২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলেমদের দায়িত্ব

-

[মুহাম্মাদ আকরাম নদভী বর্তমান বিশ্বের একজন প্রখ্যাত মুসলিম স্কলার। ক্যামব্রিজ ইসলামিক কলেজের ডিন, আসসালাম ইনস্টিটিউটের প্রিন্সিপাল ও মার্কফিল্ড ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশনের অনারারি ভিজিটিং ফেলো। ১৯৮৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ছিলেন। তিনি মুসলিম নারী মুহাদ্দিসদের জীবনী নিয়ে ৪৩ খণ্ডে ‘আল-ওয়াফা বি আসমাইন নিসা’ নামে চরিত-কোষ রচনা করেছেন। যাতে প্রায় ১০ হাজার নারী মুহাদ্দিসের জীবনী স্থান পেয়েছে। এই কাজে তিনি ১৫ বছর ব্যয় করেছেন। বাংলাদেশ সফরের অংশ হিসেবে গত ২৯ অক্টোবর ২০২২ তিনি ঢাকা বায়তুল মোকারম ইসলামী মিলনায়তনে পুরুষদের উদ্দেশে উর্দু ভাষায় বক্তব্য রাখেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে তার অনুলিখন ও অনুবাদ করেছেন মুহিম মাহফুজ]


আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে ১৯৮৫ সালে আমি এই মসজিদে প্রথমবার আসার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি তখন দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে শিক্ষকতার প্রথম বছরে পদার্পণ করেছি। সে বছর তাবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশে এসেছিলাম এবং এই মসজিদ পরিদর্শন করেছি।
১৯৯১ সালে আমি যখন অক্সফোর্ডে ছিলাম, সে সময় ‘ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ’-বিষয়ক একটি প্রকল্পে কাজ করেছিলাম। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ইসলাম প্রচারে কোনো কোনো মাদরাসা-মারকাজ-খানকা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, কোনো কোনো সুফি-দরবেশ দাওয়াত প্রচার করেছেন- এ বিষয়ে আমি প্রায় ২৩ বছর গবেষণা করেছি। তখন ইসলাম প্রচারে বঙ্গ অঞ্চলের উজ্জ্বল ইতিহাস সম্পর্কে আমি জেনেছি। কোনো কোনো বিখ্যাত আলেম বাংলাদেশে আগমন করেছেন, কোনো কোনো যুগশ্রেষ্ঠ সুফি-দরবেশ বঙ্গ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন, তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তখন থেকে আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত।
হজরত শাহজালাল ইয়েমেনিসহ অন্যান্য মহান মনীষীর কথা আমি জানি। ভারত থেকে বহু মানুষ তাদের খানকায় এসে জ্ঞান শিক্ষা করেছে। শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা ঢাকার সোনারগাঁওয়ে মাদরাসা স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস এবং তিনিই সহিহ বুখারি শরিফ সর্বপ্রথম উপমহাদেশে নিয়ে আসেন। আপনাদের বাংলাদেশের এই গৌরবজনক ইতিহাস আমাকে সব সময় উদ্বুদ্ধ করেছে।
আল্লøাহ তায়ালা মানুষকে বিবেক দিয়েছেন। আর ওলামায়ে কেরামকে বিবেক দিয়ে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন। আলেমদের বৈশিষ্ট্য হলো- তারা শাগরেদ তৈরি করবেন, নিজেরা কট্টরপন্থা পরিহার করে চলবেন এবং মানুষের চিন্তা পরিবর্তনের চেষ্টা করবেন। কেননা, মানুষের চিন্তা কোনো দিকে পরিবর্তিত হয়ে গেলে সে সহজেই সেটি গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে। যার অন্তরে একবার ঈমানের আগুন জ্বলে উঠেছে, তাকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হলেও সে ঈমান পরিত্যাগ করবে না। এটিই দাওয়াতের সবচেয়ে বড় শক্তি। আল্লøাহ তায়ালা এ বৈশিষ্ট্য দিয়েই মানুষ সৃষ্টি করেছেন।


মুসলিম ইতিহাসে এমন একটি সময় এসেছিল, যখন চিন্তাগতভাবে মুসলিমরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। হাদিস বা সুন্নাহ বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে শৈথিল্য এসে পড়েছিল। তখন মুহাদ্দিসরা এক অসাধারণ কাজের সূচনা করেছেন। মানুষের মনে হাদিসের গুরুত্ব এবং মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। হাদিসের বিরাট বিরাট কিতাব সঙ্কলন করেছেন। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসায়ি, ইবনে মাজাহর মতো হাজার হাজার হাদিস গ্রন্থ সঙ্কলিত হয়েছে।
ইতিহাসের আরেক কালে মুসলমানদের মধ্যে দর্শন চর্চার উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে পড়ে। পৃথিবী বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ইবনে সিনা অনবদ্য গ্রন্থ রচনা করেন ‘আশশিফা’। যা মানব ইতিহাসে এক হাজার বছর পর্যন্ত অবশ্য পাঠ্য ছিল। এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ- পৃথিবীর সর্বত্র এই গ্রন্থ পঠিত হতো। রোম সভ্যতার ওপর দর্শনশাস্ত্রের বিশেষ প্রভাব লক্ষ করা যায়। ইমাম গাজালি রহমাতুল্লাহি আলাইহি দর্শনশাস্ত্রের দুর্বলতা তুলে ধরে রচনা করেন এক অসামান্য গ্রন্থ- ‘তাহাফুতুল ফালাসিফা’ বা দার্শনিকদের স্খলন। তার এই কিতাব রচনার কারণে দর্শনশাস্ত্রের যে ব্যাপক প্রচার ও চর্চা ছিল, সেটি সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। সে সময় মাদরাসাগুলোতে মানতেক বা যুক্তিশাস্ত্র পড়ানো হতো। দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হতো। ফলে মুসলমানদের মধ্যে দর্শনের প্রভাব প্রবল হয়ে উঠেছিল। তখন সাধারণ মানুষের কথাবার্তার মধ্যেও যুক্তি ও দর্শনের প্রভাব ছিল। তখন ইমাম ইবনে তাইমিয়া দর্শন শাস্ত্রের মোকাবেলায় একটি কিতাব রচনা করেন- ‘আর রদ্দু আলাল মানতিকিয়্যিন’ বা যুক্তিবাদীদের যুক্তি খণ্ডন। এই কিতাবের মাধ্যমে তিনি যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি নড়বড়ে করে দেন। তখন থেকে যুক্তিবিদ্যার প্রভাব মুসলমানদের মধ্যে হ্রাস পেতে থাকে। এমনকি এর প্রভাব ইউরোপেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে নতুন করে যে যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটে, সেটি ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম গাজালির প্রস্তাব মেনে নিয়ে নতুন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যেসব বিষয়ে তারা আপত্তি তুলেছেন, সেগুলোর সংশোধন ও পরিমার্জন করা হয়েছে। আগের যুক্তিবিদ্যা আগের অবয়বে অবশিষ্ট থাকেনি। তারা প্রাচীন দর্শনশাস্ত্রের আমূল সংস্কার সাধন করেছেন।
আমার সামনে সম্মানিত ওলামায়ে কেরাম উপবিষ্ট আছেন। আপনারা জানেন, ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব মানুষকে দ্বীনের জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। মানুষের মধ্যকার দূরত্ব ও ব্যবধান ঘোচানো। মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য সৃষ্টি করা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।


আজ সারা বিশ্বে যে নতুন প্রশ্ন ও সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার সমাধান ইলমে কালাম বা যুক্তিবিদ্যায় নিহিত নেই। মাদরাসাগুলোতে আমরা প্রাচীন ইলমে কালাম পড়িয়ে থাকি। ইলমে কালাম এমন একটি বিদ্যা যা সৃষ্টি হয়েছিল আব্বাসি শাসনামল বা তার নিকটকালে। কিন্তু পৃথিবী বদলে গেছে। নতুন অনেক সঙ্কট ও সংশয় দেখা দিয়েছে। এখনো যদি আমরা মাদরাসাগুলোতে ‘আল কুরআন আল্লাহর মাখলুক নাকি মাখলুক নয়’ এই বিতর্ক পড়াতে থাকি, সেটি আমাদের জন্য বিশেষ উপকারী হবে না। এ সব প্রশ্ন এখন মানুষ উত্থাপন করে না। এই প্রশ্ন নিয়ে এ যুগে কোনো বিতর্ক নেই। অথচ এই প্রশ্ন এক হাজার বছর পর্যন্ত মুসলমানদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল।
এখন আধুনিক যুগে নতুন ধরনের প্রশ্ন ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। ডারউইন মনে করেন, মানব সৃষ্টির ঘটনা একটি দুর্ঘটনা মাত্র। আল্লাহ তায়ালা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেননি। একটি প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার মধ্যে প্রাণী সমাজ অস্তিত্ব লাভ করেছে। এই মতবাদ আমাদের স্কুলগুলোতে পড়ানো হচ্ছে। আমাদের সন্তানরা স্কুলে গিয়ে এই মতবাদ শিখছে এবং এটিকে সত্য হিসেবে মেনে নিচ্ছে। পরে তারা যখন কুরআন অধ্যয়ন করছে, স্কুলে শেখা মতবাদের বিপরীত মত কুরআনে আবিষ্কার করছে। ফলে তাদের মধ্যে অনেকেই কুরআন অস্বীকার করছে। অনেকে হয়তো সামাজিক লজ্জায় অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু তাদের অন্তর সংশয়ে ভরা থাকে। আলেম সমাজের দায়িত্ব, এ ধরনের নতুন মতবাদের জবাবে কিতাব রচনা করা। যুক্তি ও দলিলভিত্তিক জবাব দেয়া। সব সংশয় নিরসন করা। যেন আমাদের ধর্মে আবার ঈমানের ঔজ্জ্বল্য ফিরে আসে। (আগামী কাল সমাপ্য )

 

 


আরো সংবাদ



premium cement