১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানুষ থেকেই মানুষ

-

‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি. যেন তোমরা পরস্পরে পরিচিতি লাভ করতে পারো।’ (সূরা হুজরাত-১৩)
‘আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। কেননা তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেন এবং হুকুম দেন, হয়ে যাও, আর তা হয়ে যায়।’ (সূরা আলে ইমরান-৫৯)
‘যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে সুঠাম ও সুসামঞ্জস্য করে গড়েছেন এবং যে আকৃতিতে চেয়েছেন তোমাকে গঠন করেছেন।’ (সূরা ইনফিতার : ৭-৮)
‘তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর রাহমান : ৩-৪)
‘আমি মানুষকে পয়দা করেছি সর্বোত্তম কাঠামোয়।’ (সূরা ত্বিন-৪)
আয়াতগুলোর কোথাও কি এ কথা লিখা আছে যে, আমি মানুষদের প্রথমে এক ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীতে সৃষ্টি করেছি অতঃপর বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে? আর বর্তমান ও পূর্বের রূপ উভয়টি আমার সৃষ্টি? না, বরং মানুষের বর্তমান অবকাঠামো ও পূর্বের অবকাঠমো একই ছিল। উর্বর মস্তিষ্কের পাগলগুলোই কেবল বলে, বানরের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মানুষ। অর্থাৎ মানুষ এক সময় বানর ছিল। এরা মানব বিবর্তন বা মানুষের উৎপত্তি বলতে অন্যান্য হোমিনিড থেকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসেবে হোমো স্যাপিয়েন্স-দের উদ্ভবকে বোঝায়। এই বিষয়টি জানার জন্য তারা নৃবিজ্ঞান, প্রাইমেটবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, প্রতœতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব এবং জিনতত্ত্ব পড়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু কুরআন পড়ার পরামর্শ দেয় না। সত্যিকার অর্থে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মন্তব্য অনুযায়ী এরা মূর্খ, কারণ এদের কুরআনের জ্ঞান নেই।
‘আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম।’ (সূরা আ’রাফ-১১) অর্থাৎ আর আমি তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করলাম তারপর তোমাদের আকৃতি দান করলাম। এ কথার অর্থ হচ্ছে আমি প্রথমে তোমাদের সৃষ্টির পরিকল্পনা প্রণয়ন করলাম, তোমাদের সৃষ্টির মৌলিক উপাদান তৈরি করলাম তারপর সেই উপাদানকে মানবিক আকৃতি দান করলাম। অতঃপর আদম একজন জীবিত মানুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। কুরআন মাজিদের অন্যান্য স্থানেও এ আয়াতটির এরূপ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন সূরা সোয়াদের পঞ্চম রুকুতে বলা হয়েছে- ‘সেই সময়ের কথা চিন্তা করো, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি মাটি থেকে একটা মানুষ তৈরি করব। তারপর যখন আমি সেটি পুরোপুরি তৈরি করে ফেলব এবং তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই সামনে সিজদাবনত হবে।’ (আয়াত : ৭১-৭২) এ আয়াতটিতে ওই তিনটি পর্যায় বর্ণিত হয়েছে অন্য এক ভঙ্গিমায়। এখানে বলা হয়েছে : প্রথমে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করা হবে, তারপর তার ‘তাসবিয়া’ করা হবে অর্থাৎ তাকে আকার-আকৃতি দান করা হবে এবং তার দেহ-সৌষ্ঠব ও শক্তি-সামর্থ্যরে মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা হবে এবং সবশেষে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দিয়ে আদমকে অস্তিত্ব দান করা হবে। এ বিষয়বস্তুটিকেই সূরা হিজরের তৃতীয় রুকুতে নিম্নলিখিত শব্দাবলির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে :
‘আর সেই সময়ের কথা ভাবো যখন তোমার রব ফেরেশতাদের বললেন, আমি ছাঁচে ঢালা শুকনো ঠনঠনে মাটি থেকে একটি মানুষ সৃষ্টি করব, তারপর যখন তাকে পুরোপুরি তৈরি করে ফেলব তার মধ্যে নিজের রূহ থেকে কিছু ফুঁকে দেবো তখন তোমরা সবাই তার সামনে সিজদাবনত হবে।’ (আয়াত : ২৮-২৯)
মানব সৃষ্টির এ সূচনা পর্বের বিস্তারিত অবস্থা অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে কঠিন। মাটির পিণ্ড থেকে কিভাবে মানুষ বানানো হলো তারপর কিভাবে তাকে আকার আকৃতি দান ও তার মধ্যে ভারসাম্য কায়েম করা হলো এবং তার মধ্যে প্রাণ ফুঁকে দেয়ার ধরনটিই বা কি ছিল এসবের পূর্ণ তাৎপর্য বিশ্লেষণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও এ কথা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান যুগে ডারউইনের অনুসারীরা বিজ্ঞানের নামে যেসব মতবাদ পেশ করেছে মানবসৃষ্টির সূচনা পর্বের অবস্থা সম্পর্কে কুরআন মাজিদ তার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী অবস্থার বর্ণনা দিয়েছে।
ডারউইনের এসব মতবাদের দৃষ্টিতে মানুষ একটি সম্পূর্ণ অমানবিক বা অর্ধমানবিক অবস্থার বিভিন্ন স্তর থেকে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে মানবিক স্তরে উপনীত হয়েছে। আর এ ক্রমবিবর্তন ধারার সুদীর্ঘ পথে এমন কোনো বিশেষ বিন্দু নেই যেখান থেকে অমানবিক অবস্থার ইতি ঘোষণা করে মানবজাতির সূচনা হয়েছে বলে দাবি করা যেতে পারে। বিপরীত পক্ষে কুরআন আমাদের জানাচ্ছে, মানব বংশধারার সূচনা হয়েছে নির্ভেজাল মানবিক অস্তিত্ব থেকেই। কোনো অমানবিক ধারার সাথে তার ইতিহাসের কোনো কালেও কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রথম দিন থেকে তাকে মানুষ হিসাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল। আল্লাহ পরিপূর্ণ মানবিক চেতনাসহকারে পূর্ণ আলোকে তার পার্থিব জীবনের সূচনা করেছিলেন।
মানুষের ইতিহাস সম্পর্কে এ দু’টি ভিন্নধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ সম্পর্কে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চিন্তাধারার উদ্ভব হয়। একটি চিন্তাধারা মানুষকে জীবজন্তু ও পশু জগতের একটি শাখা হিসেবে পেশ করে। তার জীবনের সব আইন কানুন এমনকি নৈতিক ও চারিত্রিক আইনের জন্যও মূলনীতির সন্ধান করা হয় ইতর প্রাণীসমূহের জীবন রীতিতে ও পশুদের জীবন ধারায়। তার জন্য পশুদের ন্যায় কর্মপদ্ধতি একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি মনে হয়। সেখানে মানবিক কর্মপদ্ধতি ও পাশবিক কর্মপদ্ধতির মধ্যে বড় জোর এতটুকু পার্থক্য দেখার প্রত্যাশা করা হয়, মানুষ যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা, শিল্প-সভ্যতা-সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ও নিপুণ কারুকার্য অবলম্বনে কাজ করে। পক্ষান্তরে, পশুরা কাজ করে ওই সবের সহায়তা ছাড়াই।
বিপরীত পক্ষে অন্য চিন্তাধারাটি মানুষকে পশুর পরিবর্তে মানুষ হিসেবেই উপস্থাপন করে। সেখানে মানুষ বাকশক্তি সম্পন্ন পশু বা সামাজিক ও সংস্কৃতিবান জন্তু নয় বরং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। মানুষ সৃষ্টির সূচনালগ্নে আল্লাহ তার দায়িত্বের নামে অভিহিত করে বলেছিলেন আমি পৃথিবীতে খলিফা বা প্রতিনিধি সৃষ্টি করতে চাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যখন তোমাদের প্রভু ফেরেশতাদের বলেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীতে একজন খলিফা বা প্রতিনিধি বানাতে চাই।’ (সূরা বাকারা-৩০) সেখানে বাকশক্তি বা সামাজিকতাবোধ তাকে অন্যান্য জীব ও প্রাণী থেকে আলাদা করে না; বরং তাকে আলাদা করে তার নৈতিক দায়িত্ব এবং ক্ষমতা ও ইখতিয়ার যা আল্লাহ তাকে দান করেছেন এবং যার ভিত্তিতে তাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। এভাবে এখানে মানুষ ও তার সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয় সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণ পূর্ববর্তী দৃষ্টিকোণটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। এখানে মানুষের জন্য একটি জীবন দর্শন এবং অন্য একটি নৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার মূলনীতি অনুসন্ধান করার জন্যে মানুষের দৃষ্টি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নি¤œজগতের পরিবর্তে ঊর্ধ্বজগতের দিকে উঠতে থাকবে।
প্রশ্ন করা যেতে পারে, মানুষ সম্পর্কিত এ দ্বিতীয় ধারণাটি নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে যতই উন্নত পর্যায়ের হোক না কেন, নিছক কল্পনার ওপর নির্ভর করে যুক্তি-তথ্য দ্বারা প্রমাণিত একটি মতবাদকে কেমন করে রদ করা যেতে পারে। কিন্তু যারা এ ধরনের প্রশ্ন করেন, তাদের কাছে পাল্টা প্রশ্ন-সত্যিই কি ডারউইনের বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক যুক্তি-তথ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত? বিজ্ঞান সম্পর্কে নিছক ভাসা ভাসা ও স্থূল জ্ঞান রাখে এমন ধরনের লোকেরা অবশ্যি এ মতবাদকে একটি প্রমাণিত তাত্ত্বিক সত্য মনে করার ভ্রান্তিতে লিপ্ত। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও অনুসন্ধান বিশারদরা জানেন, গুটিকয় শব্দ ও হাড়গোড়ের লম্বা চওড়া ফিরিস্তি সত্ত্বেও এখনো একটি মতবাদের পর্যায়েই রয়ে গেছে এবং এর যেসব যুক্তি-তথ্য ভুলক্রমে প্রামাণ্য বলা হচ্ছে, সেগুলো নিছক সম্ভাব্যতার যুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
ডারউইনের বিবর্তনবাদের সম্ভাবনা স্রেফ একটি মতবাদ যার বাস্তবতা শূন্য শতাংশ। কারণ হজরত আদম আ:-এর মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টির সূচনা হয়েছে এবং বর্তমানে সেই মানুষই আছে। আদম সৃষ্টির যুগ থেকে নিয়ে অদ্যাবধি পৃথিবীর এমন কোনো যুগ অতিবাহিত হয়নি যেখানে হাজার হাজার বছর কেটে গেছে এবং সেই যুগটুকুর খবর আমাদের কাছে পৌঁছায়নি। ঠিক সেই সময়টুকুতেই ডারউইনের চশমায় ধরা পড়ে যে, মানুষ বানরে পরিণত হয়েছে, কালক্রমে বিবর্তন ঘটে পুনরায় মানুষে পরিণত হয়। এখানেও ডারউইনের মতবাদ টিকবে না, কারণ এ ধরনের লম্বা কোনো যুগ পৃথিবী অনাবাদি থাকেনি। মানুষের সৃষ্টির সূচনা হয়েছে মানবিক ও নৈতিক জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পন্ন হিসেবে আর এখনো নৈতিক মানুষই আছে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আমি বনি আদমকে মর্যাদা দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৭০) অর্থাৎ মহান আল্লাহ বনি আদমকে সুন্দর দৈহিক কাঠামো তথা সুন্দর চেহেরা, সুঠাম দেহ, উপযুক্ত প্রকৃতি ও অঙ্গসৌষ্ঠব এবং উন্নত চিন্তাশক্তি এবং ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ ও উপকারী-অপকারীর মধ্যে পার্থক্য করার শক্তি দান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর রাহমান : ৩-৪) ‘আল্লাহ কথা বলা শিখিয়েছেন’। এর অর্থ হচ্ছে, নিজের উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ব্যক্ত করার ক্ষমতা দিয়েছেন। এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণের মধ্যকার পার্থক্য করার ক্ষমতা দিয়েছেন। আর বাকশক্তির কারণে মানুষকে জীবজন্তু ও পৃথিবীর অন্যান্য সৃষ্টিকূল থেকে পৃথক করে দেয়। এটা শুধু বাকশক্তিই নয়, এর পেছনে জ্ঞান ও বুদ্ধি, ধারণা ও অনুভূতি, বিবেক ও সঙ্কল্প এবং অন্যান্য মানবিক শক্তি কার্যকর থাকে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল