১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জাকাতের ফজিলত

-

জাকাত ইসলামের অন্যতম মৌল ভিত্তি। পবিত্র কুরআনের বহু জায়গায় নামাজ কায়েমের সাথে সাথে জাকাত আদায়ের আদেশ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমরা নামাজ কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো।’ (সূরা বাকারা-৮৩) হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘ইসলামের মৌলিক ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের উপর- ১. আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। হজরত মুহাম্মদ সা: আল্লাহর বান্দা ও রাসূল- এই সাক্ষ্য দেয়া; ২. নামাজ কায়েম করা; ৩. জাকাত প্রদান করা; ৪. হজ করা ও ৫. রমজানের রোজা রাখা।’ (বুখারি-৮, মুসলিম-১৬)
প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন মুসলমান নিসাব পরিমাণ অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা অথবা এর মূল্য সমপরিমাণ অর্থের মালিক হলে এবং এই নিসাব এক বছর স্থায়ী হলে ৪০ ভাগের এক ভাগ তথা শতকরা আড়াই ভাগ হারে সমুদয় সম্পদের জাকাত ফরজ হয়। কুরআনে বর্ণিত আটটি খাতে জাকাতের অর্থ দিতে হয়।
জাকাত আদায়ে রয়েছে পরকালীন অশেষ সওয়াব। আর দুনিয়াবি বহু উপকার ও বরকত- ১. জাকাত দিলে জাকাতদাতার অন্তর ও সম্পদ পবিত্র হয়। দুনিয়ার লোভ, অর্থের মোহ থেকে অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়। ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিলে বাকি ৩৯ ভাগ সম্পদ পবিত্র হয়ে যায়। যেমনটি পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘(হে নবী!) আপনি তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ করুন, যা দিয়ে আপনি তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবেন।’ (সূরা তাওবা-১০৩) তাফসিরে বগভি ও তাফসিরে তবারিতে কোনো কোনো তাফসিরকারকের মতে, আয়াতে ‘তুজাক্কিহিম বিহা’-এর অর্থ তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করে দেবেন। হাদিসেও জাকাতকে মালের ময়লা বলা হয়েছে। অতএব জাকাত দিলেই কেবল সম্পদ পবিত্র হয়। ২. জাকাতে অর্থনৈতিক জীবনে বরকত হয়। সম্পদ বেড়ে যায়। বাহ্যত মনে হতে পারে যে, জাকাত দিলে তো সম্পদের একটি অংশ কমে গেল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। জাকাত সম্পদ কমায় না; বরং সমৃদ্ধি ঘটায়। বরকত আনে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন- ‘আল্লাহ তায়ালা সুদকে মিটিয়ে দেন এবং জাকাত, দান-সদকাকে বৃদ্ধি করেন।’ (সূরা বাকারা-২৭৬) জাকাত দিলে সম্পদ বাড়বে এটিই আল্লাহর ওয়াদা। ৩. জাকাত আদায়ের মাধ্যমে অনিষ্টতা দূর হয়। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে- যে তার মালের জাকাত দিলো, সে মালের অনিষ্টতা থেকে বাঁচল। (সহিহুত-তারগিব-৭৪৩)
৪. তাছাড়া নিয়মিত জাকাত আদায়ের মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। জাকাত দেয়া আল্লাহর হুকুম। আল্লাহ তার হুকুম পালনকারী বান্দাকে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। আর হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, ফেরেশতাদের মধ্যে, আসমানবাসীদের মধ্যে এমনকি পৃথিবীবাসীর মধ্যেও তার ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করে দেন।’ (বুখারি : ৩২০৯, ৬০৪০, মুসলিম-২৬৩৭)
আমাদের সামাজিক কাঠামোতেও দেখা যায়, যারা গরিবদের জাকাত দেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে ডোনেশন করেন, তাদের প্রতি সবার কোমল স্বচ্ছ মানসিকতা তৈরি হয়। মানুষ তাদের ভালোবাসে। সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি ব্যতীত সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধিকে টার্গেট করে জাকাত দেয়া যাবে না। এমন জাকাতদাতার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ধমক; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জাকাত আদায় করলে এমনিতেই মান-মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
পক্ষান্তরে জাকাত না দেয়ার রয়েছে ভয়াবহ পরিণতি। দুনিয়াতে বেবরকতি। আখিরাতে কঠিন শাস্তি। এক হাদিসে এসেছে, ‘যারা সম্পদের জাকাত আদায় করে না, তাদের সম্পদকে কিয়ামতের দিন বিষধর সাপের আকৃতি দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। যেই সাপের চোখের উপর দু’টি কালো দাগ থাকবে। (এরকম সাপ ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে।) এবং (বিষের তীব্রতার কারণে) মাথা টাক হবে। সেই সাপ তাকে দংশন করবে আর বলতে থাকবে, আমি তোমার মাল। আমি তোমার সঞ্চিত সম্পদ।’ (বুখারি-১৪০৩)
পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘যে সোনা-রুপা জমা করে রাখে। (জাকাত দেয় না।) আল্লাহর রাস্তায় তা খরচ করে না তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেদিন সেগুলোকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে। এরপর তা দ্বারা তাদের কপাল ও পিঠে ছেকা দেয়া হবে। (আর বলা হবে) এটি হলো তা, যা তোমরা তোমাদের জন্য সঞ্চয় করেছিলে। সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ আস্বাদন করো।’ (সূরা তাওবা : ৩৪-৩৫) পবিত্র কুরআনে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, ‘(ভাবার্থ) কারুনকে তিনি প্রচুর সম্পদ দিয়েছিলেন, যার চাবি একদল শক্তিশালী লোকের জন্য বহন করা দুঃসাধ্য ছিল। কারুনকে এ সম্পদের একটি অংশ দ্বারা সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কারুন এ সম্পদ আল্লাহর হুকুম মতো ব্যয় না করে গর্ব করেছিল। বলেছিল, এগুলো আমার জ্ঞান ও যোগ্যতা বলে আমাকে দেয়া হয়েছে। তার গর্ব ও অহঙ্কারের কারণে তাকে তার সম্পদসহ মাটিতে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে।’ (সূরা কাসাস : ৭৬-৮৩)
লেখক : বিশিষ্ট আলেম ও প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement