২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কাবার পথের মেহমান

-

(শেষাংশ)
এ ঘরের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে পিতা-পুত্র মিলে মহান আল্লাহর দরবারে আরো দোয়া করেছিলেন, যা আল্লাহ নিজের ভাষায় কুরআনে বলেছেন- ‘এবং স্মরণ করো, ইবরাহিম ও ইসমাঈল যখন এ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকালে দোয়া করছিলেন- পরওয়ারদিগার! আমাদের এ চেষ্টা কবুল করো, তুমি সবকিছু জানো এবং সবকিছু শুনতে পাও। পরওয়ারদিগার! তুমি আমাদের দু’জনকেই মুসলিম- অর্থাৎ তোমার অনুগত করো এবং আমাদের বংশাবলি থেকে এমন একটি জাতি তৈরি করো যারা একান্তভাবে তোমারই অনুগত হবে। আমাদেরকে তোমার ইবাদত করার পন্থা বলে দাও, আমাদের প্রতি ক্ষমার দৃষ্টি নিক্ষেপ করো, তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াময়। পরওয়ারদিগার! তুমি সে জাতির প্রতি তাদের মধ্য থেকে এমন একজন নবী পাঠাও যিনি তাদেরকে তোমার বাণী পড়ে শোনাবেন, তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেবেন এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবেন। নিশ্চয় তুমি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন এবং বিজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ : ১২৭-১২৯)
যে শিরক উচ্ছেদ ও মূর্তিপূজা বন্ধ করার সাধনা ও আন্দোলনে হজরত ইবরাহিম আ: ও ইসমাঈল আ: সারাটি জীবন অতিবাহিত করেছিলেন, কালের বিবর্তনে এ কাবাঘরে আবার ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা হয়। চার দিকে শিরক আর শিরক চলতে থাকে। লাত, মানাত, হুবাল, নসর, ইয়াগুস, উজ্জা, আসাফ, নায়েলা আরো অসংখ্য নামের মূর্তি তৈরি করে পূজা করত। হজকে তারা তীর্থযাত্রার অনুরূপ বানিয়ে তাওহিদ প্রচারের কেন্দ্রস্থল কাবাঘর থেকে মূর্তিপূজার প্রচার শুরু করেছিল এবং পূজারিদের সবধরনের কলাকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত লোকদের কাছে থেকে নজর-নিয়াজ আদায় করত। হজের অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোকে বিকৃতরূপ দিয়ে পালন করত। এভাবে ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাঈল আ: যে মহান কাজ শুরু করেছিলেন এবং যে উদ্দেশ্যে তারা হজপ্রথার প্রচলন করেছিলেন, তা সবই বিনষ্ট হয়ে যায়।
অবশেষে হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়ারই ফসল মানবতার বন্ধু হজরত মুহাম্মাদ সা: মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে শিরকের মূলোৎপাটন করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের পিতার হারানো হজের নিদর্শনগুলো পুনরুদ্ধার করেন।
হজের প্রতিটি পদে পদে আল্লাহর স্মরণ- আল্লাহর নামের জিকির, সালাত, ইবাদত ও কোরবানি এবং কাবাঘরের প্রদক্ষিণ। আর এখানে একটি মাত্র আওয়াজই মুখরিত হয়ে ওঠে, হারাম শরিফের প্রাচীর আর পাহাড়ের চড়াই-উতরাইয়ের প্রতিটি পথে উচ্চারিত হয়- ‘লাব্বায়িক আল্লাহুম্মা লাব্বায়িক, লাব্বায়িকা লা শারিকা লাকা লাব্বায়িক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিয়মাতা লাকা ওয়াল মুলক লা শারিকা লাক’ অর্থাৎ- ‘হে প্রভু তোমার ডাকে আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। সব প্রশংসা একমাত্র তোমার জন্য। সব নিয়ামত তোমারই দান, রাজত্ব আর প্রভুত্ব সবই তোমার। তুমি একক- কেউই তোমার শরিক নেই।’
কাবার পথের যাত্রীরা কোথায় হাজিরা দিতে যাচ্ছেন আর হাজিরা দিতে গিয়ে কী বলছেন তা অবশ্যই গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা করতে হবে। এমনিভাবে হজের প্রতিটি অনুষ্ঠান পালন করার সময় কী করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে তা অনুধাবন করতে হবে। প্রকৃতপক্ষেই কি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনকে শিরকমুক্ত করতে পেরেছি এবং আল্লাহর কাছে নিজেকে পূর্ণাঙ্গ মুসলিম হিসেবে পেশ করতে পেরেছি? আত্মজিজ্ঞাসার জবাব যদি না বোধক হয় তবে আমরা লাব্বায়িক বলে এ বিশ্ব সম্মেলনকেন্দ্রে হাজিরা দেবো ঠিকই কিন্তু আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। যেমন প্রাণহীন সালাত মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারছে না, প্রাণহীন রোজা তাকওয়ার গুণ সৃষ্টি করতে পারছে না ও জাকাত আমাদেরকে পবিত্র করতে পারছে না। তেমনিভাবে প্রাণহীন হজ আল্লাহর হাজিরা খাতায় অনুপস্থিতিই লেখা হবে। তাই কাবার পথের যাত্রীরা তাদের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন-
শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে : শিরক একটি জুলুম। শিরকের গুনাহ আল্লাহ মাফ করবেন না। শিরক সব নেক আমলকে ধ্বংস করে দেয়। এ শিরক বর্তমানে বিভিন্ন রূপ ধারণ করে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বাবস্থায় এ শিরককে পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ শিরকমুক্ত জীবন ও সমাজ গঠন করার জন্যই হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত মুহাম্মাদ সা: আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তা ছাড়া মহান আল্লাহর সম্মানিত মেহমান হিসেবে তালবিয়া পাঠে বলা হচ্ছে- ‘আমি উপস্থিত। আমি এসেছি, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি তোমারই কাছে এসেছি। তুমি একক- কেউই তোমার শরিক নেই।’ এ কথাটিকে বাস্তব জীবনে রূপায়ণ করতে হবে।
দ্বিমুখী নীতি পরিহার করে,পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে : জন্মসূত্রে মুসলমান নয়; বরং একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হতে হবে, আমল সুন্নাহ অনুযায়ী হতে হবে। শুধু পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে আল্লাহকে প্রভু হিসেবে স্বীকার করা হলো; কিন্তু জীবনের বিশাল অংশকে মানুষের তৈরি আদর্শের হাতে সোপর্দ করলে তিনি মুসলিম নন বরং একজন খাঁটি মুনাফিক। প্রতি সালাতেই অসংখ্যবার বলা হচ্ছে- ‘আমরা তোমারই গোলামি করি আর তোমারই সাহায্য চাই।’ অথচ সালাতের বাইরে তার বিপরীত কাজ করা হচ্ছে। এ এক মিথ্যাচার ছাড়া কী হতে পারে? আর এ মিথ্যাচারকে বিশ্ব সম্মেলনকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তালবিয়া পাঠে নিরেট মিথ্যাচার করা হয়। এ ধরনের দ্বিমুখী নীতি বা মুনাফেকি আচরণ আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাগ করতে হবে।
হজ চেতনার অনুধাবন : হজের অনুষ্ঠানগুলো ঐতিহাসিক চেতনাকে সামনে রেখে পালন করতে হবে। আর এ চেতনাকে হজরত ইবরাহিম আ: ও হজরত ইসমাঈল আ:-এর মতো শিরক উচ্ছেদে এবং মানুষকে অসংখ্য মিথ্যা রবের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার আপসহীন সংগ্রামের কাজে ব্যবহার করতে হবে এবং এ সংগ্রাম নিজ নিজ এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই হজের সার্থকতা ও সুফল পাওয়া যাবে এবং আল্লাহর হাজিরা খাতায় উপস্থিতি নিশ্চিত করা যাবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

 


আরো সংবাদ



premium cement