রমজানে দ্রব্যমূল্য

রমজান আত্মশুদ্ধি, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্ম গঠনের মাস। প্রতি বছর রমজান আসে মুসলমানদের জীবনকে পরিশুদ্ধ এবং পাপমুক্ত করার জন্য। রমজানের রোজা তাকওয়ার গুণ অর্জন এবং ইবাদতের অবারিত সুযোগ বয়ে আনে। বাংলাদেশে রমজান মাসে বাড়তে থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য, যা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ হচ্ছে পণ্যবাজারে। বিশ্বের একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে রমজান মাস এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়ে সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। রমজান মাসে একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও দ্রব্যসামগ্রীর কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। গোটা বিশ্বেই পণ্যের দাম কিছুটা বৃদ্ধি হলেও বাংলাদেশে তা কয়েকগুণ বেশি। দ্রব্য উৎপাদনের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারলেও যোগাযোগের সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, পরিবহন খরচ এখন দ্বিগুণেরও বেশি। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া হওয়ায় দেশের বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। সেই অনুপাতে মানুষের আয় বাড়েনি; বরং গড় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। এতে রোজাদার সাধারণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষকে নিদারুণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। অথচ অবৈধ মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা ইসলামে নিষেধ।
প্রতি বছর আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য হয় আকাশচুম্বী। এ বছর পণ্যের দাম যেন লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে রমজানকে উপলক্ষ করে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা আরেক দফা মূল্য বৃদ্ধি করলে সাধারণ মানুষের ওপর তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রোজার মাসে কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে? উত্তরে বলা হবে, চাহিদা বাড়ছে তাই জোগান স্বল্পতায় ভারসাম্য আনতে গিয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। আদৌ কি তাই? পণ্যগুলো কী পরিমাণ লাগবে এগুলো কি আমাদের অজানা? কোন কোন দ্রব্য কী পরিমাণে দরকার তা জানা থাকলে, কেন পণ্যের জোগান স্বল্পতা দেখা যায়? কেন দাম হু হু করে বেড়ে যায়? নাকি কৃত্রিমভাবে সঙ্কট তৈরি করে জোগান স্বল্পতার দোহাই দিচ্ছি আমরা? চাহিদা অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলে পূর্ণমাত্রায় ভারসাম্য বজায় থাকবে। শুধু পর্যাপ্ত জোগান নিশ্চিত করলেই হবে না, সব পেশার মানুষের ক্রয়ক্ষমতার প্রতি লক্ষ রেখে সরকারকে পণ্যের ন্যায্য মূল্য ঠিক করে দিতে হবে।
সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশই রমজান উপলক্ষে দ্রব্যমূল্যের সহজলভ্যতার জন্য প্রায় ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়ে থাকে। কিন্তু বিষয়টি আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। রমজানকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অধিক মুনাফা লাভের আশায় বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে। রমজান মাসে বাণিজ্যের নামে ব্যক্তিস্বার্থে ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে রমজানকে টার্গেট করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টিতে অপপ্রয়াস চালায়। রমজানে পণ্যের দাম বেড়েছে এমন অভিযোগ যাতে না ওঠে ও সাধারণ ক্রেতারা বুঝতে না পারে, সে জন্য আগে থেকে নিত্যপণ্যের দাম নীরবে পরিকল্পিতভাবে বাড়ানো হয়। যার ফলে শুধু রোজাদার নন, অন্য ধর্মাবম্বলীরাও কষ্টের শিকার হন।
রমজানে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করে রোজাদরকে কষ্ট দেয়া ইসলামে মহাপাপ। রমজানের মতো একটি ইবাদতের মাসেও তাদের কাছে মুনাফা লাভের সুবর্ণ সুযোগ হয়ে আসে। অসাধুদের স্বেচ্ছাচারিতা সীমাহীন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এমন প্রবণতা কখনো ইসলাম সমর্থন করে না; বরং এটি রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী। এ বছরও এ প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এখনই কী কারণে দাম বাড়ছে, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। নয়তো পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল, মজুদদারি, মুনাফাখোরি ও প্রতারণামূলক সব কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। সুষ্ঠু বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং অনিয়ম পেলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমদানিমূল্যের সাথে বিক্রয়মূল্যের ব্যবধান যাতে বেশি না হয়, তা নজরে রাখা জরুরি। এমন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে আমরা সুন্দর, সুশৃঙ্খল জীবন ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।
রমজান মাসজুড়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে আত্মশুদ্ধি অর্জন ও নৈতিক উন্নত চরিত্র গঠনে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইবাদতের মহোৎসবে শামিল করতে সুন্দর পরিবেশ ও রমজানের পূর্ণ অনুশীলনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক