স্বভাব বা চরিত্র হতে পারে না। বরং সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র তখনই বলা হবে যখন এগুলো স্বভাবগতভাবে প্রকাশ পাবে। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ বিন সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা বলি, এটি (সচ্চরিত্র বা মন্দ চরিত্র) একটি বদ্ধমূল বা স্থায়ী অবস্থা। যে ব্যক্তি অনিচ্ছাকৃতভাবে সম্পদ ব্যয় করে তাকে দানশীল বলা যাবে না। কারণ এটি তার নিজস্ব স্বভাবে নেই। অনুরূপভাবে কেউ রাগের সময় কষ্ট করে চুপ করে থাকার ভান করলে তাকেও ধৈর্যশীল বলা যাবে না (আল-আখলাকুল ফাজেলা, পৃ: ৩১)। মোট কথা, স্বভাবগত উত্তম ও প্রশংসনীয় কর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে হাসানা। আর স্বভাবগত মন্দকর্ম সমষ্টির নাম আখলাকে সায়্যিয়াহ।

আখলাকে হাসানার প্রতি শরিয়ত যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। ইনজেকশনের মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগ করলে যেমন তা সহজেই শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যায়, তেমন আখলাকে হাসানা নামের সজীব বৃক্ষটির মজবুত পরশে মানবজীবনের প্রতিটি পর্ব হয়ে ওঠে ক্লেশমুক্ত, নির্ঝঞ্ঝাট ও পরিচ্ছন্ন। তাই উভয় জাহানে সফলতা লাভের মানদণ্ড নিরূপণ করা হয়েছে আখলাকে হাসানাকে। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তিকে সর্বোত্তম মানুষ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার চরিত্র সবচেয়ে ভালো।’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৮৫৪, ৯/১৬৮) তিনি বলেন, ‘কিয়ামতের দিন মুমিনের দাঁড়িপাল্লায় সর্বাপেক্ষা ভারী যে জিনিসটি রাখা হবে তা হচ্ছে উত্তম চরিত্র।’ (তিরমিজি হা/২০০২, আবূ দাঊদ হা/৪৭৯৯) আবু দারদা রা: বলেন, রাসূল সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘মুমিনের মিজানের পাল্লায় সচ্চরিত্র অপেক্ষা ভারী কোনো কিছুই রাখা হবে না। সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি সর্বদা (দিনে) সিয়াম পালনকারী ও (রাতে) সালাত আদায়কারীর ন্যায়’ (তিরমিজি হা/২০০৩, সনদ সহিহ; আবূ দাউদ হা/৪৭৯৮) দিনভর রোজা রেখে, রাতভর নামাজ আদায় করে কোনো ব্যক্তি যে নেকী পাবেন, সচ্চরিত্রবান ব্যক্তি তার সচ্চরিত্রের কারণে সে পরিমাণ নেকীর ভাগীদার হবেন। রাসূল সা: বলেন, ‘যে তার চরিত্রকে সুন্দর করেছে, আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য জামিন হবো।’ (আবু দাঊদ, হা/৪৮০০, সনদ সহিহ)
আবূ হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ঈমানের দিক দিয়ে সর্বাধিক কামিল সে ব্যক্তি, যার চরিত্র সর্বোত্তম। তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের সাথে সর্বোত্তম আচরণকারী।’ (তিরমিজি হা/১১৬২; আবূ দাঊদ হা/৪৬৮২) আবূ হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো কোন জিনিস মানুষকে বেশি জান্নাতে প্রবেশ করাবে? তিনি বলেন, আল্লাহভীতি ও সচ্চরিত্র। আবারো জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন জিনিস বেশি জাহান্নামে নিয়ে যাবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থান।’ (তাহক্বীক্ব তিরমিজি হা/২০০৪, সনদ হাসান) রাসূল সা: বলেন, সৎ কাজ হলো উত্তম স্বভাব। আর পাপ কাজ হলো, যে কাজ তোমার অন্তরে সন্দেহের সৃষ্টি করে। তুমি ওই কাজটি জনসমাজে প্রকাশ পাওয়াটা অপছন্দ করো (মিশকাত হা/৪৮৫২, ৯/১৬৭)
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার স্বভাব-চরিত্র সর্বোত্তম সে আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আর কিয়ামত দিবসেও সে আমার কাছাকাছি অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি হা/২০১৮, সনদ সহিহ) এমন আশাব্যঞ্জক হাদিস গভীরভাবে পড়লে নিশ্চয়ই তাকওয়াশীল হৃদয় উত্তম চরিত্র অর্জনে উদ্বুদ্ধ হবে।
রাসূল সা: ছিলেন সচ্চরিত্রের মূর্তিমান আদর্শ। তাঁর চরিত্রের প্রশংসায় আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা আল ক্বলম: ৪) তিনিও তার চরিত্রকে আরো সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার গঠন সুন্দর করেছ, সুতরাং আমার চরিত্রকে সুন্দর করো। (আহমাদ, মিশকাত হা/৫০৯৯, মিশকাত হা/৪৮৭২, ৯/১৭৩) সুতরাং সচ্চরিত্র মানবজীবনের জন্য কতটা প্রয়োজন ও গুরুত্বপূর্ণ, তা এই হাদিসগুলো থেকে সহজেই অনুমেয়।

রাসূলুল্লাহ সা: অন্যত্র বলেন, আমি কি তোমাদের সংবাদ দেবো না, যার ওপর জাহান্নাম হারাম আর জাহান্নাম যার জন্য হারাম? তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার মেজাজ নরম, কোমল স্বভাব, মানুষের সাথে মিশুক এবং সহজ-সরল। (আহমাদ, তিরমিজি, মিশকাত হা/৫০৮৪)
উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে আমরা সচ্চরিত্রের ফজিলত জানতে পেরেছি। সচ্চরিত্রের কারণে একজন মানুষকে সর্বোত্তম ঘোষণা করা হয়েছে। বিভীষিকাময় কিয়ামতকালে আল্লাহ যখন চূড়ান্ত হিসাব-নিকাশ চুকাতে মানুষের আমল মিজানের পাল্লায় তুলবেন, তখন সচ্চরিত্র সবচেয়ে বেশি ভারী হবে। ব্যক্তির উত্তম-ভালো স্বভাবগুলো তার দুর্দিনে কতটা ফলদায়ক হবে, তা সে কল্পনাও করতে পারবে না। সচ্চরিত্রের জন্য সে ‘ছাহেবুছ সাওম’ অর্থাৎ সারা বছর ছিয়াম পালনকারী ও ‘ছাহেবুছ সালাত’ অর্থাৎ সারা রাত ছালাত আদায়কারীর ন্যায় ছাওয়াব পাবে। হাদিসে সচ্চরিত্রের জন্য এত এত নেকি ও মর্যাদা ঘোষণা করাতে সচ্চরিত্রের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তা ফুটে উঠেছে। বস্তুত সচ্চরিত্র সামাজিক শৃঙ্খলার হাতিয়ার। এটি ব্যতীত সুখ-শান্তির কল্পনা অবান্তর। সচ্চরিত্র অর্জনে আমাদের অনুপ্রাণিত হওয়া, প্রচেষ্টা চালানো একান্ত কর্তব্য।
শরিয়াত বিভিন্ন ফজিলতের ঘোষণা দিয়ে যেমন আখলাকে হাসানা অর্জনে উৎসাহিত করেছে ও তাকিদ দিয়েছে, তেমনি বিভিন্ন মন্দ পরিণতি ও শাস্তির হুঁশিয়ার করে অপছন্দনীয় ও নিন্দিত স্বভাব বর্জনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ব্যক্তির মন্দ স্বভাব তার জান্নাত হারানোর অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে যাবে না।’ (আবূ দাঊদ হা/৪৮০১, সনদ সহিহ মন্দ স্বভাববিশিষ্ট ব্যক্তির জন্য তো এই একটি হাদিসই যথেষ্ট যে, তার লালিত মন্দ স্বভাব জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম বাধা হবে।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে- আবূ হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? সাহাবিরা বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-কড়ি ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সেই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে সালাত, সিয়াম, জাকাত আদায় করে আসবে এবং সাথে সাথে সেই লোকেরাও আসবে, কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল-সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই হকদারকে (সালাত-সিয়াম নিয়ে আগমনকারী) তার নেকি দেয়া হবে। আবার ওই হকদারকেও (পূর্বোক্ত হকদার যার উপর জুলুম করেছিল) তার নেকি দেয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার (প্রথমত ব্যক্তির) নেকি শেষ হয়ে যায় তবে তাদের (পরের হকদারের) গুনাহগুলো ওই ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া হবে। এরপর তাকে (প্রথম হকদারকে) জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯০০, ৯/১৮৪)
শেষাংশ আগামীকাল


আরো সংবাদ



premium cement