১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মরিচামুক্ত বিবেকই মর্যাদাসম্পন্ন

-


সুস্থ বিবেক মানে তাকওয়া। যেই তাকওয়া মানবতার সব প্রকার কল্যাণ ও মর্যাদার প্রতীক। তাকওয়ার ওপর ভিত্তি করেই নিরূপিত হয় মানুষের মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ তাকওয়ার ওপর নির্ভরশীল। সামাজিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের জন্য তাকওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাকওয়াহীন ব্যক্তি সে যেই হোন না কেন, তাকে সম্মানিত ব্যক্তি বলা যাবে না। যদিও পৃথিবীর মানুষগুলো বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার ভিত্তিতে মর্যাদার বৃত্ত গড়ে তুলেছে; কিন্তু তাকওয়ার কাছে তা একান্তই মূল্যহীন। বংশ, ভাষা, বর্ণ ও দেশ- এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি, তাই বলে এগুলো কোনো মর্যাদার মানদণ্ড বা মাপকাঠি নয়; বরং এগুলো আল্লাহ দিয়েছেন যাতে মানুষ পরস্পরকে চিনতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক সম্মানিত, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব কিছু জানেন ও খবর রাখেন।’ (সূরা আল হুজরাত-১৩) অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি মুত্তাকি তিনিই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ও মর্যাদাবান।

পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর মতো মুসলমানরাও যে দিন থেকে তাকওয়াকে বাদ দিয়ে অন্যান্য বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে মানুষের মর্যাদা দিতে শুরু করেছে, সে দিন থেকে তাদের কপালও পুড়তে শুরু করেছে। রাসূল সা:-এর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া ‘বুনিয়ানুম মারচুচ’ ‘সুদৃঢ় প্রাচীর’-এর ফাটল বা ভাঙনও সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। বিজাতীয়দের মতো মুসলমানদের মধ্যেও আজ খান্দান, গোত্র ও গোষ্ঠীগত বিভেদের পাহাড় পরিলক্ষিত হয়। আর এরই ফলে তাদের মধ্যেও অহঙ্কার, ঘৃণা, তাচ্ছিল্য, বিদ্বেষ ও অবমাননা এবং জুলুম ও নির্যাতন দানা বেঁধে উঠেছে। অথচ এটি ছিল ইহুদি-খ্রিষ্টান ও পৌত্তলিকদের চরিত্র। জাতীয়তার ভিত্তিতে ইহুদিরা মনে করেছে তারাই আল্লাহর মনোনীত সৃষ্টি। এ জন্য পৃথিবীর সব অ-ইসরাইলি অধিকার ও মর্যাদার দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টানরা বলেছে ঈসা আল্লাহর পুত্র (নাউজুুবিল্লাহ), সুতরাং তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। হিন্দুজাতি পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠতর মনে করা ছাড়াও নিজেদের মধ্যেও অসংখ্য কঠিন ভেদনীতি চালু করে রেখেছে। তারা বর্ণাশ্রমের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শূদ্রদের লাঞ্ছনার গভীর খাদে নিক্ষেপ করেছে। তাদের ঘরে অন্য ধর্মের কেউ ঢুকে পড়লে সেটিকে ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে থাকে।

আমাদের ভালো করে মনে রাখা প্রয়োজন, খান্দান, বংশ, গোত্র ও গোষ্ঠী, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তা- এগুলো অহঙ্কারেরও হোতা। আরো মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর সর্বপ্রথম যে গুনাহের খাতায় নাম লিখিয়েছিল সে হলো- শয়তান এবং প্রথম যে গুনাহটি আল্লাহর হুকুমকে মানতে অবাধ্য করেছিল সেটি হলো অহঙ্কার। আর অহঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল জন্মগত শ্রেষ্ঠত্বকে ভর করে। সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, আদমকে সেজদা করো। সবাই সেজদা করল, কেবল ইবলিশ করল না। সে অস্বীকার ও অহঙ্কার করল। সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ অন্যত্র বলা হয়েছে- সে বলল, আমি আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি। অর্থাৎ তার মধ্যে বর্ণবাদের অহঙ্কার ও বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। ফলে সে-ই পৃথিবীর প্রথম নিকৃষ্ট কীট, যে আল্লাহর আদেশকে অমান্য করল এবং তাঁর লানত নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে বেঁচে থাকতে হবে।

কিন্তু ইসলাম এসব নীতিকে কখনোই সমর্থন করে না। মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বুনিয়াদ হলো তাকওয়া। জন্মগতভাবে সব মানুষ সমান। কেননা, তাদের মূল উৎস এক। একমাত্র পুরুষ এবং একমাত্র নারী থেকে গোটা জাতি অস্তিত্ব লাভ করেছে। তাদের সবার সৃষ্টিকর্তা এক, তাদের সৃষ্টির উপাদান ও নিয়ম-পদ্ধতি এক এবং তাদের সবার বংশধারা একই পিতা-মাতা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। সুতরাং মানুষ যেখানেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সেটি দেখার বিষয় নয়; বরং যে মূল জিনিসের ভিত্তিতে একজন অপর জনের ওপর মর্যাদা লাভ করতে পারে তা হচ্ছে এই যে, সে অন্য সবার তুলনায় অধিক আল্লাহভীরু, মন্দ ও অকল্যাণ থেকে দূরে অবস্থানকারী এবং নেকি ও পবিত্রতার পথ অনুগমনকারী। রাসূল সা: মক্কা বিজয়ের সময় কাবা তাওয়াফের পর বক্তৃতা করেছিলেন তাতে তিনি বলেন, ‘সব প্রশংসা সেই আল্লাহর যিনি তোমাদের থেকে জাহিলিয়াতের দোষ-ত্রুটি ও অহঙ্কার দূর করে দিয়েছেন। হে লোকেরা! সব মানুষ দু’ভাগে বিভক্ত। এক, নেক আমলদার ও পরহেজগার- যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদার অধিকারী। দুই, পাপী ও দুরাচার যারা আল্লাহর দৃষ্টিতে নিকৃষ্ট। অন্যথায় সব মানুষই আদমের সন্তান। আর আদম মাটির সৃষ্টি।’ (তিরমিজি) অন্য এক হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চেহারা-আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজকর্ম দেখেন।’ (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)

ইসলাম সাম্য-সংহতির অনুপম শিক্ষা শুধু ব্যক্তি চরিত্রে নয়; বরং মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবনসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাস্তবায়ন করেছে। আজ থেকে চৌদ্দ শ’ বছর আগে রাসূল সা: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদিনা নামক ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করুন। রাসূলুল্লাহ সা: এমন এক সমাজ কায়েম করেছিলেন, যেখানে বর্ণ, বংশ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার কোনো ভেদাভেদ ছিল না, যেখানে উঁচু-নিচু এবং বিভেদ ও পক্ষপাতিত্বের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সে সমাজব্যবস্থায় হজরত বেলাল রা: এবং হজরত ওমর রা:-এর মধ্যে যেমন কোনো পার্থক্য ছিল না, তেমনি আলী রা: ও আনাস-জায়েদ ইবনে সাবেত রা:-এর মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। থাকলেও সেটি তাকওয়ার ভিত্তিতেই নিরূপিত হতো। একবার হজরত ওমর রা: হজরত বেলাল রা:-কে ধমক দিয়ে কথা বললে রাসূল সা: অসন্তুষ্ট হন এবং বললেন, ‘হে ওমর! তোমার কি এখনো বংশীয় গৌরব রয়েছে?’ ওমর রা: লজ্জিত হলেন। তিনি নিজের সব আভিজাত্যের অহংবোধকে ধ্বংস করে দেন। মানবিক সাম্য ও ঐক্য সে সমাজকে এমনি ফুলে-ফলে সুশোভিত করেছিল, যা পৃথিবীর আর কোনো ধর্ম বা ব্যবস্থায় সামান্যতমও পরিলক্ষিত হয় না।

প্রকৃতপক্ষে আমরা মুত্তাকি হতে পারছি না বিধায় ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো বিকল্প পথে মর্যাদার সন্ধান করে ফিরছি। আর এ জন্য আমরাও বংশ, বর্ণ, ভাষা, দেশ ও জাতীয়তার ভিত্তিতে মর্যাদার বৃত্ত গড়ে তুলেছি। এ নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যেই আমাদের সামজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে আমাদের চিন্তাচেতনাকে নিয়ে যেতে পারছি না বিধায় উন্নয়নের বাধাগুলোও টপকানো আমাদের জন্য দুষ্কর হয়েছে। ফলে সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আজ্ঞাবহ সাজতে বাধ্য হচ্ছি। অথচ তাকওয়ার মতো মানবীয় উন্নততর গুণের অধিকারীদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সব কল্যাণের ভাণ্ডার সংরক্ষিত রয়েছে বলে আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। সত্যিই মুসলিম দেশগুলোর ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান অধিকতর এমন উত্তম স্থানে রয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিম দেশের মাটির নিচে আল্লাহ তায়ালা অফুরন্ত নিয়ামতের ভাণ্ডার মজুদ করে রেখেছেন। আমাদের গোলামি ও পরাজিত মানসিকতার কারণে আল্লাহ দান করছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের বর্তমান মুসলিম দেশগুলোর সরকারপ্রধানরা আল্লাহর ভয়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী ইহুদি-খ্রিষ্টান গোষ্ঠীকেই বেশি ভয় করেন। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘লোকালয়ের মানুষগুলো যদি ঈমান আনত ও তাকওয়া বা ভয় করত তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম; কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। সুতরাং তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সূরা আরাফ-৯৬)

তাকওয়া এমন একটি শক্তি, এমন একটি গুণ, যার ওপর ভিত্তি করে মানুষ হক ও বাতিল, ভুল ও সঠিক, ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। যিনি শুধু আল্লাহর ভয়ে সেটিকেই সত্য হিসেবে মেনে নেন যা তিনি নাজিল করেছেন। তিনি সেটিকেই সঠিক মনে করেন, যাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়। যে কাজ বা প্রথা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরো অসংখ্য ক্ষতির সৃষ্টি করে, যেসব কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, সেটিই মানুষের জন্য ক্ষতিকারক। এ ধরনের ক্ষতিকর কাজ থেকে আত্মরক্ষা করা খুবই জরুরি। আত্মরক্ষার জন্য আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আত্মাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য দরকার বাস্তব ট্রেনিং।
লেখক : প্রবন্ধকার

 

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement