১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অহঙ্কারীদের পরিণাম

-

জ্ঞান, গুণ, মেধা, অর্থ-বিত্ত, শক্তি-ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রাচুর্যের কারণে মানুষের মনে অহঙ্কার আসে। কিন্তু মানুষ যদি চিন্তা করে যে, এসব নিয়ামত আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন, তিনি ইচ্ছা করলে এগুলো ছিনিয়ে নিতে পারেন, সব ধরনের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত করতে পারেন, তা হলে তার মধ্যে অহঙ্কার আসতে পারে না। অহঙ্কার তখনই আসে যখন কেউ কোনো নিয়ামতকে নিজের বলে জ্ঞান করে। নিজের উপার্জনকৃত বলে মনে করে; কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, উপার্জন করার শক্তি ও ক্ষমতা আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। লোকদের প্রত্যেকেরই মনে রাখা দরকার, আমার যত নিয়ামত রয়েছে সব মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। আল্লাহ তায়ালা যদি না দিতেন, তা হলে আমি নিঃস্ব, দরিদ্র, অসহায় ও দুর্বল থাকতাম। অহঙ্কার করার মতো কিছুই থাকত না। তাই অহঙ্কারের পরিবর্তে সব সময় অন্তরে আল্লাহর শুকরিয়া জাগরূক রাখা উচিত। যারা অহঙ্কার করে তাদের পরিণাম নিতান্ত ভয়াবহ হওয়ার হুঁশিয়ারি কুরআন-হাদিসে উচ্চারিত হয়েছে।

অহঙ্কারী অপমানিত হবে : অনেক মানুষ পূর্বপুরুষকে নিয়ে দম্ভ ও অহঙ্কার করে। কিন্তু পূর্বপুরুষকে নিয়ে দম্ভ ও অহঙ্কার করার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, পূর্বপুরুষের কী পরিণাম হয়েছে তা আমাদের জানা নেই। পরকালে তারা সুখে আছেন নাকি দুঃখে আছেন তার কোনো খবর আমাদের কাছে নেই। তাই পূর্বপুরুষকে নিয়ে দম্ভ করা বর্জনীয়। যারা পূর্বপুরুষকে নিয়ে দর্প করে তারা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে মর্মে হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যেসব সম্প্রদায় তাদের পূর্বপুরুষকে নিয়ে গর্ব করে, তারা যেন অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকে।

কেননা, তারা জাহান্নামের কয়লায় পরিণত হয়েছে। নতুবা তারা আল্লাহ তায়ালার দরবারে গুবরে পোকার তুলনায় বেশি অপমানিত হবে, যা নিজের নাক দিয়ে গোবরের ঘুঁটে তৈরি করে। তোমাদের থেকে আল্লাহ তায়ালা জাহেলি যুগের গর্ব-অহঙ্কার ও পূর্বপুরুষকে নিয়ে আত্মগর্ব প্রকাশ দূরীভূত করেছেন। এখন সে মু’মিন-মুত্তাকি অথবা পাপাত্মাদুরাচার। সব মানুষ আদম আ:-এর সন্তান। আর আদম আ:-কে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে।’ (সুনানে তিরমিজি-৩৯৫৫) অন্য আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, অহঙ্কারীরা অপমানিত হবে। তাদেরকে অপমান ও লাঞ্ছনা পরিবেষ্টন করে নেবে। অহঙ্কারীদের জাহান্নামিদের গলিত রক্ত ও পুঁজ পান করিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমান ও অসম্মান করা হবে। হজরত আমর ইবনে শুআইব রহ: তার বাবা ও দাদা থেকে বর্ণনা করেন, মহানবী সা: বলেছেন, “দাম্ভিক ব্যক্তিদেরকে কিয়ামত দিবসে ক্ষুদ্র পিঁপড়ার মতো মানুষের রূপে সমবেত করা হবে। তাদেরকে চার দিক হতে অপমান ও লাঞ্ছনা ছেয়ে ফেলবে। জাহান্নামের ‘বুলাস’ নামক একটি কারাগারের দিকে তাদেরকে টেনে নেয়া হবে, আগুন তাদেরকে গ্রাস করবে, জাহান্নামিদের গলিত রক্ত ও পুঁজ তাদের পান করানো হবে।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস-২৪৯২)

দাম্ভিক আল্লাহর কাছে অপছন্দনীয় : অহঙ্কারী ব্যক্তিরা সাধারণত অন্য লোকদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে। দর্প, দম্ভ ও গর্বভরে পৃথিবীর বুকে বুক ফুলিয়ে হাঁটে। ধরাকে সরাজ্ঞান করে। নিজেকে বড় ও অন্যদের ছোট মনে করে। মানুষকে সম্মান করতে চায় না ও মর্যাদা দিতে সম্মত হয় না। যাকে-তাকে ধমক দিয়ে জোরে জোরে কথা বলে। চিৎকার চেঁচামেচি করে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে। বাহাদুরি দেখায় ও লোকদের বদনাম করে বেড়ায়। এমন গর্ব, অহঙ্কার ও দর্প প্রদর্শন করতে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। দাম্ভিক, অহঙ্কারী ও দর্পশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, ‘অহঙ্কারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। পদচারণায় মধ্যবর্তিতা অবলম্বন করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু করো।

নিঃসন্দেহে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সূরা লুকমান : ১৮-১৯) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা দম্ভভরে পদচারণা করতে নিষেধ করে এটি অপছন্দনীয় ও মন্দকাজ বলে ঘোষণা করে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণা করো না। নিশ্চয় তুমি তো ভূ-পৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনোই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না। এসবের মধ্যে যেগুলো মন্দকাজ, সেগুলো তোমার পালনকর্তার কাছে অপছন্দনীয়।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৩৭-৩৮)

অহঙ্কারী আল্লাহর সুদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত : কিছু লোক অহঙ্কারবশত কাপড় হেঁচড়িয়ে পথ চলে। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাপড়ে ময়লা, আবর্জনা ও নাপাকি লাগার সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার ক্রোধে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত কাপড় হেঁচড়িয়ে চলে তার প্রতি আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। আর আল্লাহ তায়ালা যদি কারো প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে না তাকান, তাহলে তার দুর্ভাগ্যের অন্ত থাকবে না। তাই অহঙ্কারবশত কাপড় হেঁচড়িয়ে চলা বর্জন করা নিজের স্বার্থেই অপরিহার্য। অবশ্য বেখেয়ালে যদি টাখনুর নিচে কারো কাপড় চলে যায়, তাহলে তাকে পাকড়াও করা হবে না। হজরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ রা: থেকে তার পিতার সূত্রে বলেন, রাসূলল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অহঙ্কারবশত পরিধেয় বস্ত্র মাটিতে হেঁচড়িয়ে চলে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে তাকাবেন না।’ এ কথা শুনে আবু বকর রা: বললেন, আমার লুঙ্গির এক দিক মাঝে মধ্যে ঝুলে পড়ে। আমি তো সে দিকে সর্বদা সতর্ক হতে পারি না। তিনি বললেন, ‘যারা অহঙ্কারবশে এরূপ করে আপনি তো তাদের মতো নন।’ (সুনানে আবু দাউদ-৪০৮৫)

অহঙ্কারী শাস্তি পাবে : মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তার ক্ষমতাবলে এই মহাবিশ্ব, নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল, পাহাড়-পর্বত, সাগর-মহাসাগর, নদ-নদী, খাল-বিল, গাছপালা, তরুলতাসহ অসংখ্য বস্তু সৃষ্টি করেছেন। তার শক্তি ও ক্ষমতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। আর এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ক্ষমতাধর সত্তার জন্যই অহঙ্কার করা সাজে। আপাদমস্তক দুর্বল মানুষের জন্য অহঙ্কার করা মানায় না। যে মানুষের সূচনা নাপাক বীর্য দিয়ে এবং যার সমাপ্তি পরিত্যাজ্য লাশ হওয়া দিয়ে- তার পক্ষে অহঙ্কার করা সাজে না। এমন দুর্বল সত্তা হওয়া সত্ত্বেও যারা অহঙ্কার করবে আল্লাহ তায়ালা তাদের শাস্তি দেবেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা: ও আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ইজ্জত ও সম্মান আল্লাহর ভূষণ এবং গর্ব ও অহঙ্কার তাঁর চাদর। যে লোক এ ক্ষেত্রে আমার সাথে টানাহেঁচড়া করবে আমি তাকে অবশ্যই সাজা দেবো।’ (সহিহ মুসলিম-৬৫৭৪)

অহঙ্কার বিপদ ডেকে আনে : অহঙ্কার ইহ ও পরকালে বিপদ ডেকে আনে। অহঙ্কারী ব্যক্তিকে কেউ ভালোবাসে না। সে যেমন লোকদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে লোকেরাও তাকে ঠিক তেমনিভাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে। তাকে ছোট মনে করে ও ঘৃণা করে। এক ব্যক্তি অহঙ্কারবশত চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দম্ভভরে পৃথিবীতে চলছিল। আল্লাহ তায়ালার কাছে এই দৃশ্যটি পছন্দ হয়নি। তাই তিনি তাকে মাটিতে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির অতলতলে তলিয়ে যেতে থাকবে। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি আকর্ষণীয় এক জোড়া কাপড় পরিধান করে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে পথ চলছিল; হঠাৎ আল্লাহ তাকে মাটির নিচে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত অবধি সে এভাবে ধসে যেতে থাকবে।’ (সহিহ বুখারি-৫৭৮৯)

অহঙ্কারী জান্নাত থেকে বঞ্চিত থাকবে : জান্নাত এমন এক স্থান যেখানে সুখ, শান্তি, আনন্দ, বিনোদন ও আরাম-আয়েশের সমুদয় উপকরণ বিদ্যমান। জান্নাতে যা চাওয়া হবে তাই পাওয়া যাবে। জান্নাতে কোনো অভাব, অনটন ও দুঃখ কষ্ট থাকবে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই চির সুখের জান্নাত থেকে অহঙ্কারীরা বঞ্চিত থাকবে। যে ব্যক্তির অন্তরে সামান্য পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সেই ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাতে দেবেন না। জান্নাতের সুখ-শান্তি ও আরাম আয়েশ থেকে তাকে বঞ্চিত করে দেবেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, মহানবী সা: বলেছেন, ‘যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, মানুষ চায় যে, তার পোশাক সুন্দর হোক, তার জুতো সুন্দর হোক, এ-ও কি অহঙ্কার? রাসূল সা: বললেন, ‘আল্লাহ সুন্দর, তিনি সুন্দরকে ভালোবাসেন। প্রকৃতপক্ষে অহঙ্কার হচ্ছে দম্ভভরে সত্য ও ন্যায় অস্বীকার করা এবং মানুষকে ঘৃণা করা।’ (সহিহ মুসলিম-১৬৬)

অহঙ্কারীর বাসস্থান জাহান্নাম : চির কষ্টের স্থান জাহান্নাম। সেখানে কেবল কষ্ট আর কষ্ট। দুঃখ, দুর্দশা, আপদ-বিপদ ও বালা-মুসিবতে ভরপুর জাহান্নাম। সেখানে ভয়াবহ আগুনের প্রতাপ সর্বত্র। সুখের লেশমাত্র নেই। দুঃখ-কষ্টের সমুদয় উপকরণ সেখানে বিদ্যমান। সেখানে চাইলেও একটু পানি পাওয়া যাবে না। একটু শান্তির বাতাস পাওয়া যাবে না। একটু সুখের পরশ লাভ করা সম্ভব হবে না। এই চির দুঃখের জাহান্নাম হবে অহঙ্কারীদের আবাসস্থল। এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলা হবে, তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করো, সেখানে চিরকাল অবস্থানের জন্য। কত নিকৃষ্ট অহঙ্কারীদের আবাসস্থল।’ (সূরা জুমার-৭২)

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement