২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাদিসের দারসে হৃদয়ের পরিবর্তন

-

কুরআন-হাদিসের ইলম অন্বেষণের তাওফিক পাওয়া আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। শুরু থেকে দাওরায়ে হাদিস অবধি আসা আরো মহা অনুগ্রহ। নিচের জামাতগুলোতে বিভিন্ন ধরনের কিতাবা থাকলেও দাওরাতে সব কিতাবই হাদিসের। পুরো বছরজুড়েই হাদিস পড়ানো হয়। কখনো উস্তাদ নিজে পড়েই তাকরির দেন। আমরা হই নীরব শ্রোতা। কখনো বা ছাত্ররা পড়ে উস্তাদ তাকরির দিয়ে যান। মুগ্ধ হয়ে শুনে যাই চাতক পাখির মতো।

বাদ ফজর থেকে হাদিসের দারসে বসি। চলতে থাকে হাদিসের পাঠদান। উস্তাদ কিংবা ছাত্রের কণ্ঠে ক্রমাগত বাজতে থাকে ওয়া বিহি ক্বলা হাদ্দাসানা আর ক্বলা রাসূল সা: কিংবা আ’ন রাসূলিল্লাহ আনিন্ নাবি। তখন হৃদয় নিংড়ানো আবেগ আর ভালোবাসায় অকপটে মুখে উচ্চারিত হয় ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’। নবীপ্রেমের অবারিত বৃষ্টিতে সিক্ত হয় হৃদয় জমিন।

বুখারির প্রথম অধ্যায় ওহির সূচনার হাদিস দিয়ে। অর্থাৎ প্রিয়নবী সা:-এর ওপর কিভাবে ওহির সূচনা হয়েছিল। হাদিসের এবারত আর উস্তাদের মুখ নিঃসৃত তাকরির শুনে চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় প্রিয় নবী সাল্লøাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ওহি নাজিলের সেই আনন্দঘন মুহূর্ত। যখন মানবজাতির সফলতার প্রথম সবক দেয়া হয়েছিল। এরপর ওহির গুরুদায়িত্ব উপলব্ধি করে রাসূলের ঘাবড়ে যাওয়া। ঘরে এসে আম্মাজান খাদিজাতুল কুবরা রা:-কে সম্বোধন করে বলা ‘জাম্মিলুনি জাম্মিলুনি’, আর পাহাড়ের পাদদেশে উঠে গোত্রের লোকজনকে একাত্মবাদের আহ্বান- এসব যেন চোখের সামনে দৃশ্যমান।
হাদিসের কিতাবের একেকটি অধ্যায় পাঠকালে হৃদয়ের অবস্থাও পরিবর্তন হতে থাকে। কিতাবুল ঈমানের হাদিস ও তাকরির শুনে সাহাবিদের ঈমানের সামনে নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হয়। দ্বীনের জন্য তাদের কত ত্যাগ-সীমাহীন ধৈর্য। স্বদেশ ছেড়ে হিজরত। এক হাদিসে প্রিয় নবী সা: ঈমানের তিনটি স্তর বর্ণনা করেছেন। সেখানে তিনি সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ করেছেন যে, মন্দ কাজ দেখে অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা। অর্থাৎ সেটিকে পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করা। আমাদের অবস্থা তো এই, মন্দ কাজের প্রতিবাদের পরিবর্তে নিজেরাই সেখানে লিপ্ত হচ্ছি লাগামহীনভাবে। তাহলে আমাদের ঈমান কোথায়? একটু চিন্তা করুন!

বুখারি ছানি আর আবু দাউদ ছানিতে যুদ্ধ-জিহাদ সংক্রান্ত হাদিসগুলো পড়ে ঈমানের নদীতে জজবার ঢেউ ওঠে। হৃদয়ে জাগ্রত হয় সাহাবায়ে কেরাম রা:-এর জিহাদি স্পৃহা। নিজেকে খুঁজে পাই যুদ্ধের ময়দানে আল্লাহর তরবারি উপাধিতে ভূষিত খালিদ বিন ওয়ালিদ রা:-এর মতো বীর পালোয়ানের সাথে সম্মুখসারিতে। শাহাদাতের অমিয় সুধা পানে উন্মুখ থাকে মানবাত্মা।

প্রিয় নবী সা:-এর পুরোটা জীবনই ছিল সাদাসিধা। তিনি ইচ্ছে করলে শাহী হালতে দিনাতিপাত করতে পারতেন। আল্লাহ তাকে প্রাচুর্যতা দিতেন।

কিন্তু তিনি দৈন্যতার জিন্দেগিই বেছে নিয়েছিলেন। পুরোটা জীবন দুনিয়াবিমুখ থেকেছেন। হজরত আয়েশা রা: কোনো এক তাবেয়ির প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, মুহাম্মাদ সা:-এর পরিবার এক নাগাড়ে তিন দিন তরকারিসহ গমের রুটি পেট ভরে খাননি।

সাহাবায়ে কেরাম রা: এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। দ্বীনের জন্য সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন সদা হাস্যবদনে।
সবচেয়ে বেশি দুনিয়াবিমুখ ছিলেন সাহাবি আবু জর রা:। সম্পদ জমা করে রাখার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। কারণ রাসূল সা: এক হাদিসে বলেন, সম্পদশালীরা কিয়ামতের দিন সর্বনিম্ন স্তরে উপনীত হবে। কিন্তু যারা নিজেদের মাল এদিক সেদিক (আল্লাহর পথে) খরচ করবে তারা এর ব্যতিক্রম। (সুনানে ইবনে মাজাহ-৪১৩০) সেই হাদিসের ওপর তিনি অটল ছিলেন। কারণ বেশির ভাগ মানুষই এ ক্ষেত্রে ধোঁকায় পড়ে যায়।

কিতাবুল ফিতান। আশরাতুস সাআ’হ। রাসূল সা:-এর ওফাতের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত বিভিন্ন ফিতনা সম্পর্কিত হাদিস। যেমন জিনা-ব্যভিচার, মদ্যপান, প্রকাশ্যে মন্দ কাজ। অযোগ্য লোকের বড় বড় পদ পাওয়া। দাজ্জালের আবির্ভাব, ইমাম মাহদির আগমন ইত্যাদি। এ-সক্রান্ত হাদিসগুলো যখন সামনে আসে তখন আমাদের সমাজের সাথে যেন অক্ষরে অক্ষরে মিল খুঁজে পাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্রিয় নবী সা: কথাগুলো সরাসরি আমাদের লক্ষ করেই বলে গিয়েছিলেন। আমরাই তার প্রথম সম্বোধিত ব্যক্তি। কারণ এসব কাজ আমাদের সমাজে খুব জোরালোভাবে চলছে।

রাসূল সা: উম্মতের ব্যাপারে আরেকটি ফেতনার আশঙ্কা করেছিলেন। শেষ জামানায় উম্মতের মধ্যে এমন একটি দল আবির্ভূত হবে, যাদের আরবিতে বলে মুনকিরিনে হাদিস বা হাদিস অস্বীকারকারী। যারা বর্তমানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে মানুষের মধ্যে ফিতনার বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষকে দ্বীন থেকে বিমুখ করার নীল নকশা এঁকে যাচ্ছে দিব্যি। এ জন্যই প্রিয় নবী সা: উম্মতকে সতর্ক করে গেছেন খুব জোরালোভাবে। একটি হাদিস এখানে পেশ করছি।

রাসূল সা:-এর প্রিয় সাহাবি হজরত মিকদাম ইবনে মাদিকারিব রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন : রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘সাবধান! শিগগিরই এমন ব্যক্তির আগমন ঘটবে, সে তার সুসজ্জিত গদিতে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। তখন তার কাছে আমার কোনো হাদিস পৌঁছলে সে বলবে, আমাদের ও তোমাদের মধ্যে তো আল্লাহর কিতাবই আছে। আমরা তাতে যা হালাল পাবো সেগুলো হালাল বলে মেনে নেবো এবং যেগুলো হারাম পাবো সেগুলো হারাম বলে মেনে নেবো। সাবধান! রাসূল সা: যা হারাম করেছেন তা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হারামকৃত বস্তুর মতোই হারাম। (সূনানে তিরমিজি-২৬৬৪) হাদিসটি ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদেও এসেছে।

রাসূল সা:-এর বাণীর সত্যতা আজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে। একদল লোক উঠেপড়ে লেগেছে হাদিস অস্বীকার করার ব্যাপারে। তাদের কাছে আমার সরল প্রশ্ন! আপনারা যারা হাদিস অস্বীকার করেন; কুরআন কেন নিঃশর্তে মেনে নেন? হাদিস যে পরম্পরায় বা সনদে এসেছে কুরআনও তো সেই সনদেই এসেছে। এখন আবার প্রশ্ন আসতে পারে কুরআন হিফাজতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিয়েছেন। সে জন্যই কুরআন সংরক্ষিত ও অবিকৃত।

তাহলে আমি বলব, এই যে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিলেন কুরআন তিনি হিফাজত করবেন সেই আয়াতটি কি সরাসরি আপনার ওপর আল্লাহ নাজিল করেছেন নাকি এ আয়াতটিও তাদের সূত্রেই এসেছে! তাই হাদিস অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। হাদিস অস্বীকার করা রাসূলকে অস্বীকার করার নামান্তর। দ্বীনকে অস্বীকার করার নামান্তর। আশা করি বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।

লেখক : শিক্ষার্থী, জামিয়া আরাবিয়া মাখযানুল উলুম, ময়মনসিংহ সদর


আরো সংবাদ



premium cement