২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দ্বীনি কাজে মধ্যম পন্থা অবলম্বন

-

দ্বীনি কাজে অতিরঞ্জন ও অতি শৈথিল্য প্রদর্শন কোনোটিই ভালো নয়; বরং মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাই উত্তম। পবিত্র কুরআন ও হাদিস দিয়ে তা প্রতীয়মান হয়। মহানবী সা: একদা হজরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রা:-কে বলেন, হে আবদুল্লাহ! আমি কি খবর পাইনি যে, তুমি দিনে রোজা রাখো ও সারা রাত সালাত আদায় করো। আবদুল্লাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, আমি তাই করি। তখন মহানবী সা: বলেন, এরূপ করো না। কখনো রোজা রাখবে, কখনো ভঙ্গ করবে। রাতে সালাত পড়বে আবার নিদ্রা যাবে। কেননা, তোমার ওপর তোমার দেহের হক আছে, তোমার চোখের হক আছে, স্ত্রীর হক আছে। যে ব্যক্তি সারা জীবন রোজা রাখল সে মূলত রোজাই রাখেনি। প্রতি সাসে তিন দিন রোজা রাখা সারা বছরের রোজা রাখার সমতুল্য। অতএব প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫-এ তিন দিন রোজা রাখবে এবং প্রতি মাসে মাসে একবার কুরআন মজিদ খতম করবে। হজরত আবদুল্লাহ রা: বলেন, আমি এর চেয়েও অধিক করার সামর্থ্য রাখি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তবে তুমি হজরত দাউদ আ:-এর মতো রোজা রাখো, তা উত্তম রোজা। তা হলো এক দিন রোজা রাখা এবং এক দিন ভঙ্গ করা। আর সপ্তাহে একবার কুরআন খতম করা, এর অতিরিক্ত কিছু করতে যেও না। (সহিহ বুখারি, ইবনে মাজাহ)
হজরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা: বলেন, আমি বিদায় হজের বছর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন প্রিয় নবী সা: আমাকে দেখতে আসেন, আমি তখন আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমার রোগের অবস্থা যে প্রচণ্ড পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আপনিই দেখতে পাচ্ছেন। আমার অনেক সম্পদ আছে, অথচ আমার একমাত্র কন্যা ব্যতীত আর কোনো উত্তরাধিকারী নেই। আমি কি আমার সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ দান করতে পারব? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, না- আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেন, না! আমি আরজ করলাম, তবে এক-ততৃীয়াংশ? তিনি বললেন, হ্যাঁ! এক-তৃতীয়াংশ দান করতে পারো, তবে তাও অনেক। তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদেরকে অন্যের কাছে হাত পাতার মতো অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে সচ্ছল অবস্থায় রেখে যাওয়াই উত্তম।’ (সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সা: আরো বলেন, তোমরা স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী আমল করো। তোমরা আমলে বিরক্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ বিরক্ত হন না।’ (সহিহ বুখারি, মিশকাত)
হজরত হুজাইফা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মানুষের জন্য সুসময়ে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না উত্তম, দুঃসময়ে ভারসাম্য বজায় রাখা কতই না উত্তম! আর ইবাদত-বন্দেগিতে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা কতই না সৌন্দর্যময়!’ (মুসনাদ বাজজার, কানজুল উম্মাল) মহানবী সা: অন্যত্র বলেন, নিশ্চয়ই দ্বীনি বিধিবিধান সহজ-সাবলীল। যে ব্যক্তি দ্বীনের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করবে দ্বীন তাকে পরাজিত করবে। সুতরাং তোমরা সহজ ও মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো, উত্তম প্রতিদানের সুসংবাদ গ্রহণ করো এবং সকাল-সন্ধ্যায়, রাতের কিছু অংশে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সহিহ বুখারি, নাসায়ি)
মহানবী সা: এক বৃদ্ধকে তার দুই ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে পা হেঁচড়ে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, এ ব্যক্তির কী হয়েছে? লোকেরা বলল, সে হেঁঁটে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করতে মনস্থ করেছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘এ ব্যক্তিকে কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করা থেকে আল্লাহ মুক্ত। মহানবী সা: তাকে তখন বাহনে আরোহণ করার নির্দেশ দেন।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
মহানবী সা: হিজরতের পর আনসারি সাহাবি সালমান ও মুহাজির আবু দারদা রা:-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। একদিন সালমান রা: আবু দারদা রা:-এর গৃহে যান। অতঃপর (আবু দারদা আ:-এর স্ত্রীকে নিম্নমানের পোশাকে দেখে) বলেন, আপনার এ অবস্থা কেন? উম্মে দারদা বলেন, আপনার ভ্রাতার পৃথিবীর প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই। অতঃপর আবু দারদা বাড়ি আসেন। হজরত সালমান রা:-এর জন্য খাদ্য আনা হলে তিনি হজরত আবু দারদা রা:-কেও খেতে বলেন। হজরত আবু দারদা বলেন, আমি রোজাদার। হজরত সালমান রা: বলেন, আপনি না খেলে আমি খাবো না। হজরত আবু দারদা রা: অগত্যা রোজা ভঙ্গ করে খাবার খান। যখন রাত হয়, তখন হজরত আবু দারদা রা: নফল সালাত পড়ার জন্য নিদ্রা থেকে উঠে যান। হজরত সালমান রা: বলেন, শুয়ে পড়–ন। হজরত আবু দারদা রা: শুয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর আবার উঠলে সালমান রা: বলেন, নিদ্রা যান। রাতের শেষ ভাগে সালমান রা: বলেন, এখন উঠুন। অতঃপর উভয়ে একত্রে সালাত পড়েন। অতঃপর হজরত সালমান রা: বলেন, আপনার কাছে আপনার প্রভুর হক আছে, নিজের হক আছে স্ত্রীর হক আছে। প্রত্যেকের হক পরিশোধ করুন। সকালে হজরত আবু দারদা রা: মহানবী সা:-এর কাছে সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করেন। মহানবী সা: বলেন, ‘সালমান সঠিক কথাই বলেছে।’ (সহিহ বুখারি)
হজরত মুজিবা বাহেলিয়া বলেন, তার পিতা বা চাচা মহানবী সা:-এর কাছে দ্বীনি শিক্ষা গ্রহণের জন্য আসেন। অতঃপর এক বছর পর পুনরায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে আসেন, তখন তার স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল ছিল। মহানবী সা: শরীরিক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আপনার কাছ থেকে যাওয়ার পর আমি দিনে আহার করিনি। সদা রোজা রেখেছি। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, তুমি নিজের প্রতি অবিচার করেছ।’ (আবু দাউদ) একদা মহানবী সা:-এর আমল জানার জন্য তাঁর গৃহে তিনজন সাহাবি আগমন করেন। রাসূলুল্লাহ সা: তখন গৃহে ছিলেন না। তারা স্ত্রীদেরকে তাঁর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তাঁর ইবাদত প্রসঙ্গে জানার পর তা একেবারেই নগণ্য মনে করেন। তারা মনে মনে বলে, রাসূলুল্লাহ সা:-এর অপেক্ষা আমরা কোথায়? তাঁর আগের ও পরের সব গুনাহ আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করে দিয়েছেন। এরপর তাদের একজন বলল, আমি নফল সালাতে সারা রাত অতিবাহিত করব। অপরজন বলল, আমি সবসময় রোজা রাখব, দিনের বেলা কখনো পানাহার করব না। আরেকজন বলল, আমি নারীদের এড়িয়ে চলব, কখনো বিয়ে করব না। রাসূলুল্লাহ সা: দূর থেকে তাদের কথা শুনে কাছে এসে বলেন, এসব কথা কি তোমরা বলছিলে? এরপর তিনি বলেন; শোনো, আমি আল্লাহকে তোমাদের চেয়ে অধিক ভয় করি এবং তাঁর নাফরমানি থেকে অধিক পরিমাণে দূরে থাকি। অথচ আমি কখনো নফল রোজা রাখি, আবার কখনো ভঙ্গ করি। রাতে সালাত আদায় করি, আবার নিদ্রা যাই। আর আমি বিয়েও করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সুন্নাতকে উপেক্ষা করে, সে আমার কেউ নয়।’ (সহিহ মুসলিম)
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী


আরো সংবাদ



premium cement