০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩০, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫ হিজরি
`

দম্ভ অহঙ্কার ও তার পরিণতি

-


(পঞ্চমাংশ)
দাম্ভিক ও অভিশপ্ত কারুনের নিদারুণ স্বকরুণ ও অভূতপূর্ব পরিণতি এবং তার কারণসমূহ : আনুষঙ্গিক বিষয়াদিসহ চতুর্থাংশে আংশিক উল্লেখ করা হয়েছিল যার অবশিষ্ট অংশগুলো অত্র পঞ্চমাংশে বর্ণিত হলো তাফসিরে নুরুল কুরআন অবলম্বনে।
কারুন বলল, আমার গুণে জ্ঞানে অর্জন করেছি সব কিছু, এখানে আল্লাহ পাকের দয়ার কথা যা তোমরা বলছ তা ঠিক নয় (নাউজুবিল্লাহ মিনজালিক)। আমার সম্পদ, সম্মান, নেতৃত্ব যা কিছু রয়েছে, সবই আমার যোগ্যতার ফলশ্রুতি, কোনো দাতার দান নয়।
কোনো তাফসিরকারক বলেছেন, হজরত মূসা আ: কারুনের নিকট জাকাত আদায়ের জন্য লোক পাঠিয়ে ছিলেন, কিন্তু কারুন শুধু যে জাকাত আদায়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাই নয়; বরং অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে বলে যে, এত দিন অনেক কিছু সহ্য করেছি আর নয়, এখন দেখি মূসা আমাদের ধন-সম্পত্তিতেও অংশীদার হতে চায়। তোমরা কি তা মেনে নিতে প্রস্তুত রয়েছ? তখন কিছু লোক বলল, না। অন্যরা নীরব রইল।

এভাবে কারুন এক দিকে দারিদ্র্য-পীড়িত মানুষকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়, অন্য দিকে সে আল্লাহ পাকের প্রদত্ত নেয়ামতকে অস্বীকার করে এবং অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। অথচ কারুন যে গুণ-জ্ঞানের কথা বলছে, তা-ও আল্লাহ পাকেরই দান, আর যে অক্লান্ত সাধনা সে করেছে, তাও আল্লাহ পাকের তাওফিকেই সম্ভব হয়েছে। শুধু তাই নয়; বরং কারুনের অস্তিত্ব বা তার জীবন ও জীবনের যথাসর্বস্ব সবই তো এক আল্লাহ পাকের দান, অতএব যোগ্যতার বড়াই করার কোনো যুক্তি তার আছে কি? যদি আল্লাহ পাক তাকে সৃষ্টি না করতেন বা যে যোগ্যতার বড়াই সে করছে সে যোগ্যতা দান না করতেন, তবে কি সে এত সম্পদ এবং মর্যাদার অধিকারী হতো? অতএব, তার এ দাবি যে ‘অর্থ সম্পদ উপার্জনের নিগূঢ় তত্ত্বটি আমার জানা আছে কথাটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কিন্তু সম্পদের অধিকারী হবার পর সে সব যুক্তির কথা ভুলে গেছে এবং আল্লাহ পাকের অবাধ্য অকৃতজ্ঞ হয়েছে। তাই আল্লাহ পাক কারুনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার প্রতি-উত্তরে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে ইরশাদ করেছেন- ‘সে কি জানে না যে আল্লাহ পাক তার পূর্বে এমন বহু মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করেছেন, যারা তার চেয়ে অধিকতর সম্পদ ও শক্তির অধিকারী ছিল।’

অর্থাৎ ইতঃপূর্বে আল্লাহ পাক অনেক অবাধ্য, অকৃতজ্ঞ জাতিকে ধ্বংস করেছেন, যারা ধনবলে বাহুবলে তার চেয়ে অনেক বেশি বলীয়ান ছিল, কিন্তু তাদের ধনবল বা বাহুবল আল্লাহ পাকের আজাব থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারেনি। পূর্ববর্তী ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর ঘটনা থেকে কারুনের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত ছিল। আল্লাহ পাকই আদ জাতিকে ধ্বংস করেছেন, সামুদ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করেছেন, শাদ্দাদ এবনে আদ অত্যন্ত বড় ক্ষমতাধর রাজা ছিল, তাকেও ধ্বংস করেছেন, তাদের অর্থ-সম্পদ অঢেল ছিল, কিন্তু তাদের জনবল এবং ধনবল তাদের কোনো উপকার করতে পারেনি।
কারুনকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা যে উপদেশ দিয়েছিল, তা সে গ্রহণ করেনি, এমনকি পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিগুলোর ধ্বংসের যে বিবরণ তাকে জানানো হয়েছিল, তা থেকেও সে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এমনি অবস্থায় সে তার দলবল নিয়ে মূল্যবান পোশাক পরিধান করে জনসমক্ষে বের হয়।
তাফসিরকারক মুজাহিদ রহ: বলেছেন, কারুন সাদা খচ্চরের ওপর আরোহণ করেছিল, খচ্চরের ওপর সোনালি রঙের জিন ছিল, চার হাজার লোক তার সাথে তার শান-শওকত প্রকাশার্থে বের হয়েছিল। তাদের সাথে ৩০০ বাঁদী ছিল। যারা দুনিয়ার লোভ-লালসায় কাতর ছিল, কারুনের শান-শওকত দেখে তাদের মন আকৃষ্ট হয়েছিল, তারা আক্ষেপ করে বলেছিল, যদি কারুনের মতো ধন-সম্পদ আমাদের হতো তবে আমরা কত ভাগ্যবান হতাম!

কারুন হজরত মূসা আ:-কে অত্যধিক হিংসা করত, এ জন্য সে তাকে জনসাধারণের সম্মুখে অপমানিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, সে একজন স্ত্রীলোককে বিরাট অঙ্কের অর্থ দিয়ে এ জন্য তৈরি করে যে সে যেন মজলিসের মধ্যে দাঁড়িয়ে হজরত মূসা আ:-এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়। কয়েক দিন পরই হজরত মূসা আ: জনসাধারণের উদ্দেশে যখন আল্লাহ পাকের বিধি-নিষেধ সম্পর্কে বক্তব্য রাখছিলেন, তিনি বলছিলেন, আল্লাহ পাকের হুকুম হলো কোনো বিবাহিত ব্যক্তি যদি ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তবে তাকে পাথর মেরে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। ঠিক ওই মুহূর্তে কারুনের নিয়োজিত এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, যদি তুমি এ অন্যায় করো তবে কি এ শাস্তি হবে? মূসা আ: বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। এরপর কারুনের লোকেরা সেই ভাড়া করা স্ত্রীলোকটিকে মজলিসে হাজির করল এবং উপস্থিত জনতার সম্মুখে স্ত্রীলোকটি বলে, মূসা স্বয়ং আমার সঙ্গে ব্যভিচার করেছে (নাউজুবিল্লাহি মিনজালিক), তখন হজরত মূসা আ: তাকে মিথ্যা অপবাদের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং আল্লাহ পাকের নামের শপথ দিয়ে বলেন, তুমি সত্য কথা বলো। এ সময় স্ত্রীলোকটির অন্তরে অত্যন্ত ভয়-ভীতির সৃষ্টি হয়, সে বলে হে মূসা! যখন আপনি আমাকে আল্লাহ পাকের নামের শপথ দিয়েছেন, তখন আমি সত্য কথা বলব। এরপর সে বলে, কারুন আমাকে অনেক অর্থ-সম্পদ দিয়েছে এবং বলেছে, আমি যেন আপনার বিরুদ্ধে এ অপবাদ দেই, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি পবিত্র, আর এ কথারও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি আল্লাহ পাকের রাসূল। এভাবে কারুনের ষড়যন্ত্রের রহস্য সর্ব সমক্ষে ফাঁস হয়ে যায়।

কারুনের ভয়াবহ পরিণতি : স্ত্রীলোকটির সত্য কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হজরত মূসা আ: আল্লাহ পাকের দরবারে সেজদা রত হন এবং ক্রন্দন রত অবস্থায় আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করতে থাকেন এবং বলেন, হে আল্লাহ! যদি আমি তোমার সত্য নবী হই, তবে কারুনের ওপর তোমার গজব নাজিল করো। তখন আল্লাহ পাকের তরফ থেকে ওহি নাজিল হলো, হে মূসা! আমি জমিনকে হুকুম দিয়েছি, তুমি কারুনের ব্যাপারে তাকে যে আদেশই দেবে সে যেন তা পালন করে। এরপর হজরত মূসা আ: জমিনকে আদেশ দিলেন- হে জমিন! কারুনকে ধরো, জমিন সাথে সাথে তাকে ধরে ফেলল এবং সে ভূগর্ভের দিকে ধসে যেতে লাগল, শুধু কারুনই নয়; তার প্রাসাদ এবং ধন-সম্পদসহ সে ধসে গেল। হাদিস শরিফে কারুন সম্পর্কে এ কথা উল্লেখ রয়েছে যে কেয়ামত পর্যন্ত সে এভাবে ধসে যেতে থাকবে।
উপরোক্ত আলোচনা এবং কারুনের পরিণতি হতে আমাদের শিক্ষণীয় আমরা যেন কখনোই দাম্ভিক বা অহঙ্কারী না হই এবং মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কাউকে হেয়প্রতিপন্ন না করি।
বস্তুত ফেরাউনের সলিল সমাধি হওয়া যেমন হজরত মূসা আ:-এর মোজেজা ছিল, ঠিক তেমনি কারুনের ভূগর্ভে ধসে যাওয়া ও হজরত মূসা আ:-এর মোজেজা ছিল।
হে আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে আশ্রয় দিন অভিশপ্ত দম্ভ বা অহঙ্কার হতে। আমীন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশ

 

 


আরো সংবাদ



premium cement